শহুরে রাস্তাঘাটে ইদানিং রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি। কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠান বা যেকোনো বিশেষ দিন উদযাপন বলতেই যেন সবার আগেই চোখ চলে যায় সব নামী দামী রেস্তোরাঁয়। শহর কেনই বা বলছি, গ্রামগঞ্জেও রেস্টুরেন্ট ধরনের ভিন্ন স্বাদের খাবারের দোকানের কমতি নেই বৈকি! যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আজকাল জন্মদিনের অনুষ্ঠান বা বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা কারো পদোন্নতি, যেকোনো সুসংবাদ শুনে সেটাকে উদযাপন করা কেমন জানি রেস্টুরেন্টের খাবার ছাড়া জমেই না বলতে গেলে। এতে একদিকে পকেটের কিছু টাকা খরচা হলেও বাসায় মা-বোনের আয়োজনের ঝামেলাটা একটু মাথা থেকে সরিয়ে তাদের নিয়েই একসাথে কিছুটা সময় বাইরে কাটিয়ে আসার সুযোগ করে দেয় এসব রেস্টুরেন্ট বা পার্টি সেন্টারগুলো।
কিন্তু কখনো কি খেয়াল করে দেখেছেন, আপনার অফিসের খুব কাছের সহকর্মী বা আপনার খুব কাছের বন্ধুটিকে যখনই এমন কোনো পার্টিতে দাওয়াত করেছেন, তখনই সে নানা অজুহাতে দূরে সরিয়ে রেখেছে নিজেকে বা আসি আসি বলেও আসতে পারেনি বলে আপনাকে ফাঁকি দিয়েছে। কেন সে বারবার এমন করে সে আপনার সাথে? তা জানার কৌতূহল কি কখনো জাগেছে আপনার মনে? এর কারণ কিন্তু কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়, মিলিয়ে নিতে পারেন আপনার সেই বন্ধুটির সাথে। তার আগে আমি আমার কাছের একটি ঘটনা জানাই, তাতে আপনার মনের জিজ্ঞাসার উত্তরটা ঠিক পেয়ে যেতেও পারেন।
অঙ্কিত আর শ্রীদাত্রী একই অফিসের দুই সহকর্মী। তারা খুব ভালো বন্ধুও বটে। দুজন তাদের খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো পরস্পর শেয়ার করে, যেকোনো বিপদ-আপদে তারা বেশ পরামর্শ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়। বেশ কিছুদিন যাবত অঙ্কিত লক্ষ্য করছে, তার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সমস্যাটা মূলত পেটে। খুব কাছের কেউ ছাড়া এমন সমস্যা কাউকে শেয়ারও করতে পারছে না সে। কখনো তার পেট ভার, কখনো পেট ঠাসা গ্যাস বা অম্বল, কী মহা মুশকিল! সব সময় পেট নিয়ে কেমন একটা অস্বস্তি ভাব। অফিসের কাজের চাপে খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম তো ছিলই, কিন্তু ইদানিং আগের চেয়ে ক্ষুধাটাও যেন কমে গিয়েছে। এমন সমস্যায় ঠিকমত কাজে মনযোগ দিতেও পারে না বেচারা। তার উপর অফিসের নানা পার্টি, মিটিংয়ের খাওয়া দাওয়াটাও অনেকটা এড়িয়ে চলতে হচ্ছে তাকে। সমস্যাটা যখন কমার চেয়ে আরো বেড়েই চলেছে, ঠিক তখন তার খুব কাছের সহকর্মী শ্রীদাত্রীর সাথে বিষয়টা শেয়ার করলো অঙ্কিত।
আলোচনা করতে গিয়েই জানতে পারলো, সমস্যাটা তার একার নয়, একই পথের পথিক শ্রীদাত্রী নিজেও। পেটের এরকম সমস্যায় ভুগছেন কম-বেশি একালের অনেকেই। সমস্যাটা মূলত পেটের একধরনের ক্রনিক সমস্যা। বলতে গেলে অনেকটা মলের সাথেই সম্পর্কিত। এর একটি বিশেষ নামও রয়েছে- ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস। নামটা বেশ ভারিক্কি নিশ্চয়ই? কিন্তু একটুও মারাত্মক রোগ নয়। এমন রোগের সঠিক কোনো কারণ জানা না গেলেও কিছু কিছু প্রতিরোধ উপায় বাতলে দেওয়া যায়। পেটের এমন সমস্যায় আক্রান্ত রোগী হয় কোষ্ঠকাঠিন্য, নয়তো ডায়রিয়ায় ভুগে থাকেন অথবা দুটোই একসাথে হতে পারে।
কাদের এই রোগে আক্রান্ত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?
মোটামুটি সমীক্ষা করে দেখা গেছে, ২০-৫০ বছর বয়সীদের মাঝেই এই সমস্যার প্রকোপ লক্ষণীয়। পুরুষ-মহিলা ভেদাভেদ করলে দেখা যায়, রোগটিতে বেশিরভাগ মেয়েদেরই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। আনুপাতিক হারে লক্ষণীয় মহিলা ও পুরুষের অনুপাত দাঁড়ায় ৪:১। ইদানীং গড়ে ১০০ জন মানুষের মাঝে কম করে হলেও ৪০ জন খুঁজে পাওয়া যাবে যারা এই আইবিএস-এ আক্রান্ত। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এমন উপসর্গ দেখা দিলে এই রোগের পাশাপাশি অন্য রোগের কথাও মাথায় রাখতে হবে।
কেন হয় এমন রোগ?
- প্রথমত, আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে যদি এমন রোগের ভুক্তভোগী থাকেন, তবে সেক্ষেত্রে আপনার হবার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না, অর্থাৎ বংশগত কারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
- দ্বিতীয়ত, আপনাকে যদি অতিরিক্ত অবসাদগ্রস্থতা বা দুশ্চিন্তা গ্রাস করে থাকে, তবে আপনার পেটের এই সমস্যা হতেই পারে।
- তৃতীয়ত, গ্যাস্ট্রো ইন্টেস্টাইনাল ইনফেকশান, যা কিনা জল, খাবার বা অন্য যেকোনো কারণে পেটের সংক্রমণ থেকে হয়ে থাকে, এ ধরনের ইনফেকশানজনিত কারণেও পেটের এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রোগের উপসর্গগুলো
- লুজ মোশান বা কোষ্ঠকাঠিন্য- এর মাঝে যেকোনো একটি অথবা দুটোই একসাথে হতে পারে।
- সবসময়, বিশেষ করে সকালের সময়টাতে বেশি মনে হতে পারে যে পেট পরিষ্কার হয়নি। সারাদিন এমন অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন।
- অনেক সময় পেটের বাঁ দিকে তলপেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা হতে দেখা যায়। পেট পরিষ্কার হলে এই ব্যথা কমে যায়।
- এই রোগে আক্রান্ত রোগীকে কম করে হলেও তিন মাস যাবত এমন সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন।
- অনেক ক্ষেত্রে খাবার গ্রহণের পর ব্যথা অনুভূত হয় এবং মোশন আসতে পারে।
- ক্ষুধা কমে আসে।
- গলা ও বুকে জ্বালাপোড়া ভাব থাকতে পারে।
- সবসময় পেট ফাঁপা বা পেট ভার হয়ে থাকা ভাব অনুভূত হতে পারে।
- অনেকের আবার বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হয়েও যেতে পারে।
- শরীর সবসময় অবসাদগ্রস্থতায় বা ক্লান্তিতে ছেয়ে থাকতে দেখা যায়।
- এই রোগের চরম পর্যায়ে সাধারণত জ্বর জ্বর ভাব বা মলের সাথে রক্তপাত না হলেও আলাদাভাবে এসব উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ
- আইবিএস আক্রান্ত রোগের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত লক্ষ্য করা যায় না।
- এই রোগে আক্রান্ত রোগী দীর্ঘদিন অস্বস্তিকর জীবনযাপন করে থাকলেও এর থেকে ওজন কমে যাওয়া বা ক্যন্সারের মতো কোনো মারাত্মক কিছু হবার আশঙ্কা নেই।
- দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অনিয়মিত জীবনযাপনের কারণে এই রোগের কিন্তু বার বার ফিরে আসার সুযোগ থেকেই যায়।
যেসব বিষয় এড়িয়ে চলবেন
কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। যদি এ কথা সত্যি বলে মেনে নেন, তবে জেনে রাখুন কী কী বিষয় এই রোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে একেবারেই ‘না’!
- মজার বিষয় হলো, এই রোগে আক্রান্ত রোগীর হঠাৎ করেই ক্ষুধা পায় বা খেতে ইচ্ছা করে। মজার বিষয় হলো, এই ক্ষুধা কিন্তু মোটেও ক্ষুধা পাওয়া নয়। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম হচ্ছে ‘ক্রেভিং’ বা বাংলায় ‘দুষ্টু ক্ষুধা’। সুতরাং ক্ষুধা পেলেই চট করে কিছু খেয়ে ফেলবেন না যেন। তার বদলে পানি পান করুন বা চুইংগাম চিবুতে থাকুন।
- খেতে বসে পেট ঠেসে খাওয়াদাওয়া আপনার জন্য সম্পূর্ণ ‘মানা’। এ কথাটা একেবারেই ভুলে যাবেন না।
- আইবিএস আক্রান্ত রোগীরা কখনোই তাড়াহুড়ো করে খাবেন না। ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে ভালো মতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এতে খাবার হজমে কোনো অসুবিধাই থাকবে না।
- খাবার গ্রহণের মাঝখানে পানি পানের অভ্যাস থাকলে এক্ষুণি তা পরিত্যাগ করুন। খাবারের মাঝে জল গ্রহণ মানেই হলো আপনার হজমে সাহায্যকারী এনজাইম বা উৎসেচক, যা আপনার পরম বন্ধু, তাদের আপনি ধুয়ে দিলেন। তবে আপনার খাবার হজমে গন্ডগোল তো আপনিই বাঁধিয়ে রাখলেন। এক্ষেত্রে উত্তম হলো খাবার গ্রহণের অন্তত আধা ঘন্টা পর জল গ্রহণ করা। এতে আপনার হজমে সমস্যার ধীরে ধীরে উপশম ঘটবে।
- অলসভাবে বেশিক্ষণ কোনো এক জায়গায় বসে থাকবেন না, বারে বারে হালকা হাঁটাহাঁটির অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- রাতের খাবারের পরপরই অনেকের ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আছে। এটা আইবিএস আক্রান্ত রোগীদের জন্য একেবারেই হারাম। রাতের খাবার গ্রহণের অন্তত দুই-তিন ঘন্টা পর শুতে যান। এতে আপনার খাবার ভালোমত হজমের সুযোগ পাবে।
- আইবিএস আক্রান্ত রোগীদের খাদ্য তালিকায় ভাজা-পোড়া, মসলাযুক্ত খাবার, প্রসেস করা খাবার, চা, কফি, চকোলেট, ময়দা, হোয়াইট স্যুগার, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম জাতীয় খাবার, ব্রকলি, পিঁয়াজ সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ এসব খাবার সহজে হজম হতে চায় না।
আইবিএস আক্রান্ত রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- এই রোগের সর্বোত্তম ঔষধ হলো চিন্তামুক্ত থাকা, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গ্রহণ করতে পারেন।
- সারাদিনে বারে বারে হালকা খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- রাতের বেলায় অবশ্যই হালকা খাবার খাবেন।
- বারে বারে অল্প অল্প করে পানি পানের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে বেশি বেশি ফাইবার জাতীয় খাবার গ্রহণ করুন।
- পেট ভরে কোনো খাবার খাবেন না, সাথে চেষ্টা করুন খাবার গ্রহণের মাঝে পানি না পান করে খাবার গ্রহণের আগে এক গ্লাস পানি পান করতে। এতে পেট কিছুটা পানি দ্বারা ভর্তি হয়ে থাকবে এবং খাবার হজমেও সাহায্য করবে।
- খাবারের তালিকায় মাছ, মুরগি, সালাদ, আলু, ভুট্টা, সাইট্রাস জাতীয় ফল- এগুলো রাখার চেষ্টা করুন।
- রাতে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- আইবিএস রোগের সাথে জ্বর, রক্তপাত, ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ এসব লক্ষণ আইবিএস এর না হয়ে অন্য কোনো রোগেরও হতে পারে।
সর্বোপরি, অঙ্কিত বা শ্রীদাত্রীর মতো ভুক্তভোগীদের জন্য যেকোনো অনুষ্ঠানে যোগদান বা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার উত্তম উপায় এর চেয়ে ভাল আর কিছু হতেই পারে না।
ফিচার ইমেজ: askdrnandi.com