জীবনের নানা ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে আমাদের মন কখনো ভালো, কখনো বা খারাপ থাকে। ছোটখাটো মন খারাপের ঘটনা আমাদের জীবনে অহরহ ঘটে। এতে আমরা খানিকটা বিষন্ন হই, খানিকটা বিরক্ত হই। কিছুক্ষণ পর সব ভুলে আবার আমরা এই সুন্দর পৃথিবীর প্রেমে পড়ি, আবারও জীবনকে উপভোগ করতে শুরু করি। কোনো দিন একটু বেশি মন খারাপ হলে তার জন্য হয়তো আমাদের একটি দিন পন্ড হয়, কাজকর্মের গতি কমে যায়।
একটু উদাস লাগে, জীবন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন এসে মাথায় ভিড় করে। তারপর একসময় মনের মেঘ কেটে গিয়ে সেখানে ঝকঝকে রোদ ওঠে। জীবন আবারও স্বাভাবিক গতিতে চলতে শুরু করে। কিন্তু মনটা যখন একটানা দীর্ঘদিন (দুই সপ্তাহের বেশি) দীর্ঘসময় ধরে খারাপ থাকে, তখন সেই অবস্থাকে বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন বলা হয়। যা একটি বহুল পরিচিত ও আলোচিত মানসিক রোগ। হতাশার ঘোরে সীমাহীন শূন্যতার মাঝে মনটা তখন ডুবতে থাকে।
থেমে যায় জীবন, বদলে যায় চেনা বিশ্ব চরাচর। প্রিয় কাজগুলোতেও তখন মনোযোগ দেয়া যায় না, প্রিয় গানগুলো অসহ্য লাগে। অন্তহীন নীল বেদনার পাহাড় জমতে থাকে বুকের গভীরে। অতলান্তিক এই বিষন্নতা থেকে আমাদের যে বিষয়গুলো তুলে আনতে পারে, ফিরিয়ে দিতে পারে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাইকোথেরাপি এবং বিশেষ কিছু মেডিকেশন তথা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট। আজকের লেখার বিষয় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট মূলত কী, কীভাবে কাজ করে, এর রকমফের এবং এটি গ্রহণের পাশ্বপ্রতিক্রিয়া।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট কী?
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট মূলত এক ধরনের ওষুধ যা মাঝারি থেকে তীব্র ধরনের বিষন্নতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সাধারণত সাইকোথেরাপির পাশাপাশি অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট গ্রহণ করতে বলা হয়। মৃদু বিষন্নতার ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি বিশেষ কাজে না আসলে তখনই মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট প্রেসক্রাইব থাকেন।
বিষন্নতা ছাড়াও জেনারাইলড এনজাংটি, পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD), ওসিডি, প্যানিক অ্যাটাকস, বাইপোলার ডিজঅর্ডার প্রভৃতি রোগের চিকিৎসায়ও সমান কার্যকরী।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট কীভাবে কাজ করে?
মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতাকে বিষন্নতার জন্য দায়ী ভাবা হয়। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে একে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে এসে বিষন্নতার লক্ষণসমূহ দূর করে থাকে। নিউরোট্রান্সমিটার হচ্ছে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে সিগন্যাল আদান প্রদানে সহায়তা করে। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট কীভাবে কাজ করে তা জানতে হলে আগে আপনাকে জানতে হবে নিউরোট্রান্সমিটার কীভাবে কাজ করে।
নিউরোট্রান্সমিটারের কাজ করার জন্য দুইটি নিউরন (প্রিসিন্যাপটিক ও পোস্টসিন্যাপটিক) এবং দুই নিউরনের মধ্যবর্তী একটুখানি ফাঁকা জায়গা যাকে সিন্যাপটিক ক্লেফট বলে (প্রিসিন্যাপটিক নিউরন, পোস্টসিন্যাপটিক নিউরন এবং সিন্যাপটিক ক্লেফট মিল গঠিত হয় একেকটি সিন্যাপস) প্রয়োজন হয়। পোস্টসিন্যাপটিক নিউরনে কতগুলো রিসেপ্টর থাকে। নিউরোট্রান্সমিটার প্রিসিন্যাপটিক নিউরন থেকে ক্ষরিত হয়ে প্রথমে সিন্যাপটিক ক্লেফটে অপেক্ষা করে এবং পরে পোস্টসিন্যাপটিক নিউরনের রিসেপ্টরে সংযুক্ত হয় (বারবার খটমটে শব্দগুলো ব্যবহার না করে আমরা প্রিসিন্যাপটিক নিউরনকে প্রথম ও পোস্টসিন্যাপটিক নিউরনকে দ্বিতীয় নিউরন বলবো)। ফলে কোনো সিগন্যাল প্রথম নিউরন থেকে দ্বিতীয় নিউরনে প্রবাহিত হয়।
কখনো কখনো প্রথম নিউরন থেকে ক্ষরিত নিউরোট্রান্সমিটার দ্বিতীয় নিউরনের রিসেপ্টরে সংযুক্ত না হয়ে প্রথম নিউরনে ফিরে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রিআপটেক’। বেশির ভাগ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট নির্দিষ্ট কোনো নিউরোট্রান্সমিটারের রিআপটেককে বাধা দেয় এবং মন মেজাজে পরিবর্তন আনে।
বিষন্নতার সাথে জড়িত নিউরোট্রান্সমিটারগুলো হচ্ছে সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং নরএপিনেফ্রিন। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সাধারণত এভাবেই কাজ করে। বিশেষ বিশেষ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ঠিক কীভাবে কাজ করে তা আমরা পরবর্তী অংশে জানবো।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের প্রকারভেদ
বিশ্বে মোটামুটি ৫ ধরনের অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
১. SSRIs
SSRI বা Selective Serotonin reuptake inhibitor পৃথিবীতে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট। বিষন্নতা সারাতে এটি বেশ কার্যকরী। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অন্যান্য অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের তুলনায় এর পাশ্বপ্রতিক্রিয়া সবচেয়ে কম। SSRIs প্রথম নিউরনে সেরোটোনিনের ফিরে যাওয়া বা রিআপটেককে বন্ধ করে দেয়। ফলে দুটি নিউরনের মাঝের ফাঁকা জায়গায় সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়ে, সেরোটোনিন সহজেই দ্বিতীয় নিউরনে সংযুক্ত হতে পারে। ফলে মস্তিষ্কে সিগন্যাল আদান প্রদান সহজ হয় এবং মন মেজাজ ফুরফুরে থাকে।
সবচেয়ে প্রচলিত SSRIs এর মধ্যে রয়েছে ফ্লুক্সেটিন, সারট্রালিন প্রভৃতি।
এই ওষুধটি গ্রহণের ফলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঘাম, ইনসমনিয়া, মাথা ঘোরা, দুশ্চিন্তা প্রভৃতি পাশ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
২. SNRIs
Serotonin and Noradrenaline Reuptake Inhibitor বা SNRIs এর কাজের ধরন মোটামুটি SSRIs এর মতোই। এরা সেরোটোনিন ও নরএপিনেফ্রিন (নরঅ্যাড্রেনালিন) রিআপটেকে বাধা দেয় এবং বিষন্নতা দূর করে আপনাকে ঝকঝকে হাসিমুখ উপহার দেয়। এর উদাহরণ ডুলোক্সেটিন, ভেনলাটাক্সিন ইত্যাদি। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া SSRIs এর মতোই।
৩. TCAs
Tricyclic Acid (TCAs) এর ব্যবহারের ক্ষেত্র বেশ ব্যাপক। এটি বিষন্নতা তো বটেই, ফাইব্রোমায়ালজিয়া, দুশ্চিন্তা এবং দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ইনসমনিয়া, পেটে খিঁচুনি, বমি বমি ভাব, অরুচিসহ অসংখ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বলে খুব কমই এই ওষুধ বিষন্নতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। প্রচলিত TCAs হচ্ছে এমাইট্রিপলিন, ইমিপ্রামিন, ট্রিমিপ্রামিন ইত্যাদি।
৪.MAOIs
SSRIs ও SNRIs কাজ না করলে ডাক্তার Monoamine Oxidase Inhibitor (MAOIs) প্রেসক্রাইব করে থাকেন। মস্তিষ্কে মনোঅ্যামিন অক্সিডেজ নামের একটি এনজাইম থাকে যা মনোঅ্যামিন যৌগ যেমন সেরোটোনিনকে ভেঙে ফেলে। MAOIs এই এনজাইমের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করে এবং সেরোটোনিনকে ভাঙনের হাতে থেকে রক্ষা করে। ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম সহজেই চলতে থাকে। এই ওষুধ সেবনে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো শরীরে পানি জমা, ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, খিঁচুনি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, হাইপোটেনশন প্রভৃতি।
৫.অ্যাটিপিক্যাল অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট
এরাও বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে বিষন্নতা কমিয়ে থাকে। এদের উদাহরণ হিসেবে বুপ্রোপিয়ন, নেফাজোডন এর নাম বলা যায়। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট কাজ করতে কমপক্ষে ২ সপ্তাহ সময় নেয়। আপনি যদি বিষন্নতায় ভোগেন। তাহলে সেই দুই সপ্তাহ ধৈর্য ধরে ওষুধ খেয়ে যান, মন মেজাজের পরিবর্তন আপনি নিজেই টের পাবেন।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সাধারণত তিন থেকে ছয় মাস খেতে হয়। তবে বারবার বিষন্নতা আক্রান্ত হলে কয়েক বছর ধরেও খেতে হতে পারে। ওষুধের সাথে সাথে সাইকোথেরাপি নেয়া বিষন্নতার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। গর্ভাবস্থায় SSRIs সেবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এতে বাচ্চার ওজন কমে যেতে পারে, বাচ্চা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে, এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ৮ শতাংশ গর্ভবতী মায়েরা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট সেবন করে থাকেন।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ইতিহাস
১৯৫০ এর দশকে প্রথম কোনো রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সময়ে দুটি বিশেষ শ্রেণির অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট আবিষ্কৃত হয়। MAOIs ক্যাটাগরির ওষুধ ইপ্রোনিয়াজিভ যক্ষ্মার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। আর TCAs ক্যাটাগরির ইমিপ্রামিন ব্যবহৃত হয় মনো-সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে। ১৯৮০’র দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয় SSRIs তথা fluxetine। এরপরের কয়েক দশকে ওষুধ হিসেবে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণে।