পৃথিবী সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীর নাম বললে, কারো মাথায়ই হয়তো মশার নামটি আসবে না। এই ক্ষুদে প্রাণীটিকে যতটা না ভয়ংকর মনে হয়, তার চেয়ে বেশি বিরক্তিকরই মনে হয় আমাদের কাছে। কিন্তু সত্য হলো, মানুষের জন্যে এর মতো ক্ষতিকর প্রাণী পৃথিবীতে খুব কমই আছে। প্রতিবছর প্রায় সাতশো মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হন মশাবাহিত রোগ দ্বারা। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু জ্বর, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, জিকার মতো ঘাতক সব ব্যাধির বাহক এই ছোট্ট প্রাণীটি। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যান এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে।
মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি রোগের চিকিৎসা ঔষধের মাধ্যমে করা কঠিন। সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকা। কিন্তু দিন দিন মশারা নিজেদের আবাসভূমি আরো বিস্তৃত করছে, তাদের এড়ানোও হয়ে উঠছে কঠিনতর। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মশা একটি বড় সমস্যা। দশকের পর দশক ধরে সরকারি ও বিভিন্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কীটনাশক স্প্রে করে মশা নিধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল। কারণ মশারা সাধারণভাবে ব্যবহার করা কীটনাশক পদার্থগুলোর প্রতি প্রতিরোধী হয়ে যায়। ফলে ঐ কীটনাশক মশা নিধনে আর খুব একটা কাজে আসে না।
দ্য ইউনাইটেড স্টেট এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (USAID) বহুদিন ধরে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভিন্ন উপায় সন্ধান করে যাচ্ছিলো। তাদের উদ্ভাবন করা বেশ আকর্ষণীয় একটি পদ্ধতি নিয়েই আজকের আলোচনা। এ পদ্ধতিতে প্রথমে আবদ্ধ জায়গায় প্রচুর সংখ্যক পুরুষ মশা জন্ম দেওয়া হয়। এরপর এ সকল মশাকে গামা রশ্মির বিকিরণের মাধ্যমে পুরুষত্বহীন করে ফেলা হয়। সবশেষে পুরুষত্বহীন মশাগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় প্রকৃতিতে, অন্যান্য মশার মাঝে।
এসকল মশা তো আর বুঝতে পারে না যে, তারা নতুন মশার জন্ম দিতে অক্ষম, তাই তারা প্রজননের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ বিশেষ মশাগুলো, সাধারণ প্রাকৃতিক মশাকে হটিয়ে নারী মশাগুলোর নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রতিযোগিতায় জিতলে কী হবে, এরা তো আর নতুন মশার জন্ম দিতে সক্ষম নয়! ফলে নতুন করে জন্মানো মশার সংখ্যা কমে আসে। এ পদ্ধতিতে কোনো স্থানে মশার সংখ্যা প্রায় নব্বই শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
মশাকে পুরুষত্বহীন করে তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের এ ধারণাটি আরো অর্ধশতক আগে থেকেই রয়েছে। তবে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে এ মশা ছড়ানোর কাজটি খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। অধিকাংশ অঞ্চলে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা বা গাড়ি চলার মতো রাস্তার অস্তিত্বই নেই, ফলে বাস বা ট্রাকে করে এসব মশা ছড়ানো সম্ভব হয় না। আকাশযান ব্যবহার করতে গেলে মশা মারতে কামান দাগানোর মতো বিষয় হয়ে যায়, অর্থাৎ এটি বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।
এ সমস্যার সমাধান করতেই আসে ড্রোন ব্যবহার করার চিন্তা। ২০১৬ সালে ইউএসএইড ‘উইরোবোটিকস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দেয়, এ মশাগুলোকে বহন করার জন্যে ড্রোন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে। যেহেতু শত শত বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ মশা ছাড়তে হবে, তাই আকাশযানের বদলে স্বল্প খরচে ড্রোন ব্যবহার করা যায় কীভাবে, সেটিই খুঁজে দেখার চেষ্টা শুরু করে উইরোবোটিকস।
উইরোবোটিকস নামের এ অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ড্রোন-প্রযুক্তিকে সামাজের উপকারের কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিলো। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে তারা প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের রোবোটিকস গবেষণাগার। এর মধ্যে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মিলে তারা ড্রোনকে ব্যবহার করেছে নেপালের রাস্তার মানচিত্র তৈরি করার কাজে, পেরুতে ঔষধ সরবরাহ করতে এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হারিকেন মারিয়ার পরে ত্রাণকার্যে সহযোগিতা করতে। তাই ড্রোনভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্যে তারাই যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এ প্রকল্পে ড্রোন তৈরিটা তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়। সমস্যা হলো মশাগুলোকে কীভাবে বহন করা হবে ও কীভাবে ছাড়া হবে প্রকৃতিতে সেটা। মশা খুবই দুর্বল প্রকৃতির প্রাণী। হাজার হাজার মশাকে যদি একটি ছোট বাক্সে ঠাসাঠাসি করে নেয়া হয়, তবে তারা আহত হয়ে যাবে। আহত মশা তো আর প্রাকৃতিক মশার সাথে পাল্লা দিতে পারবে না, তাই পুরো প্রকল্পটিই ভেস্তে যাবে। এক্ষেত্রে তাই তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে সুস্থ-সবল রেখে যতটা বেশি সম্ভব মশা বহন করা যায়। এজন্য তারা পরিকল্পনা করেন একটি শীতল কন্টেইনার ব্যবহার করার। ৪-৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে মশাগুলো ঘুমিয়ে পড়বে। এর ফলে যথেষ্ট ঘনভাবে তাদের প্যাক করা যাবে।
ড্রোন থেকে মশাগুলোকে ছাড়ার বিষয়টিতেও সতর্কতা জরুরি। সবগুলো মশাকে একসাথে ফেলে দিলেও সেগুলো সুস্থ-সবল থাকবে না। এজন্য তারা বেশ কয়েকটি পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সবশেষে তারা একটি ছোট ছিদ্রসম্পন্ন ঘূর্ণায়মান বাক্স ব্যবহার করেন, যাতে একটি একটি করে মশা বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। বাক্সটি থেকে বেরোনোর পর তারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্য একটি চেম্বারে অবস্থান করে, যেখানে তাদের শরীরের তাপমাত্রা বাইরের সাথে এক করা হয়; নিশ্চিত করা হয় যে, তারা জেগে উঠেছে এবং ওড়ার জন্য প্রস্তুত।
শুধুমাত্র পুরুষত্বহীন মশাই নয়, ভবিষ্যতে এ প্রকল্পে আরো কয়েক ধরনের মশা বিস্তৃত করা হবে। হয়তো জীনগত পরিবর্তন করা মশা ছড়ানো হতে পারে, যাদের সন্তানেরা পরবর্তীতে প্রজননে অক্ষম হবে। Wolbachia pipientis নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পুরুষ মশাকে আক্রান্ত করলে তাদের সন্তানেরা প্রজননে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা স্ত্রী মশাকে আক্রান্ত করলে, এটি কামড়ালেও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়।
তবে বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে প্রথমে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে, ড্রোন দিয়ে মশা বহন করাটা, সাধারণ মানুষের ব্যাগে করে মশা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার চাইতে বেশি উপযোগী হবে কি না। এজন্য বেশ কয়েকবার পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রকল্প পরিচালনা করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার প্রয়োজন ছিল। অবশেষে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এ বছরের এপ্রিলে তারা এ প্রকল্পকে সর্বপ্রথম মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করেন।
ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ করতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এর সহযোগিতায় উইরোবোটিকস সেখানে ড্রোনের সাহায্যে কয়েক লক্ষ বিশেষ মশা ছাড়ে। তারা বেশ সফলভাবেই গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। এ সম্পর্কে উইরোবোটিকসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম ক্লপটোকজ বলেন, “প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফলে আমরা খুশি। শীতলীকরণ, বহন ও নির্গমন সহ গোটা প্রক্রিয়ায় মাত্র শতকরা দশ ভাগ মশার মৃত্যু হয়েছে।”
ড্রোন ব্যবহারের ফলে মশা ছড়ানোর কাজটি কেবলমাত্র সহজই হয়নি, গোটা প্রক্রিয়াটি হয়ে উঠেছে আরো দ্রুততর। এখন ড্রোন দিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটে ২০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে মশা বিস্তৃত করা সম্ভব হয়। ড্রোনগুলো প্রতি ফ্লাইটে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মশা বহন করতে সক্ষম। অবশ্য গবেষকরা এখন প্রতি ফ্লাইটে বহন করা মশার সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া ড্রোন ব্যবহারের ফলে খরচও কমে গেছে অনেক। প্রতিটি ড্রোনের পেছনে খরচ হয় মাত্র দশ হাজার ইউরো। এটি অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় খরচ প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দেয়।
মশার জন্ম নিয়ন্ত্রণের এ পদ্ধতিটি সফল হলে এটি মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বেশ বড়সড় অর্জন হয়ে উঠবে। আমাদের দেশেও আমরা প্রতিনিয়িত নানা মশাবাহিত রোগের শিকার হই প্রতিনিয়ত। আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদে যদি এভাবে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়, তবে সেটি সত্যিই অসাধারণ বিষয় হবে।