পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা বোধহয় নেই যেখানে করোনার ছোঁয়া লাগেনি। দুর্বার বেগে এগিয়ে চলা এই ভাইরাসের থেমে যাবার কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। কিছু দেশ করোনা দমনে সক্ষমতার কথা বললেও সেখানে নতুন করে আবার ভাইরাস হানা দিয়েছে। মনে হচ্ছে না যে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের আগে আমরা একে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। অবস্থা এমনই যে, করোনা এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অংশ হয়ে গিয়েছে।
সারা বিশ্বে করোনা রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৃথিবীর ২১৬টি দেশে ১৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ এই রোগে সন্দেহাতীতভাবে আক্রান্ত। এর সাথে ‘সন্দেহ করা হচ্ছে’ এমন রোগী যোগ করলে তো এই সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যাবে। আর যাদের মধ্যে কোনো লক্ষণ নেই সেরকম রোগী তো হিসেব করাই কষ্টকর।
প্রায় ছ’লাখের মত মানুষ এই পর্যন্ত করোনাতে প্রাণ হারিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কথা চিন্তা করলে এখানে এখন রোগী আগের থেকে দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে এই অঞ্চলের প্রায় ১.২ মিলিয়ন লোক কোভিড-১৯ এ ভুগছে, মারা গেছে ৩০ হাজারের কিছু বেশি। সিংহভাগ রোগী, প্রায় ১ মিলিয়ন, আছে ভারতে। আমাদের বাংলাদেশে পরীক্ষা করা হয়েছে এমন মানুষের মধ্য থেকে প্রায় দুই লাখ করোনা পজিটিভ হয়েছে, আর মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ২,৫০০ মানুষের।
করোনা কী করে ঠেকানো যায় তা নিয়ে সারা বিশ্বে প্রচুর গবেষণা চলছে। এর মাঝে ভাইরাসের পরিবর্তনশীলতা বা মিউটেশন নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন। এর কারণ হলো মিউটেশনের ফলে ভাইরাসের রোগ সৃষ্টিকারী অথবা মৃত্যু ঘটানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না তা পর্যালোচনা করা। তাছাড়া পরিবর্তিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলক ভ্যাক্সিন কতটুকু কার্যকর হবে, ফ্লু-র টিকার মতো প্রতি বছর করোনা ভ্যাক্সিনও আপডেট করতে হবে কি না এসবও তাদের গবেষণার অংশ। ইতোমধ্যেই এই ভাইরাসের নতুন মিউটেশনের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
মিউটেশন
মিউটেশন ব্যাখ্যা করার আগে করোনাভাইরাসের গঠনের একটি বিষয় একটু বলে নেয়া প্রয়োজন। ভাইরাস তার মধ্যে হয় ডিএনএ অথবা আরএনএ বহন করে। করোনাভাইরাস একপ্রকারের আরএনএ বহনকারী ভাইরাস। এর বহিরাবরণের মধ্য থেকে অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূচালো অংশ বের হয়ে এসেছে, যাকে বলা হয় স্পাইক। এই স্পাইক তৈরি হয়েছে আমিষ আর শর্করার মিশেলে (গ্লাইকোপ্রোটিন)। এই সূচালো অংশ দিয়েই করোনাভাইরাস মানবদেহের কোষের গায়ে আটকে যায় এবং এরপর তার রোগবিস্তার শুরু করে। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, গ্লাইকোপ্রোটিনের মাধ্যমে মানবকোষে প্রবেশের এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর ভুলভ্রান্তি আছে, যার ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে থেকে যায়।
এ তো গেল করোনাভাইরাসের কথা। কিন্তু মিউটেশন এখানে কীভাবে কাজ করছে? আমরা জানি, আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজ পরিচালনা করছে শরীরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন রকম প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় পদার্থ। এগুলো তৈরি হয় অ্যামাইনো এসিডের সাহায্যে। সেই অ্যামাইনো এসিড প্রস্তুতির সংকেত আসে জিন থেকে, যেখানে ডিএনএ এবং আরএনএ-ও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোনো কারণে যদি এই সঙ্কেতের উল্টোপাল্টা হয়ে যায় তাহলে মিউটেশনের উৎপত্তি হয়। কখনো কখনো এর ফলে ভুলভাল প্রোটিন তৈরি হয়ে শরীরের নানা ক্ষতি হতে পারে। ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসের ক্ষেত্রে মিউটেশনের মাধ্যমে অনেক সময়েই আরও ভয়ঙ্কর প্রজাতির সৃষ্টি হতে পারে, অথবা ভাইরাস/ব্যাক্টেরিয়া দুর্বলও হয়ে যেতে পারে।
করোনাভাইরাসের মিউটেশন
এক গবেষণাপত্রে মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর বিশ্ববিদ্যালয় আর ইতালিয়ান বায়োটেক কোম্পানি ইউলিসি বায়োমেডের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তারা করোনার মিউটেশনে এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা লক্ষ্য করেছেন। ২০০ রোগীর নমুনাতে পাওয়া আট ধরনের মিউটেশন বিশ্লেষণ করে তারা তিন রকম মিউটেশন মূলত ইউরোপিয়ান রোগীদের দেহে এবং তিন রকম উত্তর আমেরিকার অধিবাসীদের ভেতর দেখতে পেয়েছেন। অনেক গবেষক এই দাবি করেছেন যে এইসব মিউটেশনের ফলে এই ভাইরাসের রোগ বিস্তারের ক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে। যদিও তাদের বিরোধিতা করা লোকের সংখ্যাও কম নয়।
আমেরিকার নিউ মেক্সিকোতে বেটি কর্বারের চালানো এক গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের স্পাইক তৈরি করা জিনগুলোর মধ্যে ১৩টি মিউটেশনের সন্ধান পেয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে, স্পাইকের সাহায্যেই ভাইরাস আমাদের শরীরের কোষে প্রবেশ করে, সুতরাং মিউটেশনের ফলে এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিউ মেক্সিকোর গবেষণাতে বলা হয়েছে, এই মিউটেশনগুলোর একটি চীন থেকে এলেও ইউরোপে প্রথম তা ব্যাপক আকারে দেখা দেয়, এবং বর্তমানে এটিই সারা পৃথিবীতে কোভিড-১৯ এর প্রধান কারণ।
নতুন আশঙ্কা
শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এগন ওজার জানুয়ারি মাস থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, একটি বিশেষ মিউটেশন ইউরোপ আর নিউ ইয়র্কের রোগীদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। মে মাসের ভেতর তিনি তার কাছে আসা শিকাগোর ৯৫ ভাগ নমুনাতেই এই বিশেষ মিউটেশনটি দেখতে পেলেন। যে জিনের পরিবর্তনে এটি হয়েছে সেই অনুসারে এর নামকরণ করা হয় D614G।
সারা পৃথিবী থেকে গবেষকরা করোনাভাইরাসের জেনেটিক সংকেত একটি ডাটাবেসে তুলে দিয়ে থাকেন, যেখানে শতকরা সত্তর ভাগ সংকেত এখন এই মিউটেশন বহন করছে। এটিও ভাইরাসের স্পাইকের তৈরির জন্য কাজ করে থাকে। নিউ মেক্সিকোর চালানো গবেষণাতে দাবি করা হয়েছে, এই D614G ভাইরাসকে আরো নিখুঁতভাবে মানবকোষে ঢুকবার সুযোগ করে দেয়। ফলে আগে রোগ হতে হলে যে পরিমাণ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করা লাগত, এই মিউটেশনের ফলে তার থেকে অনেক কম ভাইরাস প্রয়োজন হবে। শুধু তা-ই না, এর ফলে ভাইরাসের রোগ সংক্রমণের ক্ষমতাও দশগুণ বৃদ্ধি পায়। আরো চারটি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণাতেও বিজ্ঞানীরা একই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন।
মিউটেশনের প্রভাব
আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তবে সব মিউটেশনই আমাদের জন্য ক্ষতিকর নয়। অনেক মিউটেশনের কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই, আবার কোনো কোনো মিউটেশন হয়তো ভাইরাসকে আরো দুর্বল করে দিতে পারে। তবে যেসব মিউটেশন ভাইরাসের স্পাইকের উপর প্রভাব ফেলে সেগুলোর ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা সজাগ দৃষ্টি রাখছেন। কারণ স্পাইকের মাধ্যমেই যেহেতু করোনাভাইরাস রোগ ছড়িয়ে থাকে সুতরাং যদি কোন কারণে এর ক্ষতির সক্ষমতা বেড়ে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য শঙ্কার কারণ হবে।
সৌভাগ্যক্রমে D614G মিউটেশন এই ভাইরাসের রোগ বিস্তারের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিলেও বিজ্ঞানীরা এমন কোনো প্রমাণ পাননি যা থেকে মনে হয় এর ফলে ভাইরাসের প্রাণঘাতী ক্ষমতা বেড়েছে। তদুপরি এখন অনেক বিশেষজ্ঞই D614G এর ব্যাপারে পরীক্ষাগারের ফলাফলে খুব একটা আস্থা রাখতে চান না। তারা মনে করেন, সত্যিকার অর্থে এই নতুন মিউটেশন খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারবে না।
যা-ই হোক না কেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, যদি মিউটেশনের ফলে ভাইরাসের বড় কোনো পরিবর্তন ঘটেই যায়, তবে ভ্যাক্সিন নিয়ে যে কাজ চলছে তাতে সময় আরো বেশি লাগবে। ফলে আরো অনেকদিনই হয়তো নানা বিধিনিষেধ মেনে আমাদের চলতে হবে।