ভ্যাক্সিন এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষাবিধি, সামাজিক দূরত্ব ইত্যাদি পদক্ষেপে পৃথিবীজুড়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে অনেকটাই। তবে এতসব অর্জনকে চোখরাঙাচ্ছে মিউটেশনের ভয়। প্রায় কয়েক মাস পরপরই নতুন নতুন মিউটেশন নিয়ে হাজির হচ্ছে নানা ভ্যারিয়েন্ট। তবে দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই মিউটেশনগুলো নির্বিষ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে করোনার বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কাজ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সার্স-কোভ-২ বিবর্তন সংক্রান্ত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (Technical Advisory Group on SARS-CoV-2 Virus Evolution)। তাদের মূল কাজ করোনাভাইরাসের মিউটেশন পর্যালোচনা এবং নতুন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ। কোনো মিউটেশনের ফলে যখন নতুন একটি ধরনের করোনাভাইরাস তৈরি হয়, তখন এই কমিটির সভা বসে।
পূর্বের ভ্যারিয়েন্টেগুলোর মধ্যে ডেল্টা নিয়েই বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। খুব সম্প্রতি বতসোয়ানাতে আবিষ্কার হয় নতুন আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট, যার মিউটেশন আগের সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। নভেম্বরের ৯ তারিখে কোভিড রোগীর রক্তের নমুনায় এই জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সাংকেতিকভাবে এর নাম দেয়া হয়েছিল B.1.1.529। দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রাথমিকভাবে মূলত এই ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার প্রবলভাবে ঘটছে বলে জানা যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য বিভাগ ২৪ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে তথ্য প্রদান করে। ২৬ তারিখ কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি সভায় বসে। করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের নাম হিসেবে গ্রীক বর্ণমালার অক্ষর বেছে নেয়ার প্রথা। ফলে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের নাম হিসেবে বেছে নেয়া হলো ওমিক্রন (Ο)। কারিগরি কমিটির সুপারিশ মেনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন’ (VOC/ Variant of Concern) বা উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানা ছাড়াও হংকং আর বেলজিয়ামে প্রথমে ওমিক্রন পাওয়া গিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, করোনা থেকে সেরে উঠতে ব্যর্থ এরকম কোনো রোগীর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। আফ্রিকার পর যুক্তরাজ্য, নেদাল্যান্ডসে আর ইতালিতেও একাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। ইসরায়েল ও ডেনমার্কে অন্তত একজন করে রোগী শনাক্ত করা গেছে। ধারণা করা হয়, আফ্রিকা থেকেই এসব দেশে ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটেছে। এশিয়া আর ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জীনবিজ্ঞানীরা শনাক্ত হওয়ামাত্র ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাদের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ৫০টি মিউটেশন সনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে অন্তত ৩০টি স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশন বলে মনে করা হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এই স্পাইক প্রোটিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর দ্বারাই ভাইরাস মানবকোষে যুক্ত হয় এবং বংশবিস্তার করে। বেশ কয়েকটি ভ্যাক্সিন এই স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করেই কাজ করে।
যেকোনো করোনার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা তিনটি বিষয় বিশ্লেষণ করেন। এর মাধ্যমে ভাইরাসটি কতটা বিপদজনক তা নির্ধারণ করা হয়। প্রথম বিষয় এই ভ্যারিয়েন্ট কতটা সংক্রামক, দ্বিতীয় হলো এর থেকে সৃষ্ট রোগের প্রকোপ কেমন। সবশেষে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফাঁকি দেবার সক্ষমতা এই ভ্যারিয়েন্টের কতটুকু, যাকে বলা হয় ইমিউন এস্কেপ (Immune escape)।
সংক্রমণ ক্ষমতার দিকে নজর দেয়া যাক। যদিও মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, তারপরও এই ক’দিনেই দ্রুত এই ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশিস ঝা এখন অবধি প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলো এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশ কয়েকমাস সময় নিয়েছিল। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সপ্তাহখানেকের মাঝেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতীয়ভাবে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, সিংহভাগ কোভিড রোগীই নাকি ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। অধ্যাপক ঝার মতে, এত দ্রুত দক্ষিণ আফ্রিকাতে ওমিক্রন নিজেকে প্রধান ভাইরাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে যা উদ্বেগজনক। এর পেছনে জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩৬% টিকাপ্রাপ্ত হওয়া একটি ফ্যাক্টর হতে পারে। নতুন করে টিকা নিতে বহু লোকের অনীহাও বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ওমিক্রনের পুনঃসংক্রমণ ক্ষমতা নিয়েও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে, করোনা থেকে সেরে উঠেছে এমন রোগীদের ওমিক্রন আক্রমণ করতে পারে, ফলে নতুন করে তাদের রোগ তৈরি হয়।
রোগের প্রকোপ চিন্তা করলে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা কোনো সিদ্ধান্তে আসার মতো যথেষ্ট নয়। এজন্য আক্রান্তদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং হাসপাতালে ওমিক্রনের রোগী ভর্তির ধারা দেখা দরকার। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও তথ্য পেতে হবে।
সর্বশেষ ব্যাপার ওমিক্রনের মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়িয়ে যাওয়ার সামর্থ্য। প্রচলিত ভ্যাক্সিন নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের উপর কতটা কাজ করবে সেটা জানার জন্য এটি খুব প্রয়োজনীয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যতই মিউটেশন হোক, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে টিকা একেবারে অকার্যকর হবে না। তবে ওমিক্রনের মিউটেশন নিয়ে উদ্বেগের কারণ আছে বলেও তারা ধারণা করেন। অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের থেকে ওমিক্রনের মিউটেশনের সংখ্যা অনেক বেশি। এবং স্পাইক প্রোটিন মিউটেশন ভাইরাসের উপর ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা নষ্ট না করলেও বেশ কমিয়ে দিতে পারে।
ইউরোপিয়ান রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (The European Centre for Disease Prevention and Control) জানিয়েছে, ওমিক্রনের মানবশরীরের ইমিউন সিস্টেমকে প্রতিহত করতে পারা নিয়ে আগে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তবে তাদের মতামত হলো- ইউরোপে এই ভাইরাস নতুন করে বিস্তারের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তো বলেই আসছে- নতুন করে ইউরোপ ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল হয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ওমিক্রনের উপস্থিতি জানা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অন্যতম করোনা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. অ্যান্থনি ফাউচির মতে, নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট একটি ‘রেড ফ্ল্যাগ’। যদিও তিনি শুরুতেই এর রাশ টেনে ধরা যাবে বলে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই প্রধান করোনাভাইরাস, যুক্তরাষ্ট্রেও এটি শতকরা ৯৯ ভাগ কোভিডের কারণ। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গ্রাহাম স্নাইডারের মতে, ডেল্টাকে সরিয়ে ওমিক্রন প্রথম স্থানে উঠে আসবে কিনা সেই বিচার করার সময় আসেনি এখনও।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব ও রোগ প্রতিরোধবিদ্যার অধ্যাপক ড. ডেভিড হো কিছুটা শঙ্কিত। তিনি কোভিডের প্রচলিত চিকিৎসার উপর ওমিক্রনের প্রভাব খারাপ হতে পারে বলে ধারণা করছেন। এর ফলে হয়তো কোভিডের অনেক চিকিৎসাই নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সফল হবে না।
ড. আশিস ঝা মনে করেন না যে ওমিক্রন এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি করবে যেখানে অনুমোদিত ভ্যাক্সিন অকার্যকর হয়ে পড়বে। তবে ভ্যাক্সিনের রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতার উপর কিছু না কিছু প্রভাব এর থাকবে। কিন্তু এই প্রভাবের মাত্রা কতটা হবে তার উপর অনেককিছু নির্ভর করবে
ভ্যাক্সিন কোম্পানিগুলোও কাজ শুরু করে দিয়েছে। নভেম্বরের ২৬ তারিখে মডার্নার প্রকাশিত প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে- তারা নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তারা এই ব্যাপারে তথ্য পাবে বলে আশা করছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর ফাইজার বায়ো-এন-টেকও অনুরূপ কাজ করছে। তারাও আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজ নিজ ভ্যাক্সিনের উপর ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব জানতে পারবে বলে দাবি করছে। জনসন অ্যান্ড জনসনের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন তাদের গবেষকেরাও ব্যস্ত আছেন ওমিক্রনের উপর জনসনের টিকার ক্ষমতা দেখতে।
যদি বর্তমান ভ্যাক্সিনে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উপর ন্যূনতম কার্যকারিতা দৃষ্টিগোচর হয়, সেক্ষেত্রে কয়েকটি উপায় আছে। হোয়াইট হাউজের প্রাক্তন করোনা বিষয়ক উপদেষ্টা অ্যান্ডি স্লাভিটের মতে, অনুমোদিত ভ্যাক্সিনের কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে একে নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্য অধিকতর উপযোগী করা সম্ভব। মডার্না আর ফাইজার জানিয়েছে, এই বিষয়ে তাদের প্রস্তুতি রয়েছে এবং ১০০ দিনের মধ্যেই এটি করা সম্ভব। তবে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি পেতে পেতে শীতকাল পার হয়ে যাবে।
আরেকটি উপায় হতে পারে কোভিড টিকার ডোজ বাড়িয়ে দেয়া। ওমিক্রনের জন্য বিশেষায়িত বুস্টার এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। মডার্না ইতোমধ্যেই এই কৌশল বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে।
চিকিৎসার ব্যাপারে অবশ্য আশার আলো দেখাচ্ছে মলনুপিরাভির এবং ফাইজারের ট্রায়ালের পর্যায়ে থাকা ওষুধ প্যাক্সলোভিড। এরা ভাইরাসের এমন একটি অংশকে টার্গেট করে যা ওমিক্রনের ক্ষেত্রে রুপান্তরিত হয় না। ফলে প্রচুর মিউটেশন সত্ত্বেও মলনুপিরাভির ও প্যাক্সলোভিড ওমিক্রনে আক্রান্তদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।
ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলোতে বিমান যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে অধিকতর তথ্য পাওয়া গেলে এই ওমিক্রনের রোগসৃষ্টি ও বিস্তারের ক্ষমতা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে। ফলে প্রয়োজনানুযায়ী জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণ করার অবকাশ থাকবে।
যা-ই হোক না কেন, একথা মনে রাখতে হবে যে করোনা মহামারি একটি নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে চলে এলেও যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে পারে। কাজেই সতর্কতায় একচুল ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। সুতরাং টিকা গ্রহণ এবং সুরক্ষার সমস্ত উপায় মেনে চলা জরুরি। একইসাথে অবৈজ্ঞানিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস না রেখে মনোযোগ দিতে হবে চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথার ওপর।