বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার: তীব্র আবেগে বিহ্বলতা যখন মানসিক সমস্যা

আচ্ছা ভেবে দেখুন তো, কখনও এমন কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, যখন আপনার মনে হচ্ছিল পায়ের নিচের মাটি বারবার সরে যাচ্ছে, কোনোভাবেই স্থির থাকতে পারছেন না, পরিস্থিতি বারবার ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে আপনাকে, কিছুতেই নিজের চিন্তাভাবনা বা আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না?

কারো ক্ষেত্রে ঠিক এই ব্যাপারটা বারবার ঘটলে, তখন সেটিকে বলা হয় বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা সংক্ষেপে বিপিডি। যাদের বিপিডি রয়েছে, তাদের জন্য সবকিছুই অস্থিতিশীল। তাদের মন-মেজাজ, তাদের সম্পর্কগুলো, তাদের আচরণ, চিন্তাভাবনা এমনকি তাদের নিজেদের পরিচয়- কিছুই তাদের কাছে পরিস্কার নয়। বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের রোগীদের জন্য প্রতিদিন বেঁচে থাকা যেন একেকটা যুদ্ধের মতো। তবে আশার ব্যাপার হলো, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডাররে জন্য বেশ কার্যকর এবং ফলদায়ক চিকিৎসাপদ্ধতি রয়েছে। নিয়মিত মানসিক চিকিৎসা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সহজেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব।

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার কী?

বিপিডি রোগীদের আবেগিক ভারসাম্যহীনতা তাদের সম্পর্কগুলোতে চিড় ধরিয়ে দেয়; Source: heysigmund.com

আপনার যদি বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার থাকে, তাহলে আপনার মনে হবে আপনি সার্বক্ষণিকভাবে একটি রোলার কোস্টারে চড়ছেন। শুধু আপনার আবেগ এবং সম্পর্কগুলোই নয়, বরঞ্চ আপনার নিজেকে নিয়ে আপনার ভাবনাগুলোকেও আপনার খুব খাপছাড়া মনে হবে। আপনার ব্যক্তিত্ব, ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুই ঘন ঘন বদলাতে থাকবে। যাতে করে নিজেকে নিয়েই আপনার মধ্যে একটি অস্পষ্ট ছবি ফুটে উঠবে। আপনি নিজের কাছেই হয়ে উঠবেন একজন অজানা মানুষ।

বিপিডির সকল রোগীই যেকোনো বিষয়ে প্রচণ্ড স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে তারা প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং একবার মন খারাপ হয়ে গেলে সেটি ঠিক করতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, তাদের এই প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ এবং নিজেদেরকে স্থিতিশীল রাখতে না পারার ব্যাপারটি অন্যদের সাথে তাদের সম্পর্কগুলোকে বেশ নড়বড়ে করে তোলে। এ রোগের রোগীরা অধিকাংশ সময়ই অতি আবেগে উদ্বেলিত অবস্থায় থাকে। আর এমন অবস্থায় কাকে কী বলতে হবে বা কী ধরনের আচরণ করতে হবে বুঝতে না পেরে বেফাঁস কাজ অথবা কথা বলে দিয়ে এ নিয়ে নিজেরাই পরে অনুতাপে ভুগতে থাকে। এটি তাদের মানসিক অবস্থা পরে আরো খারাপ করে দেয়।

লক্ষণ এবং শনাক্তকরণ

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে চিকিৎসা এবং শনাক্তকরণের সুবিধার জন্য বিশেষজ্ঞরা এর লক্ষণগুলোকে নয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন। কারো মাঝে বিপিডি শনাক্ত করার জন্য তার মধ্যে এই নয়টি লক্ষণের অন্তত ৫টি থাকতে হবে এবং লক্ষণগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে। এই নয়টি লক্ষণ জানা যাক এবার।

১. নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয়

বিপিডি রোগীদের মাঝে অধিকাংশ সময়ই একা বা নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখা যায়। এমনকি তাদের প্রিয় বা ভালোবাসার মানুষের সামান্য দেরি করে ঘরে ফেরা তাদের মাঝে তীব্র ভয় সৃষ্টি করতে পারে। তারা ভালোবাসার মানুষকে কাছে ধরে রাখার জন্য অদ্ভুত সব কাজ করে থাকে। যেমন, অনুনয় করা, আঁকড়ে ধরে রাখা, ঝগড়া করা, অপ্রকৃতস্থের মতো আচরণ করা ইত্যাদি। এমনকি অনেক সময় তারা কাছের মানুষটিকে সামান্যতম দূরে যেতে দেয় না। অবশ্য এতে করে ফলাফল উল্টোই হয়। তাদের এসব আচরণ ভালবাসার মানুষটিকে তাদের থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়।

প্রিয়জনকে হারানোর ভয় বিপিডি রোগীদের মাঝে তীব্রভাবে কাজ করে; Source: wikihow.com

২. অস্থিতিশীল সম্পর্ক

বিপিডি রোগীদের সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেগুলো হয় গভীর কিন্তু স্বল্পস্থায়ী। এরা খুব সহজেই প্রেমে পড়ে যায়, এবং প্রত্যেককে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকে। এর ফলে এরা খুব সহজেই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়। এদের সম্পর্কগুলো হয় খুব সুন্দর অথবা ভয়ঙ্কর। এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থা এদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এদের কাছের মানুষগুলোকে এদের পরিবর্তনশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব নিয়ে সর্বদা তটস্থ থাকতে দেখা যায়।

৩. নিজেকে নিয়ে অস্পষ্ট ধারণা

কারো যদি বিপিডি থাকে, তাহলে তার নিজেকে নিয়ে নিজের ধারণা খুব অপরিচ্ছন্ন দেখা যায়। মাঝে মাঝে তারা নিজেকে খুব ভালো মনে করে, নিজেকে নিয়ে ভালো অনুভব করে। আবার মাঝে মাঝে তারা নিজেদের খুব হতাশ হয়ে যায়, এমনকি ঘৃণা করতে শুরু করে। তারা নিজেরা কেমন এবং জীবনে কী চায়, এ নিয়ে তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা থাকে না। এর ফলে তাদের চাকরি, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী, ধর্ম, মূল্যবোধ, লক্ষ্য, এমনকি লিঙ্গ পরিবর্তন করতেও দেখা যায়।

বিপিডি রোগীদের নিজেদের নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা থাকে না; Source: deviantart.com

৪. অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা এবং স্ব-ধ্বংসাত্মক আচরণ

বিপিডি রোগীদের মাঝে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ আচরণ দেখা যায়। তাদের যখন মন খারাপ থাকে, তখন তারা যাচ্ছেতাই কাজ করতে থাকে। যেমন, সাধ্যে না কুলানো সত্ত্বেও অতিরিক্ত কেনাকাটা করা, মদ্যপান করা, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো, চুরি করা, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে লিপ্ত হওয়া, অতিরিক্ত মাদকগ্রহণ ইত্যাদি ধরনের কাজে তারা লিপ্ত হয়। এই আচরণগুলো তাদের কিছু সময়ের জন্য শান্তি দিলেও পরবর্তীতে এর জন্য তাদের অত্যধিক মূল্য দিতে হয়।

৫. আত্মহত্যার প্রবণতা ও নিজের ক্ষতি করা

আত্মহত্যার প্রবণতা এবং নিজেকে আঘাত করা বিপিডি রোগীদের মাঝে একটি সাধারণ বিষয়। আত্মহত্যার চেষ্টা সহ তারা অধিকাংশ সময় আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতে থাকে। এছাড়াও তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করা ছাড়াও বিভিন্নভাবে নিজেদের আঘাত করে থাকে। যেমন, হাত-পা কাটা, নিজেকে ছ্যাঁকা দেওয়া, দেওয়ালে ঘুষি মারা, মাথায় আঘাত করা ইত্যাদি।

আত্মহত্যার প্রবণতা এবং নিজেদেরকে আঘাত করা তাদের জন্য নৈমিত্তিক বিষয়; Source: linkedin.com

৬. আবেগীয় ভারসাম্যহীনতা

অস্থিতিশীল আবেগীয় অবস্থাও বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের জন্য একটি স্বাভাবিক বিষয়। যেমন একসময় খুব ভালো অনুভূত হয়, আবার কিছুক্ষণ পরই খারাপ লাগতে থাকে। ছোটখাটো বিষয়, যেগুলো স্বাভাবিক মানুষ সহজেই ঝেড়ে ফেলতে পারে, সেগুলোই বিপিডি রোগীদের মাঝে আবেগের ঝড় তুলে দিতে পারে। এই পরিবর্তনগুলো খুব গভীর হলেও তারা খুব অল্প সময়েই আবার ঠিক হয়ে যেতে পারে।

৭. প্রতিনিয়ত শূন্যতা অনুভব করা

বিপিডি রোগীরা অধিকাংশ সময়ই তাদের একাকিত্ব অনুভব করার কথা বলে থাকে। তাদের সাথে কথা বললে মনে হয়, তাদের ভেতর একটি শূন্যতা পাকাপোক্তভাবে গেঁথে রয়েছে! কোনো কোনো সময় তাদের কাছে নিজেদের একদম অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হয় এবং নিজের মাঝের শূন্যতাকে মনে হতে থাকে ব্ল্যাকহোলের মতো। সেই ব্ল্যাকহোল যেন তখন তাদের আশেপাশের সব অনুভূতিগুলোকে শুষে নিতে থাকে, আর তারা তখন সেই শূন্যতাকে পূরণ করার জন্য মাদক, খাবার, সেক্স ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কোনোকিছুই তাদের কাছে অর্থপূর্ণ মনে হয় না।

৮. ধ্বংসাত্মক রাগ

বিপিডি রোগীদের অল্পতেই রেগে যেতে দেখা যায় এবং তাদের রাগ অত্যন্ত তীব্র হয়। যখন তারা রেগে যায়, সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতেও তাদের বেশ বেগ পেতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই রাগ প্রচণ্ড চিৎকার এবং জিনিসপত্র ভাংচুরের মাধ্যমে শেষ হয়ে থাকে। তবে সবসময় যে এই রাগ বাইরে প্রকাশ পায় তা-ও না, অনেকসময়ই তারা দীর্ঘক্ষণ নিজেদের উপর রেগে থাকে।

একবার রেগে গেলে তারা তাদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে; Source: undepress.net

৯. সন্দেহপ্রবণতা এবং বাস্তবতা থেকে দূরে থাকা

এই রোগীদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই অন্যদের নিয়ে অহেতুক সন্দেহ পোষণ করতে এবং সেগুলো নিয়ে ভীত থাকতে দেখা যায়। যখন তারা তীব্র অবসাদে থাকে, তখন তাদের মাঝে বাস্তবতার কোনো লেশ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা তখন ঘোরের মাঝে চলে যায় এবং নিজেদেরকে নিজের শরীর হতে বিচ্ছিন্ন মনে করতে থাকে।

কেন হয় বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার?

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার হওয়ার কারণগুলো সঠিকভাবে এখনো জানা বা বোঝা যায় না। তবে গবেষকদের মতে রোগটি বেশ কিছু ঘটনা এবং কারণের ফলাফল

জিনগত

যদিও রোগটির জন্য সরাসরি কোনো জিন দায়ী নয়, তবে গবেষকদের মতে, এর বেশ দৃঢ় বংশগতীয় সম্পর্ক রয়েছে। যাদের প্রথম পুরুষের মধ্যে কারো এই রোগটি রয়েছে, তাদের এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্য সাধারণ মানুষের তুলনায় পাঁচগুন বেশি।

শৈশবে বিচ্ছেদের তীব্র কোনো আঘাত থেকে হতে পারে এ রোগ; Source: thecabinbangkok.co.th

পারিপার্শ্বিক পরিবেশ

যেসব ব্যক্তি জীবনে কোনো খুব ভয়ঙ্কর ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছে যেমন, শৈশবে শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন, তাদের মধ্যে এই রোগটি হবার সম্ভাবনা বেশ প্রকট থাকে। এছাড়াও শৈশবে মা-বাবা বা প্রিয় কোনো ব্যক্তি থেকে বিচ্ছেদ এবং প্রচণ্ড অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের স্মৃতি থেকেও রোগটি জন্ম নিয়ে থাকে।

মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা

বিপিডি রোগীদের মস্তিষ্কে অন্যদের মস্তিষ্কের তুলনায় বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। যাদের বিপিডি রয়েছে, তাদের মস্তিষ্ক অন্যদের তুলনায় বেশ সতর্ক থাকতে দেখা যায়। সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়গুলোও তাদের কাছে বেশ জটিল ও ভয়ঙ্করভাবে ধরা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশগুলো আবেগ ও যুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, বিপিডি রোগীদের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলগুলোর মাঝে সংযোগ অন্যদের তুলনায় কিছুটা দুর্বল থাকে।

স্বচিকিৎসা ও নিজেকে স্বাভাবিক রাখা

বিপিডি রোগীদের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাটাতে হয় নিজেদের সাথে যুদ্ধ করে। মানসিক স্থিতিশীলতা খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন বিষয়। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের ভেতরের অস্তিরতাগুলোকে শান্ত করতে পারে, তাদের জন্য বাইরের পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞ এবং মানসিক চিকিৎসকেরা তাই বিপিডি রোগীদের নিজেদের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় আনার জন্য এবং বাইরের পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকেন

১. নিজের মানসিক ঝড়কে শান্ত করুন

বিপিডি রোগীরা তাদের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে থাকে নিজেদের অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতার সাথে যুদ্ধ করে। তাই নিজেদের অনুভূতিগুলোকে মেনে নেওয়া তাদের জন্য একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার, যেহেতু তারা সবসবয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে এ নিয়ে, তারা যা ভাবছে তা কি ঠিক না ভুল! তাই বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, এ ধরনের পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায়টি হচ্ছে, যা আপনার অনুভব হচ্ছে তা মেনে নেওয়া। সোজা কথায় আপনার আবেগটিকে কষ্ট করে দমিয়ে না রেখে সেটিকে স্বীকার করে নিন। মনে রাখবেন, আপনি আপনার আবেগটিকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, এর মানে এই না যে আপনি কাজটি করে ফেলছেন। যখনই আপনি আপনার নিজের সাথে যুদ্ধ করে দেওয়া বন্ধ করে দেবেন, তখনই আপনার মানসিক চাপ অনেকটা হালকা হয়ে যাবে। নিজেকে অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে শান্তভাবে নিজের আবেগকে পর্যবেক্ষণ করার এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় মাইন্ডফুলনেস টেকনিক। নিজের মানসিক ঝড়কে শান্ত করার জন্য পদ্ধতিটি বেশ কার্যকরী।

নিজের মনের কথা শুনুন; Source: wikihow.com

  • প্রথমে নিজের আবেগ এবং অনুভূতিগুলোকে একজন বাইরের মানুষ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করুন।
  • আবেগগুলোকে তাদের নিজেদের মতো আসতে-যেতে দিন।
  • নিজের শারীরিক অনুভূতিগুলোর উপর বেশি মনোযোগ দিন।
  • নিজেকে বারবার বলতে থাকুন, আমি এখন যা অনুভব করছি সেগুলো আমি মেনে নিচ্ছি।
  • নিজেকে এটিও মনে করিয়ে দিন, আপনি এখন কিছু অনুভব করছেন, তার মানে এই না যে এটাই বাস্তবতা।

২. আবেগপ্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ এবং সহ্য করতে শিখুন

বিপিডি রোগীদের জন্য নিজেদের আবেগীয় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং যখনই এটি ঘটে, তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলতে থাকে এবং একপর্যায়ে অপ্রকৃতিস্থের মতো আচরণ করা শুরু করে। এক্ষেত্রে একটি কার্যকর উপায় হচ্ছে নিজের এই আবেগের ভারসাম্যহীনতাটিকে সহ্য করে ফেলতে শেখা। প্রতিটি আবেগের জন্যই যে প্রতিক্রিয়া দেখানো প্রয়োজন নেই, এটি ধীরে ধীরে বুঝে ফেলতে পারলেই আবেগিক ভারসাম্যহীনতাটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। একবার আবেগীয় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পর বেশ কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মাধ্যমেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা সম্ভব। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে এমন-

  • একটি নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করুন এবং সেখানে শান্তভাবে বসুন।
  • নিজের শারীরিক অনুভূতিগুলোর উপর মনোযোগ দিন। আপনি যেখানে বসে আছে সেটিকে অনুভব করুন, আপনার হাত-পা কোন অবস্থানে আছে সেগুলোও অনুভব করুন।
  • সবশেষে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিন। ধীরে ধীরে দম নিন, ধীরে ধীরে দম ছাড়ুন। এভাবে বেশ কয়েকবার করুন।

অস্থিরতাগুলোকে সহ্য করতে শিখুন; Source: thecut.com

দেখবেন আপনার অস্থিরতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। আর যদি এতেও কাজ না হয়, তাহলে প্রয়োজনে নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত করে ফেলুন। নিজের পছন্দের কাজ করুন। বই পড়ুন, টিভি দেখুন অথবা নিজের কোনো প্রিয় বন্ধুকে ডেকে এনে তার সাথে আড্ডা দিন।

৩. আপনার আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতাগুলোকে উন্নত করুন

বিপিডি রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের ক্ষেত্রে অন্ধ থাকে। তারা নিজেদের দোষগুলোকে খুঁজে পায় না। তার করা কাজগুলোই যে তার অবস্থা দিন দিন খারাপ করছে সেগুলো সে বুঝতে পারে না। তাই নিজের অবস্থা ভালো করতে চাইলে প্রথমেই নিজের কাজগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। কাজ করে ফেলা বা কিছু বলে ফেলার পর ভাবলে চলবে না। প্রতিটি কাজ করার আগে বা কিছু বলার আগে নিজেকে ভেবে নিতে হবে। নিজের কর্মকাণ্ডগুলোর দায়ভার নেওয়া শিখতে হবে। আর এজন্য-

নিজের ভাবনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করুন

কারো সম্পর্কে বা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে বিকল্প রাস্তাগুলোও চিন্তা করুন। সবসময় আপনি যেটা ভাবছেন সেটিই যে ঠিক হবে, তা যে সত্য নয় এটা বোঝার চেষ্টা করুন। কারো সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাইলে ব্যক্তিটিকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে নিন।

কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করুন

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আবেগের বশে কোন কাজ করে ফেললে বা কিছু বলে ফেললে সেটি নিয়ে পরে অনুতাপ করতে হয়। তাই হুটহাট কোনো কাজ করে ফেলার আগে নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করুন- আমি কি নিজের উপর রেগে আছি? আমি কি লজ্জা অথবা ভয় পাচ্ছি? আমি কি একা হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছি?
যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে কাজটি করা থেকে আপনি বিরত থাকুন। নিজেকে শান্ত করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিন।

নিজের কাজের দায়ভার নিন

এগুলোর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি সেটি হলো, নিজের কর্মকাণ্ডের দায়ভার স্বীকার করা। নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনার সম্পর্কগুলোতে যে সমস্যাগুলো হচ্ছে সেখানে আপনার ভূমিকা কতটুকু। আপনি যে কাজগুলো করছেন বা কথাগুলো বলছেন, তাতে আপনার প্রিয় মানুষগুলো কেমন অনুভব করছে সেগুলোকে বোঝার চেষ্টা করুন। এবং একবার ভুলগুলো বুঝতে পারলে সেগুলোকে স্বীকার করে নিতে শিখুন এবং নিজেকে এর জন্য অতিরিক্ত দোষ না দিয়ে প্রিয়জনদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলুন।

আপনার অসুবিধাগুলো নিয়ে কাছের মানুষদের সাথে আলোচনা করুন; Source: hrmagazine.co.uk

চিকিৎসা ও প্রতিকার

নিজে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও, সম্পূর্ণভাবে বিপিডি থেকে পরিত্রাণের জন্য মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও এ রোগ থেকে বের হয়ে আসার জন্য কাছের মানুষদেরও প্রচুর সহযোগীতা প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে আশার ব্যপার হচ্ছে, অন্যান্য যেকোনো মানসিক রোগের তুলনায় বিপিডি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আসা রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। নিয়মিত কাউন্সেলিং, নিজের এবং পরিবারের কাছের মানুষদের সহযোগিতায় বিপিডি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব। তাই আপনার যদি মনে হয়ে থাকে আপনি এই সমস্যাটিতে ভুগছেন, তাহলে ঘাবড়ে না গিয়ে কোনো মনোচিকিৎসক এবং নিজের কাছের মানুষদের সাথে কথা বলুন। মনে রাখবেন, আমাদের মনও শরীরের মতোই আমাদের মানবসত্ত্বার অংশ, তাই শরীরের যত্নের সাথে সাথে আমাদের নিয়মিত মনের যত্নও নেওয়া প্রয়োজন।

ফিচার ইমেজ: wikihow.com

Related Articles

Exit mobile version