অনিদ্রা আপনার শরীর, মনমানসিকতা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্যের উপর কতটা কুপ্রভাব ফেলে তা কি আপনি জানেন? পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য খুব দরকার। এক আধ দিন আপনি যদি কোনো কারণে ঘুমাতে না পারেন বা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে সেটাকে অনিদ্রা বলা যায় না। এটি খুবই গুরুতর একটি রোগ এবং আপনার জন্য বেশ ক্ষতিকর হতে পারে। তবে রাতের পর রাত ঘুম আসছে না বা অনিদ্রায় ভুগছেন বলে কিন্তু নিয়মিত ঘুমের ওষুধ সেবনের মতো ভুল করবেন না। কারণ এতে করে সমস্যার শুধু সাময়িক সমাধানই হবে আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই! তাই ঘরোয়া পদ্ধতিতে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান পাবেন তা নিয়ে আলোচনা হবে আজকের লেখায়। তবে তার আগে অনিদ্রার বিভিন্ন প্রকারভেদ ও কারণগুলো সম্পর্কে জানা যাক।
অনিদ্রা কী?
অনিদ্রা হলো ঘুম আসার অক্ষমতা। ঘুমের এই ব্যাধিটি স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে। খিটখিটে ভাব, অবসাদ, ক্লান্তি, অমনোযোগ ও মাথাব্যথা অনিদ্রার কিছু প্রভাব। সময় বা মেয়াদকালের উপর ভিত্তি করে অনিদ্রাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- তীব্র অনিদ্রা এবং দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা।
তীব্র অনিদ্রা বনাম দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা
স্বল্প সময়ের জন্য যে অনিদ্রার সমস্যাটি হয়ে থাকে তাকে তীব্র অনিদ্রা বলা হয়। এই ধরনের অনিদ্রার সমস্যাটি কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আর অনিদ্রার সমস্যাটি যখন এক মাস বা বেশি সময়ের জন্য হয়ে থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা বলে।
কেন অনিদ্রার সমস্যাটি হয়ে থাকে
তীব্র অনিদ্রা সাধারণত কাজের চাপ, মানসিক চিন্তা বা আঘাত থেকে হয়ে থাকে। অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা সাধারণত অন্য কোনো সমস্যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে হয়ে থাকে। আর তাই একে সেকেন্ডারি ইনসমনিয়া বা গৌণ অনিদ্রাও বলা হয়ে থাকে। কারণগুলো নিচে দেয়া হলো:
- অ্যাজমা, ঠাণ্ডা এবং অ্যালার্জির ঔষধ।
- স্নায়বিক রোগ।
- শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ব্যাধি
- মাত্রাতিরিক্ত থাইরয়েড গ্রন্থি
- মেনোপজ (যে সময়সীমায় মহিলাদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, সাধারণত ৪০-৫০ বছর বয়সে)
- অত্যধিক মাত্রায় ক্যাফেইন, তামাক অথবা এসবের বিকল্প সেবন।
অনিদ্রা প্রতিরোধে কিছু খাবার
১) কলা
যা দরকার:
- ১টি কলা
- ১-২ কাপ পানি
- দারুচিনি গুঁড়া
যা করতে হবে:
- দু’পাশ থেকে কলার কিছু অংশ কেটে নিন।
- এরপর পাত্রে পানি ও কলা দিয়ে তা ১০ মিনিটের জন্য ফুটিয়ে নিন।
- তারপর সেই পানি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে কাপে ঢেলে দিন।
- এর উপর কিছুটা দারুচিনি গুঁড়া ছিটিয়ে দিন।
- কুসুম গরম থাকতে থাকতে পান করে নিন।
- এছাড়া ঘুমাতে যাওয়ার আগেও আপনি একটি পাকা কলা খেয়ে নিতে পারেন।
- প্রতিবার ঘুম না আসলে আপনি এই পন্থাটি অবলম্বন করতে পারেন।
এই পদ্ধতিটি যে কারণে কার্যকরী
কলা এবং এর খোসাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ট্রিপটোফেন এবং ভিটামিন। এই প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো শরীর ও মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ ও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এরা সর্বোচ্চ মাত্রায় বিভিন্ন হরমোন যেমন- মেলাটোনিন ও সেরটোনিন উৎপাদন করে। এর কারণে মস্তিষ্কে আরাম অনুভূত হয় এবং সহজেই ঘুম চলে আসে।
২) মধু
যা দরকার:
- ১-২ টেবিল চামচ মধু
যা করতে হবে:
- ঘুমাতে যাওয়ার আগে মধু খেয়ে নিন। এছাড়াও ঘুম থেকে উঠে কর্মক্ষম ও উদ্যমতা পাওয়ার জন্য মধুর সাথে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে খেয়ে নিতে পারেন।
- প্রতিরাতে নিয়ম করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মধু খেলে ভালো।
এই পদ্ধতিটি কেন কার্যকরী
ঘুমাতে যাওয়ার আগে মধু খেলে তা যকৃতে গ্লাইকোজেন বহন করে নিয়ে যায়, যা সারা রাত কার্যকরী করতে সাহায্য করে। শরীরে যখন গ্লাইকোজেনের মাত্রা কমে যায়, তখন স্ট্রেস বা কঠিন চাপ দেয়ার মতো হরমোনগুলো উৎপাদন হতে পারে। এতে করে আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং অনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয়। তবে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মধু খেয়ে সহজেই এই সমস্যাটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (অক্সিডেন্টের পক্ষে অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলোর মধ্যকার ভারসাম্য স্থানান্তরিত করে) কম করতে সাহায্য করে।
৩) দুধ
যা দরকার:
- ১ গ্লাস দুধ
যা করতে হবে:
- দুধ সামান্য গরম করে প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ১০-১৫ মিনিট আগে পান করে নিন।
এই পদ্ধতিটি কেন কার্যকরী
দুধে রয়েছে ট্রিপটোফেন, যা শরীরকে শান্ত রাখতে এবং ঘুম আসতে সাহায্য করে।
অনিদ্রা প্রতিরোধে কিছু তেল
১) নারিকেল তাল
যা দরকার:
- ১ টেবিল চামচ নারিকেল তেল
- ১ চা চামচ মধু
- ১ চিমটি লবণ
যা করতে হবে:
- নারিকেল তেল, মধু ও লবণ একসাথে মিশিয়ে নিন।
- প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খেলে ঘুম ভালো হবে।
এই পদ্ধতিটি কেন কার্যকরী
নারিকেল তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি এসিড যা শরীরে সর্বোচ্চ পরিমাণ কর্মশক্তির যোগান দেয়। এছাড়াও এটি হরমোনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যার ফলে ঘুম চক্রটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
২) ক্যাস্টর অয়েল
যা দরকার:
- ১-২ ফোঁটা ক্যাস্টর অয়েল
যা করতে হবে:
- ক্যাস্টর অয়েল চোখের পাতায় দিয়ে আলতোভাবে ঘষুন। তবে সাবধানে করবেন, যেন চোখের ভেতর তেল না ঢুকে যায়।
- প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই নিয়মটি অনুসরণ করতে পারেন।
এই পদ্ধতিটি কেন কার্যকরী
বিভিন্ন সময়ে অনিদ্রার জন্য বিভিন্ন প্রতিকারের মধ্যে এটি বেশ কার্যকরী। ক্যাস্টর অয়েল লম্বা সময়ে ঘুমে সাহায্য করে। যদিও এর সঠিক কার্যপ্রক্রিয়া এখনও অজানা।
৩) কালোজিরার তেল
যা দরকার:
- ১ চা চামচ কালোজিরার তেল
- ১ গ্লাস কুসুম গরম পানি
যা করতে হবে:
- তেলটি মুখে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কুসুম গরম পানি পান করে ফেলুন।
- প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই নিয়মটি মেনে চলুন। দ্রুত ও কার্যকরী ফলাফলের জন্য অন্তত তিন থেকে চার সপ্তাহ টানা এই কাজটি করুন।
এই পদ্ধতিটি কেন কার্যকরী
কালোজিরার তেল মস্তিষ্কে ট্রিপটোফেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটি মেলাটোনিন ও সেরটোনিন হরমোনের সমন্বয় ঘটানোর জন্য প্রয়োজন, যা ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করে।
অনিদ্রা প্রতিকারে ভিটামিন
বিশেষ কিছু ভিটামিন সঠিক ঘুম চক্রকে বজায় রাখার জন্য বেশ প্রয়োজনীয়। শরীরে যদি এদের ঘাটতি হয় বা মাত্রা কমে যায়, তবে অনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয়। অনিদ্রার লক্ষণের সাথে জড়িত ভিটামিনগুলোর তালিকা নিচে দেয়া হলো:
- ভিটামিন বি৩, বি৫, বি৯ ও বি১২ এর ঘাটতি অনিদ্রার সমস্যার সাথে জড়িত। এই ভিটামিনগুলোর অভাবে দুর্বলতা, অবসাদ এবং অনিদ্রা দেখা দেয়। তাই আপনার শরীরে এই ভিটামিনগুলোর চাহিদা পূরণে ডিম, মুরগি ও দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- ঘুম ও স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে ভিটামিন এ মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডিম, মুরগি, দুগ্ধজাত পণ্য ও গরুর মাংসতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে।
- ভিটামিন সি এবং ই হলো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস প্রতিরোধে সাহায্য করে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ই এবং টক জাতীয় ফল, যেমন- স্ট্রবেরি, টমেটো, জলপাই, কমলা, বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার ভালো ঘুম হবে।
Feature Image Source: Reader’s Digest