মাহমুদ সাহেব একজন সরকারি কর্মকর্তা, বয়স উনষাট বছর। কিছুদিন অাগেই কাস্টমস অফিসের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, বর্তমানে তাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করছেন।
তবে মিষ্টভাষী এই মানুষটির কেবল এক জায়গাতেই একটু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেটা হলো, তিনি সব কিছুই ভুলে যান। মানুষের নাম, ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বর কিছুই মনে রাখতে পারেন না। কখনো কারো সাথে কোনো বিষয়ে অালাপচারিতা শুরু করলে কিছুক্ষণ বাদেই ভুলে যান ঠিক কী ব্যাপারে কথা বলছিলেন। ঘড়িতে এখন ক’টা বেজেছে কিংবা অাজকে কোন মাসের কত তারিখ, সেটাও মনে রাখতে তার বেজায় অসুবিধা।
নম্র ও মিশুকে স্বভাবের মাহমুদ সাহেব ধীরে ধীরে খিটখিটে মেজাজের হতে শুরু করলেন। ফলাফল- সাংসারিক অশান্তি এবং মনোমালিন্য। স্বামীর আচরণের এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন তার স্ত্রী। দ্বারস্থ হলেন পরিচিত এক মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানালেন, মাহমুদ সাহেব অ্যালঝেইমার রোগে আক্রান্ত।
অ্যালঝেইমার কী?
আমরা জানি, মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে তার স্মৃতিশক্তি। বিশেষত, চল্লিশের কোঠা পেরোনোর পরপরই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সব কিছু ভুলে যাবার প্রবণতা। এই স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার কারণ যেসকল রোগ, সেগুলো মধ্যে অন্যতম হলো অ্যালঝেইমার।
অ্যালঝেইমার একটি বিশেষ দুরারোগ্য স্নায়বিক ব্যধি, যা ধীরে ধীরে একজন মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা, চিন্তাশক্তি এবং স্মৃতিশক্তির ক্ষতিসাধন করে। সময়ের সঙ্গে এই রোগের উপসর্গ ক্রমাগত বেড়ে রোগীর দৈনন্দিন কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
এই রোগ হলে রোগীর স্মৃতিশক্তি কমে যেতে শুরু করে। রোগী সাম্প্রতিক (short term) এবং অতীত (long term) দুই ধরনের স্মৃতিই ভুলে যেতে শুরু করে, যদিও সাম্প্রতিক স্মৃতি ভুলে যাবার হারটাই অধিক। এছাড়া রোগীর মাঝে দ্বিধা, খিটখিটে স্বভাব, উদ্ধত ভাব, বিষণ্নতা, অবসাদ, বাকশক্তিহীনতা বা অন্যের কথা বোঝার ক্ষমতা লোপ পাওয়া (aphasia) সহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রোগী তার এই সমস্যাগুলো বুঝতে না পারায় তিনি পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তার বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়; ফলস্বরূপ তিনি চরম একাকিত্বে ভুগতে থাকেন।
ইতিহাস
অ্যালঝেইমারের ইতিহাসটা খুব পুরনো নয়। ১৯০১ সালে জার্মান মনোচিকিৎসক অ্যালোইস অ্যালঝেইমার তার রোগী অগাস্ট ডিটারের অস্বাভাবিক উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করে সর্বপ্রথম এ রোগের বর্ণনা দেন। তবে তার সহকর্মী মনোচিকিৎসক এমিল ক্রেপেলিন তার একটি গ্রন্থে রোগটিকে অ্যালঝেইমার’স ডিজিজ বলে সর্বপ্রথম অভিহিত করেন।
১৯৩৩ সালে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) Cognex-কে অ্যালঝেইমারের প্রথম কার্যকরী প্রতিষেধক হিসেবে অনুমোদন দেয়। ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিং (National Institute on Aging – NIA), যা এখনো অ্যালঝেইমারের গবেষণায় ভূমিকা রেখে চলেছে। এরপর ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসকে অ্যালঝেইমার সচেতনতা মাস বলে ঘোষণা করা হয়।
কারণ
এই রোগের স্পষ্ট কারণ আজও সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। যে সকল উপাদান বা নিউরোট্রান্সমিটার পরিবহনের মাধ্যমে মস্তিস্ক তার কাজ সম্পাদন করে, তাদের সমস্যার কারণেই এই রোগটি হয়ে থাকে।
শারীরিক কারণ: মস্তিস্কের আকার ছোট (Atrophy) হয়ে আসতে থাকলে, বিশেষ করে সেরিব্রাল কর্টেক্স (Cerebral cortex) এবং হিপোক্যাম্পাস (Hippocampus) এর আকার উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকলে এই রোগ দেখা দিতে পারে।
প্রাণরাসায়নিক কারণ: অ্যাপোলিপোপ্রোটিন ই (apoE) নামে একধরনের প্রোটিন অ্যালঝেইমারের ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই apoE থাকে, যা রক্তে কোলেস্টেরল সরবরাহ করতে সাহায্য করে। apoE মূলত দুই প্রকারের। একটি যেখানে আমাদের অ্যালঝেইমারের হাত থেকে বাঁচায়, অপরটি এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
বয়স: বয়স এই অসুখের ঝুঁকি সবথেকে বেশি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষত ষাটের ওপরে যাদের বয়স, তাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
জিনগত কারণ: জিনগত কারণেও অ্যালঝেইমার হতে পারে। পরিসংখান অনুযায়ী, শতকরা ১৫ ভাগ রোগীই এ রোগে আক্রান্ত হন পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে।
অন্যান্য কারণ: পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি এবং ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের এই অসুখের কবলে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
উপসর্গ
অ্যালঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী ছোটোখাট জিনিস ভুলে যেতে থাকেন, ধীরে ধীরে যা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর জীবনে এর উপসর্গও আলাদা হতে পারে। সাধারণ উপসর্গগুলো হলো:
- ক্রমাগত স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার ফলে পুরনো ঘটনা, অভিজ্ঞতা, পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের ভুলে যাওয়া।
- ক্রমশ দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন- পোশাক পরা, রান্না করা বা খেলাধুলাও ভুলে যেতে থাকা। একই জিনিস বারবার মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও ভুলে যাওয়া।
- সময় ও জায়গা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগা। গুরুত্বপূর্ণ তারিখ, ফোন নাম্বার, ঠিকানা ইত্যাদি মনে না রাখতে পারা।
- কোনো জিনিসকে তার সঠিক স্থানে রাখতে না পারা। যেমন- কলম টেবিলে না রেখে ফ্রিজে রেখে দেয়া এবং পরবর্তীতে ঐ জিনিসটি কোথায় রেখেছে তা মনে করতে না পারা।
- অন্য ব্যক্তির সাথে স্বাভাবিক কথোপকথন চালিয়ে যেতে না পারা। যেমন- মাঝখানে কথা বন্ধ করে দেয়া কিংবা একই কথা বারবার বলা।
- লিখতে অথবা কথা বলতে গিয়ে সঠিক শব্দ নির্বাচনে সমস্যা দেখা দেয়া।
- যেকোনো সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব, যেমন- টাকা-পয়সা বা কোনো কিছু গুনতে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
- পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা। যেমন- আলো নেভানো, পানির কল বন্ধ করার মতো কাজেও অসুবিধা হওয়া।
- আশেপাশের লোকজনদের অবিশ্বাস করতে শুরু করা। নিজেকে সামাজিক, পারিবারিক কিংবা অন্যান্য শৌখিন কাজকর্ম থেকে গুটিয়ে ফেলা।
- কোনোকিছুর রঙ নির্ধারণ ও দূরত্ব পরিমাপ করতে অক্ষমতা। কোনো ক্ষেত্রে আয়নায় নিজের চেহারা দেখেও বুঝতে না পারা যে আয়নার ঐ ব্যক্তিটি তিনি নিজেই।
- মানসিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়া। যেমন- দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, অবসাদ ও মেজাজের তারতম্য দেখা দেয়া।
- নিচের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাটা।
রোগনির্ণয়
সাধারণত চিকিৎসক রোগীর ইতিহাস জেনে এবং তার আত্মীয়দের সাথে কথা বলেই রোগটি নিশ্চিত করতে পারেন। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় সিটি স্ক্যান, এমআরআই, স্পেক্ট (SPECT-single photon emission computed tomography), পেট স্ক্যান (PET-positron emission tomography) এসব পরীক্ষা করে অনেক সময় নিশ্চিত হতে হয় রোগীর এর সাথে মস্তিস্কের অন্য কোনো রোগ আছে কি না।
চিকিৎসা
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, অ্যালঝেইমার রোগের এখনও সঠিক কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে পরিবারের আপনজনেরা সহানুভূতিশীল হলে এবং রোগীর জন্য একটি স্নেহময় পরিবেশ সৃষ্টি করলে তিনিও একটি অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারেন।
বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা যায়, যে সকল ব্যক্তি মধ্যবয়সে বিভিন্ন বুদ্ধিভিত্তিক কাজ (যেমন- লেখালেখি, বইপড়া, যন্ত্রসংগীত বাজানো), বিভিন্ন সামাজিক/সেবামূলক কাজ, বোর্ড গেম খেলা (দাবা, শব্দজট) ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকেন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খান, তাদের মাঝে এ রোগ হবার প্রবণতা কম। তাই এ সকল কাজে অংশগ্রহণ অ্যালঝেইমার রোগের উপশমে ভূমিকা রেখে থাকে।
অ্যালঝেইমার রোগের উপশমে DONEPEZIL, GALANTAMINE, MEMANTINE, RIVASTIGMINE নামক কিছু ওষুধ আবিস্কৃত হয়েছে। এদের কার্যকারিতা শতভাগ না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এরা রোগ উপশমে আশানুরূপ কার্যকারিতার প্রমাণ রেখেছে।
প্রতিরোধ
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ কমিয়ে দেয়া।
- লিগিউমস, যেমন- শিম, মটরশুঁটি, মসুর ডাল এগুলো খাওয়ার অভ্যাস করা।
- ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাদ্য, যেমন- কলিজা, গরুর মাংস, ডিম, দই, দুধ, পনির, টুনা মাছ গ্রহণ করা।
- অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিল ব্যবহার পরিহার করা।
- আয়রন এবং কপার আছে এমন মাল্টিভিটামিন এড়িয়ে চলা।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ মিনিট এমনভাবে হাঁটতে হবে যেন শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয় এবং ঘাম হয় (এ ধরনের এক্সারসাইজকে অ্যারোবিক এক্সারসাইজ বলে)
করণীয়
- একজন অ্যালঝেইমার রোগীর যত্ন নিতে হলে তাঁর কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, জীবন এখনও ফুরিয়ে যায়নি। তার পাশে দাঁড়াতে হবে এবং মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য উৎসাহ জোগাতে হবে।
- বাড়ির পরিবেশ যদি শান্ত রাখা যায় তাহলে রোগীর আচার আচরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব। ভিড়, হৈহুল্লোড়, নতুন পরিবেশ বা কাজের চাপে রোগী মুষড়ে পড়তে পারেন, যা তার চিন্তাশক্তির অবক্ষয় ঘটাতে যথেষ্ট।
- একজন উকিলের সাহায্যে ভবিষ্যতে তার দেখভাল কে করবেন বা টাকা পয়সা কে সামলাবেন, সেটা সময় থাকতে রোগীর নিজেই ঠিক করে নেওয়া উচিত।
বাস্তবতা এটাই যে, বার্ধক্যে উপনীত হলে আমরা যে কেউই অ্যালঝেইমার রোগের শিকার হয়ে উঠতে পারি। তাই আমাদের সকলের উচিত এমন রোগীদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা এবং আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটি সুন্দর পৃথিবীর পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস অব্যাহত রাখা।