তথ্য-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সাফল্যমণ্ডিত যুগে পদার্পণ করেও এক মহামারীর সাক্ষী হওয়া এই আমরা, এর কোনো সুরাহা করতে না পেরে জনে জনে গ্রহণ করে নিয়েছি গৃহবন্দিত্ব। আমাদের চিরচেনা এই পৃথিবী আর আগের মতো নেই। গত দেড় বছরে বদলে গেছে অনেকখানি, স্থবির হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। ধীরে ধীরে এর সাথেই আমরা এমনভাবে মানিয়ে নিয়েছি যেন এটাই স্বাভাবিক, এমনই হবার কথা ছিল!
এ সংকট নিরসনে সর্বস্তরের মানুষ নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, দৈনন্দিন জীবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠা শুরু করতেই বছর ঘুরে আবারও চলে এলো করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় প্রকোপ’। তবে এবার সে একা আসেনি, ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সাথে করে নিয়ে এসেছে আরো এক রোগ। প্রযুক্তির কল্যাণে ইতোমধ্যেই সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে ছত্রাকঘটিত বিরল রোগটি; ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, চিকিৎসাবিজ্ঞানে যা ‘মিউকরমাইকোসিস’ হিসেবেই পরিচিত। ‘মিউকরাল’ বর্গের অধীনে থাকা সকল ছত্রাকই এ রোগের কর্ণধার। তবে ভারতে যারা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন, ল্যাব পরীক্ষায় এ বর্গের অন্তর্ভুক্ত কেবলমাত্র ‘মিউকর’ নামক প্রজাতির সন্ধান মিলেছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সাথে করে নিয়ে এসেছে– কথাটা মনে হয় ঠিক হলো না। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডায়রিয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, এর চিকিৎসা নিয়েও চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু কেমন হবে যদি একটি এলাকায় অবস্থানরত সবাই একসাথে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে? এ রোগ তো আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। আক্রান্ত সবাইকে জনে জনে চিকিৎসা করে এ সমস্যার সমাধান হবে না। নিশ্চয়ই সেই এলাকায় এমন কিছু ঘটেছে, যা ডায়রিয়াকে পুরো এলাকায় ট্রিগার করেছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসও চিকিৎসাবিজ্ঞানের সীমানাধীন বহু পুরনো এক রোগ। আর এর সমাধান করতে হলে কেবল ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা যথেষ্ট হবে না, আরও গভীরে পৌঁছাতে হবে আমাদের।
ছত্রাকঘটিত রোগসমূহের জ্ঞানের পরিধি আমাদের কাছে দেহের বিভিন্ন অংশে চুলকানি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তবে এর বাইরেও ছত্রাক জগতে রয়েছে বহু অবাক করা ব্যাপার। পূর্বে ছত্রাককে উদ্ভিদজগতের সাথেই আলোচনা করা হতো, উদ্ভিদের মতো স্বভোজী না হওয়ায় একে পরবর্তীতে আলাদা করে স্থান দেয়া হয় ফাঙ্গাস তথা ছত্রাক জগতে।
নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে সক্ষম নয় এরা, ফলে খাদ্যের জন্য নির্ভর করতে হয় অন্যের উপর। ছত্রাককে আঙ্গিক দিক থেকে বিবেচনায় আনা হলে দু’ধরনের ছত্রাকের দেখা মেলে- ঈস্ট ও মোল্ড। ঈস্ট হলো এককোষী ছত্রাক, আর মোল্ড বহুকোষী। আবার কিছু ছত্রাক এমনও রয়েছে যারা তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের দেহেও পরিবর্তন আনতে সক্ষম। দ্বি-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এ ছত্রাকগুলো পোষকদেহের বাইরে মোল্ড হিসেবে এবং পোষকদেহের ভেতরে ঈস্ট হিসেবে অবস্থান করতে পারে। আমাদের আলোচ্য ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের জন্য দায়ী মিউকর একটি মোল্ড। এর জীবনযাপন পদ্ধতি যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে খুব সহজেই বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
মাটিতে মৃত বস্তুর সারাংশ ভক্ষণ করে বেঁচে থাকা ছত্রাক, উপযুক্ত পোষকদেহ পেলে পোষককোষ থেকেও পুষ্টি আহরণে সক্ষম। তবে আক্রমণের এ পরিধি যে কেবলমাত্র পোষকদেহের ত্বক পর্যন্তই বিস্তৃত, তা কিন্তু নয়। পোষকদেহের ভেতরে উপযুক্ত পরিবেশে সেখানেও কিছু কিছু ছত্রাক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তবে এমন ঘটনা বিরলতম হবার প্রধান কারণ হলো, আমাদের দেহের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
অণুজীববিজ্ঞানের পরিসরে এক শ্রেণির পরজীবীই রয়েছে যারা সুবিধাবাদী। এরা সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু পোষকদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে না বিধায় এরা সেখানে নম্র, ভদ্র, অক্ষতিকর হিসেবে অবস্থান করে থাকে। তেমনি সুযোগের অভাবে সৎ থাকা বেশ কিছু সুবিধাবাদী ছত্রাকও রয়েছে এ তালিকায়। মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী সুবিধাবাদী ছত্রাকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে এগুলোর মাঝে অন্যতম আমাদের আলোচ্য ‘মিউকরমাইকোসিস’-এর জন্য দায়ী ‘মিউকর’ ছত্রাকটি।
একজন মানুষ যখন এইডসে আক্রান্ত হয়ে তার দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ে, তখন চারপাশ থেকে এ সমস্ত সুবিধাবাদী পরজীবীগুলো বাসা বাঁধে মানুষটির দেহে। সামান্য জ্বর, সর্দি, কাশিই ধীরে ধীরে তাকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তেমনটি। পোষকদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর হবার দরুণ মিউকর ছত্রাকটি সুযোগ পেয়ে যায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগ সৃষ্টির।
কিছু ছত্রাক সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষকেও আক্রমণ করতে পারে, সেগুলোকে সুবিধাবাদী বলা যাবে না। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কিংবা চিকিৎসার পরিপ্রেক্ষিতে, যদি কোনো মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় অথবা বিনষ্ট হয়, মানুষটি তখন সুবিধাবাদী ছত্রাকগুলোর সংস্পর্শে আক্রমণের শিকার হতে পারে। যেমন- এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণে সময়ের সাথে একজন মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসতে শুরু করে। আবার যখন কারো জীবন বাঁচাতে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়, তখন ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে তার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়, তা না হলে প্রতিস্থাপিত অঙ্গকেই দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফরেন পার্টিকেল হিসেবে মনে করবে এবং ধ্বংস করতে উঠে-পড়ে লাগবে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে যখন কেমোথেরাপী দেয়া হয় কিংবা স্টেম সেল থেরাপীর প্রয়োজন হয়, তখনও রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি স্থিমিত হয়ে আসে। আর এসমস্ত নানা কারণেই সুবিধাবাদী ছত্রাক, মিউকর সুযোগ পেয়ে যায় এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগ সৃষ্টি করে।
বিরল ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগে কেউ আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে বোঝার উপায়ই থাকে না যে, তিনি মিউকরমাইকোসিস-এ আক্রান্ত। আর এটি এতটাই মারাত্মক যে, খুব অল্প সময়ের ভেতরেই মৃত্যুর দুয়ারে টেনে নিয়ে যেতে পারে পোষককে। হিসেব খুবই সহজ, একজন সুস্থ ব্যক্তির দেহে মিউকর ছত্রাকটি বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে না। কিন্তু যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগেই অকেজো হয়ে আছে, তার দেহে নিজের বিস্তার নিয়ে আর বিশেষ চিন্তা করতে হয় না মিউকরকে।
একটি পোষকদেহের কোথায় আক্রমণ করবে, তা নির্ভর করে ছত্রাকটির প্রবেশপথের উপর। যদি বাতাসের মাধ্যমে নাকে বা মুখে প্রবেশ করে, তবে খুব সম্ভব মিউকর নিজ আস্তানা গাড়বে শ্বসনতন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশে; নাসারন্ধ্র হতে পারে, নাকের সাইনাসে, শ্বাসনালী কিংবা ফুসফুসেও হতে পারে। অর্থাৎ দেহের যেখানে সুবিধা করতে পারে আর কী। আস্তানা গেড়ে নেবার পরের ধাপেই শুরু হবে বিস্তার। রক্তনালীতে আক্রমণে সক্ষম হবার দরুণ খুব সহজেই রক্তের মাধ্যমে অন্যত্র পরিবাহিত হতে পারে মিউকর।
নাক থেকে খুব সহজেই ছত্রাকটি ফুসফুসের দিকে অথবা সাইনাস আর চোখ হয়ে মস্তিষ্কে বিস্তৃত হতে পারে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দ্বিতীয় ঘটনাটি, অর্থাৎ সাইনাস থেকে চোখ হয়ে মস্তিষ্কে বিস্তারের ব্যাপারেই জানা গিয়েছে; চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় রাইনোসেরেব্রাল মিউকরমাইকোসিস। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিংবা কিডনী প্রতিস্থাপনজনিত জটিলতায় এ ধরনের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এছাড়াও ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে ফুসফুসে অথবা নবজাতক শিশু, যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম; তাদের ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্রেও আক্রমণে সক্ষম এই ছত্রাক। এমনকি ত্বকের কোথাও কেটে গেলে সেখান দিয়ে সুস্থ ব্যক্তির দেহে প্রবেশে সক্ষম এটি। এজন্যই ক্ষতস্থান যত দ্রুত সম্ভব পভিডন-আয়োডিন বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্তকরণের চেষ্টা করা উচিত।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সাথে ডায়াবেটিস রোগের বেশ ভালো যোগসাজশ রয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, এমতাবস্থায় দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ যদি অম্লীয় (ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস) হয়ে ওঠে তা ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাও স্থিমিত থাকে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরো একটি চিন্তার বিষয় হলো, স্টেরয়েড থেরাপী। হাতুড়ে ডাক্তারেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে না বুঝে সকল রোগেই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকে। এই স্টেরয়েডের প্রভাবেও দেহে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং প্রতিরক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হয়, যার দরুণ দেহে ছত্রাকঘটিত রোগের আবির্ভাব অস্বাভাবিক কিছু নয়। যারা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে স্টেরয়েড জাতীয় ইনহেলার ব্যবহার করেছেন, তারা দেখবেন আপনার চিকিৎসক আপনাকে ইনহেলার ব্যবহারের পরপরই মাউথওয়াশ কিংবা পানি দিয়ে কুলি করবার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা ভালোমতো মুখ পরিষ্কার না করা হলে স্টেরয়েডের প্রভাবে মুখগহ্বরে ছত্রাকঘটিত রোগ ক্যান্ডিডিয়াসিস হতে পারে। এছাড়া রক্তে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যধিক মাত্রায় আয়রনের উপস্থিতিও ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
এবার আলোচনা করা যাক, কেন কোভিড-১৯ থেকে সদ্য সুস্থ হওয়া মানুষেরাই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে না। করোনাভাইরাস শ্বসনতন্ত্রে উপস্থিত প্রতিরক্ষা আবরণ মিউকাস ঝিল্লী ও রক্তনালীগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে রাখে আগে থেকেই। আর লোহিত কণিকার ভাঙনে রক্তে আয়রনের পরিমাণও বেড়ে যায়। এছাড়াও কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো শুধু যে ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে তা নয়, শ্বসনতন্ত্রে থাকা আমাদের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকেও ধ্বংস করে, যারা এতদিন আমাদের ক্ষতিকর জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করে এসেছে। আর যদি পূর্ব থেকেই ডায়াবেটিস রয়েছে, এমন কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন, তবে তার দেহে ছত্রাকের বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনাও বেশি।
শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ঘাটতি, ডায়াবেটিস, রক্তে উচ্চমাত্রার আয়রন, দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা- সবকিছু মিলিয়ে ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্য খুবই উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় সদ্য কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়া একজন মানুষের দেহে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কিংবা সদ্য সুস্থ হওয়া একজন ব্যক্তির জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখে বিরল এক ছত্রাকঘটিত রোগের কথা কল্পনাতেও আসে না। বলা চলে, মিউকরমাইকোসিসের মূল লক্ষণ প্রকাশ পেতে বেশ দেরিই হয়ে যায়।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হোন বা না হোন, যদি আপনি নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো নিজের মাঝে টের পান, তবে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি করবেন না। আপনার চিকিৎসক ছত্রাকঘটিত রোগ সন্দেহে ল্যাব ডায়াগনোসিসের ব্যবস্থা করবেন:
-
নাকে বা মুখগহবরের উর্ধ্ব তালুতে কালচে দাগ তৈরি হওয়া;
-
নাক হতে কালচে রক্তপাত কিংবা তরল নিঃসরণ;
-
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসা;
-
চোখের নড়াচড়ায় ব্যঘাত ঘটা;
-
মুখ অসাড় হয়ে যাওয়া;
-
চোয়াল নড়াচড়ায় ব্যঘাত ঘটা;
-
বুকে ব্যথা;
-
শ্বাসকষ্ট।
মিউকর ছত্রাকের বিস্তার ঘটে খুবই দ্রুত, আর এই লক্ষণগুলো নিয়ে একজন মানুষ যখন দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, হয়তো ততদিনে অনেকখানি ক্ষতি হয়ে গেছে। যদি চক্ষুকোটর কিংবা চোখে পৌঁছে গিয়ে থাকে, ছত্রাকের বিস্তার রহিত করতে একজন চিকিৎসককে হয়তো রোগীর আক্রান্ত টিস্যু অর্থাৎ চোখ বের করে নিতে হতে পারে। একজন মানুষের জীবন বাঁচানোই তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা শুধুমাত্র যে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য জরুরি তা নয়। সকলেরই উচিত পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা। আর যাদের চিকিৎসায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়, তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। রোগীর দৈহিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই স্টেরয়েড থেরাপীর জন্য একজন মানুষ উপযুক্ত কিনা সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ভরসার কথা হলো, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছোঁয়াচে নয়। তাই বলে নিশ্চিন্ত হবার কিছু নেই যে আপনার-আমার মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছড়াবে না। মোল্ড জাতীয় ছত্রাকগুলোর বংশবিস্তারের মূল হাতিয়ার হলো স্পোর। আগেই বলা হয়েছে যে, একসময় ছত্রাকগুলো উদ্ভিদজগতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উদ্ভিদ বীজের কথা ভাবুন, কোনো গাছের বীজ অন্যত্র উপযুক্ত পরিবেশ পেলে মাটিতে অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে আরেকটি উদ্ভিদ জন্ম দিতে সক্ষম, অর্থাৎ বীজের মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রজাতিটি বংশবিস্তার করতে পারছে। ঠিক একইভাবে ছত্রাকের স্পোরগুলো বংশবিস্তারে সাহায্য করে, উপযুক্ত পরিবেশে মাটিতে কিংবা কোনো পোষকদেহে অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে একই প্রজাতির ছত্রাক জন্ম দিতে পারে।
এই স্পোরগুলো বায়ুবাহিত হয়ে যেকোনো প্রাণীর শ্বসনতন্ত্রে প্রবেশে সক্ষম। স্পোরগুলো অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে সুতার মতো আণুবীক্ষণিক অঙ্গ সৃষ্টি করে যা হাইফা (বহুবচনে হাইফি) নামে পরিচিত, নিরবচ্ছিন্ন বিস্তার ঘটাতে গিয়ে পোষকদেহকে ধ্বংস করতে শুরু করে। আর এ ধ্বংসের মাধ্যমেই ছত্রাক নিজের পুষ্টি গ্রহণ করে থাকে পোষকদেহ হতে। নাসাগহবরে বিস্তারের কারণে নাকের সাইনাসের অস্থি, মুখমন্ডলের অস্থি, চক্ষুকোটরের অস্থি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রক্ত সংবহন বন্ধ করে দেয়ায় সেসব জায়গাতে বিভিন্ন টিস্যু পুষ্টির অভাবে মৃত্যুবরণ করতে শুরু করে। আর এসব মৃত টিস্যুই আমরা বাইরে থেকে কালো রঙের দাগ হিসেবে দেখতে পাই। চিকিৎসা শুরু না হলে এভাবেই একসময় মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় মিউকর আর পোষকদেহকে ঠেলে দেয় মৃত্যুমুখে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সৃষ্টিকারী মিউকর ছত্রাকের স্পোর আমাদের পরিবেশে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, আণুবীক্ষণিক হবার কারণে আমরা তা খালি চোখে দেখতে পাই না। মাস্কের ব্যবহার যদিও কোভিড-১৯ এর দরুণ বেড়েছে, সবাই সচেতন হতে শিখেছে, কিন্তু মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ছিল বহু আগে থেকেই। তাই সঠিক নিয়মে মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই, এটি ধুলাবাহিত ছত্রাক স্পোর থেকেও আমাদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
ছত্রাকঘটিত রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো নির্দিষ্ট ওষুধের ব্যবহার। প্রাণিকোষের কোষ ঝিল্লীতে রয়েছে কোলেস্টেরল, অপরদিকে ছত্রাকের কোষঝিল্লীতে থাকে আর্গোস্টেরল। এখানেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের কারসাজি, ছত্রাকের বিরুদ্ধে কাজ করা ওষুধগুলো এমনভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছে যেন কেবলমাত্র আর্গোস্টেরলের উপর কাজ করতে পারে। এ সমস্ত ওষুধ ব্যবহারে তাই পোষকদেহের কোনোরূপ ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি ড্রাগটি কোষঝিল্লীর আর্গোস্টেরলের সাথে যুক্ত হয়ে পুরো ঝিল্লীই ধ্বংস করতে সক্ষম। অ্যাজল গ্রুপের ড্রাগগুলো তো আরো একধাপ এগিয়ে, ছত্রাকের বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় আর্গোস্টেরল তৈরিই হতে দেয় না এরা। বর্তমানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসায় এই দুটোই ব্যবহার করা হচ্ছে, রোগীপ্রতি আট সপ্তাহ অ্যান্টিফাঙ্গাল থেরাপীর লক্ষ্যে ভারতে তাই এই ড্রাগগুলোর উৎপাদনের পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি যেহেতু বাংলাদেশেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী পাওয়া গেছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত বড় আকারে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চিকিৎসার প্রস্তুতি রাখা।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সম্পর্কিত আলোচনার শেষটা মূলত একটি প্রশ্নের উত্থাপন করে। কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রমণের ‘দ্বিতীয় প্রকোপেই’ কেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আবির্ভূত হলো? কেন একদম শুরু থেকেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমণ দেখা যায়নি? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে সঠিকভাবে দেয়া সম্ভব নয়। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি হয়তো মানবদেহে গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে সক্ষম। তবে এটা কেবলই একটি ধারণা মাত্র, এখনো তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। এটাও হতে পারে, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার কিংবা পাইপগুলোতে ছত্রাক জন্মেছে। আসলে এর নিশ্চিত উত্তর জানতে হলে আক্রান্তদের মাঝে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ এপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডি হওয়া প্রয়োজন, যা এত অল্প সময়ে সম্ভব নয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগের প্রতিকারের চেয়ে বরাবরই প্রতিরোধের জন্য জোরালো মত ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই আসুন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানি, নিজে সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি, এবং স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলি।