সেরিব্রাল পালসি কী?
সেরিব্রাল পালসিকে অনেকেই রোগ বলে অভিহিত করলেও এটি আসলে কোনো রোগ বা অসুস্থতা নয়। ‘Cerebral’ শব্দের অর্থ ‘মস্তিষ্ক’ ও “Palsy” শব্দের অর্থ ‘অবশভাব’। ফলে এর সম্মিলিত অর্থ দাঁড়ায়, “মস্তিষ্কের অবশভাব” বা “মস্তিষ্কের অবশ হয়ে পড়া”। এটি একধরনের স্নায়বিক ভারসাম্যহীনতা, যা শিশুদের মস্তিষ্ক গঠনের সময় আঘাতজনিত কারণে বা স্নায়ুকোষের ঠিকমতো কাজ না করার কারণে ঘটে থাকে।
আমাদের মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ অংশ রয়েছে, যা দেহের চলন ও নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। জন্মের আগে, পরে কিংবা খুব অল্প বয়সে এই অংশগুলো আঘাত পেলে পেশিগুলো মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ থেকে ভুল সংকেত পায়, যার কারণে সেগুলো অত্যন্ত দৃঢ় বা শিথিল হয়ে পড়ে। এটি একধরনের ক্রনিক চাইল্ডহুড ডিজ্যাবিলিটি, যার তীব্রতা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
Autism and Developmental Disabilities Monitoring Network (ADDM) এর এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বিশ্বের প্রতি ৩২৩টি জীবিত শিশুর মধ্যে একজন সেরিব্রাল পালসি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বা জন্মের পর সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়। আরেক সমীক্ষার তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭,৬৪,০০০ জনগণ এই সমস্যায় ভুগছেন।
সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশু সাধারণত নিজে নিজে উঠে বসতে পারে না, এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্মগুলোও নিজে নিজে করতে পারে না। যেসব কারণে শিশুরা প্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে ওঠে, তাদের মধ্যে সেরিব্রাল পালসি অন্যতম।
সেরিব্রাল পলসির ধরন
মস্তিষ্কের কোন অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে সেরিব্রাল পালসিকে চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়। এগুলো হলো:
১. স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পালসি: সেরিব্রাল পালসির প্রকরণগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে সাধারণ (প্রায় ৯১ শতাংশ)। সেরিব্রাল কর্টেক্সে আঘাতের ফলে এটি দেখা দেয়। আক্রান্ত শিশুর মাংসপেশি শক্ত এবং দুর্বল থাকে, শরীরের অঙ্গপ্রতঙ্গ ধীর হয়ে যায়, অস্বাভাবিক দেখায়। তাদের হাত, পা, মাথা ধরে রাখতে দেখা যায়।
২. অ্যাথিটয়েড বা ডিসকাইনেটিক সেরিব্রাল পালসি: ব্যাসাল গ্যাংগ্লিয়ায় আঘাতের ফলে এটি দেখা দেয়। আক্রান্ত শিশুর মাংসপেশি খুব দ্রুত শক্ত হয়ে ওঠে, হাতে-পায়ে অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি দেয়। জিহ্বা ও কণ্ঠনালি নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হওয়ায় এদের কথা বলতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
৩. আটাক্সিক সেরেব্রাল পালসি: সেরিব্রাল পালসির প্রকরণগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিরল। সেরেবেলামে আঘাতের ফলে এটি দেখা দেয়। আক্রান্ত শিশুর চলাফেরা ও ফাইন মোটর স্কিলে সমস্যা দেখা যায়।
৪. মিক্সড সেরেব্রাল পালসি: এটি বিভিন্ন প্রকার সেরিব্রাল পালসির সমন্বয়; যদিও স্প্যাস্টিক ও অ্যাথিটয়েড এই দুই প্রকারের সমন্বয়ই বেশি দেখা যায়।
এছাড়াও শরীরের কোন অংশটি আক্রান্ত হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পালসিকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো:
ক. মনোপ্লেজিয়া: কেবল একটি হাত কিংবা একটি পা-ই আক্রান্ত হয়; বাকি অংশগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।
খ. ডাইপ্লেজিয়া: দুটো পা বা দুটো হাত সমানভাবে আক্রান্ত হয়, কিন্তু অন্যপাশ স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।
গ. হেমিপ্লেজিয়া: শরীরের একই পাশের (শুধু বাম অথবা ডান পাশ) হাত ও পা আক্রান্ত হয়; কিন্তু অন্যপাশ স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।
ঘ. কোয়াড্রিপ্লেজিয়া/টেট্রাপ্লেজিয়া: দুই পা এবং দুই হাত, এই চারটি অঙ্গই সমানভাবে আক্রান্ত হয়।
কারণ
ঠিক কী কারণে বাচ্চাদের মধ্যে সেরিব্রাল পালসি দেখা দেয়, তা এখন পর্যন্ত অজানা। তবে গর্ভাবস্থায় বা জন্মের সময় বা জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে মস্তিষ্কের আঘাত বা ক্ষতকেই এর মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। চিকিৎসকদের মতে, প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থায় মস্তিষ্কের আঘাত শিশুকে সেরিব্রাল পালসির দিকে ঠেলে দেয়।
তিনটি সময় অনুযায়ী এর কারণগুলোকে ভাগ করা যায়:
জন্মের আগে
- গর্ভাবস্থায় প্রসূতি অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করলে কিংবা প্রয়োজনীয় ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ না করলে।
- গর্ভাবস্থায় প্রসূতির বিভিন্ন অসুস্থতা থাকলে। যেমন: হাম, অনিয়ন্ত্রিত বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ, ভাইরাস জ্বর ইত্যাদি।
জন্মের সময়
- অপরিণত অবস্থায় শিশু ভূমিষ্ট হলে।
- প্রসবের সময় সময় মস্তিষ্কে আঘাত পেলে।
- জন্মের পর শিশুটি স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারলে।
- শিশুটি তীব্র জন্ডিসে আক্রান্ত হলে।
পরবর্তী সময়ে
- মস্তিষ্কের সংক্রমণজনিত ব্যধিতে আক্রান্ত হলে। যেমন: মেনিনজাইটিস।
- কোনো দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেলে।
- কোনো রোগ বা সংক্রমণের কারণে (জ্বর বা ডায়রিয়ায়) শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়লে।
অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর
রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ফলেও (যেমন চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো, খালাতো বোন-ভাইয়ের মধ্যে বিয়ে) তাদের বাচ্চা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এছাড়াও বাবা এবং মায়ের রক্তের গ্রুপ একই হলে অনাগত শিশুর সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
লক্ষণ
শিশুর প্রথম তিন বছরের মধ্যেই সেরিব্রাল পালসির লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করে। এটি শরীরের যেকোনো অঙ্গকে আক্রমণ করতে পারে। মস্তিষ্কের আঘাতের প্রকৃতি ও মাত্রার ওপর রোগটির তীব্রতা নির্ভর করায় প্রত্যেক শিশুর ক্ষেত্রে এর উপসর্গগুলো একই রকম না-ও হতে পারে। তবে যেসব লক্ষণ মোটামুটি আক্রান্ত সকল শিশুর মধ্যে দেখা যায় সেগুলো হলো:
মাংসপেশির অস্বাভাবিক গঠন: আক্রান্ত শিশুর পেশীর গঠন অধিক শক্ত বা শিথিল হতে দেখা যায়। পেশীর গঠনের এই অসামঞ্জস্যতার জন্যই আক্রান্ত শিশুদের হাত-পা কুঁকড়ে যায়, অনিয়মিত পেশীর সঙ্কোচন ঘটে এবং ক্রমাগত কাঁপতে থাকে। এর ফলে কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা, বসে থাকা বা দাঁড়ানো কোনোটাই সম্ভব হয় না।
দুর্বল ভারসাম্য: আক্রান্ত শিশুদের দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা হয়। শিশুরা যখন বসতে শেখে বা উঠে দাঁড়ায় বা হামা দেয় বা হাঁটতে শেখে তখন এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দুর্বল গ্রস মোটর ফাংশন: স্থূল পেশীর প্রয়োজন পড়ে, এমন কাজ করতে রোগীদের অসুবিধা হয়। যেমন- হামাগুড়ি দেওয়ার সময় একদিকে হেলে থাকা, ছয় মাস বয়সে পেরিয়ে যাবার পরেও বসতে না শেখা, অথবা ১২-১৮ মাসের পরেও হাঁটতে না পারা, এগুলো সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ হতে পারে।
দুর্বল ফাইন মোটর ফাংশন: সূক্ষ্ম পেশীর সঞ্চালনকে ফাইন মোটর ফাংশন বলা হয়। এতে শারীরিক ও মানসিক দুয়েরই সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন হয়। আক্রান্ত শিশুরা ফাইন মোটর ফাংশন সংক্রান্ত কাজ; যেমন- লেখা, দাঁত মাজা বা জুতো পরা, এগুলো করতে পারে না।
দুর্বল ওরাল মোটর ফাংশন: আক্রান্ত শিশুর ওরাল মোটর ফাংশন ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ, কথা বলা ও খাদ্য চর্বনে তাদের অসুবিধা দেখা দেয়।
রোগনির্ণয়
সেরিব্রাল পালসি নির্ণয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতি নেই। সাধারণত মেডিক্যাল হিস্ট্রি এবং শারীরিক কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর সেরিব্রাল পালসি হয়েছে কি না সেটি নির্ণয় করা হয়। রোগনির্ণয়ের সময় চিকিৎসক শিশুর অভিব্যক্তি, পেশির গঠন, অঙ্গভঙ্গি, পেশির সঞ্চালন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, যেগুলো জন্মের প্রথম কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে, তা পরীক্ষা করেন।
সেরিব্রাল পালসি পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করতে আরো কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। এগুলো হলো এমআরআই স্ক্যান, আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান, সিটি স্ক্যান, ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম (ইসিজি), ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাম (ইএমজি) এবং ব্লাড টেস্ট।
অনেক শিশুর ক্ষেত্রে জন্মের প্রথম বছরের মধ্যেই রোগটি ধরা পড়ে। আবার অনেক সময় মৃদু সেরিব্রাল পালসি শনাক্ত করতে ৩-৪ বছর লেগে যায়। যদি শিশুটি নির্ধারিত সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হয়, সেক্ষেত্রে এমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কে কোনো আঘাত রয়েছে কি না সেটি বোঝা যায়।
অনেক সময় জন্মের পরপরই শিশুটি অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে উপসর্গগুলোর ধরন এবং মাত্রার পরিবর্তন ঘটতে পারে। তাই চিকিৎসকের যদি মনে হয় শিশুটির সেরিব্রাল পালসি হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেক্ষেত্রে জন্মের একেবারে প্রথম থেকেই পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
চিকিৎসা
সেরিব্রাল পালসি থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠবার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে এই রোগের উপসর্গগুলো যাতে রোগীর পরবর্তী জীবনকে প্রতিবন্ধকতাময় করে রাখতে না পারে, সেজন্য শিশুর অভিভাবকের একটু সদিচ্ছা এবং সচেতনতাই যথেষ্ট। কেননা শিশুর বেড়ে ওঠার সময় কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে, সেটি তারাই প্রথম চিহ্নিত করতে পারেন। তাই এমন কোনো পরিস্থিতি দেখা দিলে শিশুর বাবা-মায়ের উচিত কোনোরকম দেরি না করে পেডিয়াট্রিসিয়ান বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে এই বিষয়ে অবগত করা।
সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় পেডিয়াট্রিসিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পীচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, অক্যুপেশনাল থেরাপিস্ট, বিশেষ ধরনের শিক্ষক এবং মানসিক চিকিৎসক সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়ে।
থেরাপি
ফিজিওথেরাপি: ফিজিওথেরাপির মূল উদ্দেশ্য হলো রোগীর শারীরিক সামর্থ্য বজায় রাখা এবং চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতা দূর করা। এ থেরাপির অংশ হিসেবে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট শিশুকে কিছু শারীরিক ব্যায়াম শিখিয়ে দেন, যা তার পেশিকে মজবুত করে তোলে।
স্পিচ থেরাপি: একজন স্পিচ থেরাপিস্ট শিশুকে কথাবার্তার বিকল্প পদ্ধতি, যেমন আকার-ইঙ্গিত, ইশারা, ছবি কিংবা সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে শিখিয়ে দেন। এক্ষেত্রে শিশু বিশেষ কিছু যন্ত্র, যেমন- টেপরেকর্ডার অথবা ভয়েস সিন্থেসাইজার ব্যবহার করতে পারে।
অক্যুপেশনাল থেরাপি: এই থেরাপির মাধ্যমে শিশুর প্রতিদিনকার কাজ (যেমন- খাওয়া, জামা কাপড় পরা, টয়লেটে যাওয়া) করতে কী কী অসুবিধা হয় তা চিহ্নিত করে তা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করা হয়।
কাউন্সেলিং: একজন কাউন্সিলার বা সাইকোলজিস্ট শিশু ও তার পরিবারের সাথে এই সব অক্ষমতার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।
বিশেষভাবে তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থা: অক্ষমতা বা মানসিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত শিশুদের শেখানোর জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো:
১) শিশু স্বাস্থ্য সমস্যা ও তার প্রতিকার
২) মা ও শিশু : স্বাস্থ্য ও অধিকার