কথায় বলে, সুস্থতা সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় নিয়ামত। সুস্থতা যে কত বড় দান তা আমরা বুঝতে পারি নিজেরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি সেই সময়টায়। অনেকে আবার জন্মগতভাবেই অনেক ধরনের সমস্যা নিয়ে ধরণীতে আসেন। যে সকল সমস্যার জন্য পরবর্তী জীবনে তাকে ও তার পরিবারকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক সময় এ সমস্যাগুলোর সমাধান হয়, অনেক সময় হয় না।
একটি শিশু যখন কোনো সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয় বা বড় হয়ে ওঠে, সে সমস্যাটি তার মাঝে কখন থেকে শুরু হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে মূলত আক্রান্ত হওয়ার সময়কালকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রি-ন্যাটাল বা জন্মপূর্বকালীন সমস্যা, পেরিন্যাটাল বা জন্মকালীন সমস্যা এবং পোস্ট ন্যাটাল বা জন্ম পরবর্তী সমস্যা। আমরা আজ শিশুদের প্রি-ন্যাটাল পিরিয়ডের অন্যতম একটি দুরারোগ্য সমস্যা ‘ডাউন সিনড্রোম’ নিয়ে জানবো।
ডাউন সিনড্রোম (Dowm Syndrome) একটি বিশেষ ধরনের জেনেটিক বা জিনগত অবস্থা। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষের ক্রোমোজোমের গঠন সাধারণ মানুষের ক্রোমোজমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন ডাউন সর্বপ্রথম ১৮৬৬ সালে এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদেরকে চিহ্নিত করেন বলে তার নামানুসারে একে ডাউন সিনড্রোম নামকরণ করা হয়।
মানবদেহের গঠনের একককে কোষ বা সেল (Cell) বলা হয়। আর তাদের বংশগতি, আচার আচরণ ইত্যাদি সবকিছু নির্ধারিত হয় কোষস্থ ডিএনএ’র মাধ্যমে। এ কারণে ডিএনএ-কে বলা হয় আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহক। অর্থাৎ আমাদের শারীরিক ও মানসিক যাবতীয় বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং সব বৈশিষ্ট্যই ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যদিকে মানব শরীরে ডিএনএ’র অসামঞ্জস্য দেখা দিলে নানারকম শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি দেখা দেয়, যাদের আমরা সাধারণভাবে জন্মগত ত্রুটি বা জেনেটিক ডিজঅর্ডার বলে থাকি। ডাউন সিনড্রোম হলো সেরকমই এক জেনেটিক ত্রুটিযুক্ত মানবশিশু।
কোষে অবস্থান করা কোটি কোটি ডিএনএ’র সমন্বয়ে একেকটি ক্রোমোজম তৈরি হয়। মানবদেহের প্রতিটি কোষের মধ্যে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম নামের অঙ্গানু থাকে, যার অর্ধেক আসে শিশুর মায়ের কাছ থেকে আর বাকি অর্ধেক বাবার কাছ থেকে। যার শরীরের প্রতিটি কোষে ২১ নম্বর ক্রোমোজমটির সঙ্গে আংশিক বা পূর্ণভাবে আরেকটি ক্রোমোজম (Trisomy 21) যুক্ত থাকে। ২১ নম্বর ক্রোমোজম তিনটি থাকে বলে ২১/৩ বা একুশে মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস হিসেবে পালিত হয়। আর মূলত এ অতিরিক্ত ক্রোমোজমের কারণেই ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের বিশেষ কিছু শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। চেহারার গঠনগত দিক বিবেচনায় বা আচার আচরণে অধিকাংশ ডাউন সিনড্রোম আক্রান্তদের মাঝে মিল থাকার কারণে তাদেরকে সহজেই ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু হিসেবে শনাক্ত করা যায়।
এ পর্যায়ে আমরা ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের সাধারণ কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো। ডাউন শিশুদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়; যেমন, তাদের মাংসপেশী সাধারণ মানুষদের তুলনায় শিথিল হয়। অর্থাৎ, সাধারণ একজন মানুষের পেশীতে যতটা শক্তি থাকে তা ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির থাকে না। অনেকের ক্ষেত্রে আবার বিপরীতটাও লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত শক্ত মাংসপেশী থাকে অনেকের যা তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্যে বাধার সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকের তুলনায় ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের আকৃতি খাটো হয়। যার কারণে তাদের মাঝে খর্বাকৃতির সমস্যাটি প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। এছাড়াও এ সিনড্রোমের কারণে স্বাভাবিক মানুষের মতো সোজা দৃষ্টি না থেকে বরং অনেক ক্ষেত্রে চোখের কোনা উপরের দিকে ওঠানো বা চোখ ট্যারা হওয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়। এর কারণে তারা কখন কোনদিকে তাকিয়ে কথা বলছে তা আশেপাশের মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। পাশাপাশি নাক স্বাভাবিকের তুলনায় চ্যাপ্টা হওয়া, কানের আকৃতি ছোট হওয়া এবং বহিঃকর্ণ বা পিনার ভাঁজগুলো সঠিকভাবে না থাকা, জিহবা বের হয়ে থাকা, অনিয়ন্ত্রিতভাবে লালাক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায় ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের বেলায়।
এ তো গেল শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা। এবার জেনে নেওয়া যাক ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের মানসিক বা আচরণগত কী কী সমস্যা দেখা দেয়। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত একটি শিশু বয়সের সাথে সাথে আর দশজন স্বাভাবিক শিশুর মতো জ্ঞানীয় বা আচরণগত বিকাশ ঘটাতে পারে না। তাদের আবেগীয় বিকাশটি সঠিকভাবে হয়ে ওঠে না। ফলে আশেপাশের যেকোনো কিছুর প্রতি তাদের অতিরিক্ত আবেগ প্রদর্শন বা একদমই আবেগীয় কোনো অনুভূতি দেখা যায় না। দেখা গেলো, খুব সাধারণ একটি শব্দে তারা ভয় পেয়ে চমকে ওঠে, কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার অনেক সময় এরাই অনেক ভয়ের বিষয় বা অনুভূতি প্রকাশ করার মতো ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে। অর্থাৎ, মানসিক বিকাশ বা জ্ঞানীয় বিকাশগত জায়গা থেকে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের বেশ কিছু সমস্যা দেখা যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত গুটিকয়েক শিশু অস্বাভাবিক আইকিউ সম্পন্ন হয়ে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এদের Exceptional Children বলা হয়।
ডাউন সিনড্রোমের আক্রান্ত শিশুদের জন্মহার কমাতে WHO (World Health Organization) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জনসচেতনতা, চিকিৎসা প্রদানসহ বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রত্যেক গর্ভবতী মাকে ডাউন শিশু এবং অন্যান্য সম্ভাব্য জন্মগত ত্রুটি ও তা নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া চিকিৎসকদের জন্য বাধ্যতামূলক। যেহেতু মায়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেয়ার ঝুঁকিও বাড়ে, তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধিক বয়সে, বিশেষ করে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে গর্ভধারণ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে। যেহেতু ডাউন সিনড্রোম দুরারোগ্য হলেও জন্মের পূর্বেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব, তাই সুস্থ ও মেধাবী শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে হলে ডাউন শিশুর মতো প্রতিরোধযোগ্য জন্মগত ত্রুটির বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গর্ভবতী নারীর সেবায় অনাগত শিশুর জন্মগত ত্রুটির বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত বা ডাউন শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করতে পারে। আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় ৬,০০০ ডাউন শিশুর জন্ম হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫,০০০ বা প্রতিদিন প্রায় ১৫টি ডাউন শিশুর জন্ম হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা একেবারেই কম নয়। বর্তমানে অটিজম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে আমাদের দেশে বেশ জোরেসোরেই কাজ হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ছাড়াও ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে সবাই যদি সচেতনতা সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসে, তবেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি হবে।