পৃথিবী জুড়ে এখন প্রযুক্তির জয়জয়কার। জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। একসময় সিনেমা দেখতে হতো সাদা-কালো প্রিন্টে, আর এখন যুগটা থ্রিডি মুভির। ক্লাস-শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ব্যপ্তি ছাড়িয়ে পড়াশোনা একসময় দূরবর্তী শিখনের মতো চমৎকার পর্যায়ে চলে এলো, আর এখন পড়াশোনাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে অগমেন্টেড রিয়েলিটির মতো অসাধারণ প্রযুক্তি। দুনিয়াজোড়া সবকিছুতেই যখন প্রযুক্তির নানাবিধ প্রয়োগ বেড়েই চলেছে তখন চিকিৎসাবিদ্যাই বা কেন বঞ্চিত রইবে?
প্রিয় পাঠক, চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রযুক্তির কিছু আনকোরা সংযোজন নিয়েই আমাদের এই আয়োজন। এদের কোনোটি পাল্টে দেবে চিকিৎসার ধরনকে, কোনোটি রোগীর জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে আসবে, আবার কোনোটি শরীরের অভ্যন্তরীণ রহস্যকে নিয়ে আসবে হাতের মুঠোয়।
ডিএনএ অরিগ্যামি
ন্যানোপার্টিকেল সংশ্লেষণের জন্য ডিএনএকে গাঠনিক একক হিসেবে ব্যবহার করার পদ্ধতিকেই বলা হয় ডিএনএ অরিগ্যামি। ন্যানোটেকনোলজির ভুবনে ডিএনএ অরিগ্যামি এক অত্যাধুনিক সংযোজন। জাপানী শব্দ অরিগ্যামি বলতে বোঝানো হয়ে থাকে কাগজকে বিভিন্নভাবে ভাঁজ করে নতুন আকৃতি প্রদান করা।
ডিএনএ’র বেশ দীর্ঘ স্ট্র্যান্ডকে স্ট্যাপল স্ট্র্যান্ডে রূপান্তর করে একটি নতুন অবয়ব দেওয়া হয়, যাতে প্রায় ২০০-৩০০টি নিউক্লিওটাইড থাকতে পারে। ডিএনএ’র মতো বৃহদাকার অণুকে এতটা ক্ষুদ্র আকারে সীমাবদ্ধ করে ফেলার মাধ্যমে একে ব্যবহার করা যায় ক্যান্সার থেরাপি, ড্রাগ ডেলিভারি এবং রোগ নির্ণয়ে। আজ অবধি ডিএনএ অরিগ্যামির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাওয়া গেছে ইঁদুরের স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায়।
বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বদৌলতে আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তিটি কাজ করে মূলত একটি অ্যালগরিদমের মাধ্যমে। অ্যালগরিদমটিতে কাঙ্ক্ষিত আকার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি প্রদান করলে বিদ্যমান ডিএনএ স্ট্র্যান্ডগুলো ভাঁজ হয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, দ্বি বা ত্রিমাত্রিক আকারে সজ্জিত হয়। প্রাপ্ত আকৃতিটিকে তুলনা করা যেতে পারে একটি মাচার সাথে। এই মাচার বিভিন্ন খালি জায়গা দিয়ে অন্যান্য অণুর প্রবেশ ডিএনএ অরিগ্যামিকে তার নিজস্ব কার্যক্ষমতা প্রদান করে।
গবেষকরা আশা ব্যক্ত করেছেন যে, শীঘ্রই তারা হয়তো ডিএনএ অরিগ্যামির মাধ্যমে মানুষের শরীরের সুনির্দিষ্ট অংশে জিন এডিটিংয়ের মতো কাজও করতে পারবেন। ডিএনএ অরিগ্যামি সম্পর্কে এমআইটির অধ্যাপক মার্ক বেথের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য ছিল, “Holy grail!”
এই বিষয়ে বেশ চমকপ্রদ তথ্য হলো, বিজ্ঞানীরা ডিএনএ অরিগ্যামির মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরিসরের টিক-ট্যাক-টো গেম তৈরি করেছেন। এছাড়াও তৈরি হয়েছে হাসিমুখের স্মাইলি- ‘Stapling a Smiley’।
বায়োনিক আই
বায়োনিক আই নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও সম্পূর্ণ সফল নন। তবে তারা সাম্প্রতিক সময়ে সাফল্যের পথে একধাপ এগিয়েছেন। অক্ষিগোলকের মতো অর্ধগোলাকৃতির একটি বস্তুতে বিজ্ঞানীরা থ্রিডি প্রযুক্তির সাহায্যে লাইট রিসেপ্টরের একটি সজ্জা প্রিন্ট করেছেন। বস্তুটির পৃষ্ঠতল বক্রাকার হওয়া সত্ত্বেও কালি হিসেবে ব্যবহৃত রুপার কণাগুলো এতে সঠিকভাবে অবস্থান করেছে এবং ২৫% সক্ষমতার সাথে তারা আপতিত আলোকে তড়িৎ সংকেতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। সম্পূর্ণ সফলতার মুখ দেখার পথে বিজ্ঞানীদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, বায়োনিক আইয়ের পৃষ্ঠতলকে আরও মসৃণ করে তোলা ও আরও অধিক সংখ্যক রিসেপ্টরকে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করতে পারা।
প্রোস্টেট ক্যান্সারের উন্নততর বিশ্লেষণ
হাই গ্রেড প্রোস্টেট ক্যান্সার কখনও কখনও প্রাণঘাতী হতে পারে এবং লো গ্রেড রোগীদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মাঝে থাকতে হয়। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, টেস্টোস্টেরোনভিত্তিক জীনগত ত্রুটি প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রোস্টেট ক্যান্সার রোগীদের মাঝে যারা HSD3B1 জিনে ত্রুটি বহন করছেন (ভ্যারিয়েন্ট), তাদের ক্ষেত্রে অ্যাবিরাটেরোন (প্রোস্টেট ক্যান্সার চিকিৎসায় সর্বাধিক ব্যবহৃত ওষুধ) প্রয়োগের ফলাফল খুবই হতাশাজনক। অন্যদিকে যেসব রোগীর জেনেটিক ম্যাপে সুনির্দিষ্ট এই জীনটির অস্বাভাবিকতা নেই, তাদের ক্ষেত্রে একই ওষুধ বেশ আশাব্যঞ্জক ফলাফল প্রদর্শন করে। একই ওষুধ, একই ধরনের ক্যান্সারে ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে জিনগত পার্থক্যের দরুন যখন ভিন্ন ফলাফল বয়ে আনে, তখনই চলে আসে পার্সোনালাইজড মেডিসিনের প্রসঙ্গটি।
ক্যান্সার একটি সুনির্দিষ্ট ধরনের অসুখ হলেও নির্ভর করে আক্রান্ত প্রত্যেক রোগীর শরীরের মাইক্রোএনভায়রনমেন্টের উপর। তাই যেকোনো ওষুধ সম্পর্কে নির্দেশনার আগে সম্ভব হলে অবশ্যই জেনেটিক ম্যাপিং করে নেওয়া উচিৎ। সম্প্রতি উদ্ভাবিত নতুন একটি পদ্ধতির কল্যাণে কোনো বায়োপসি ছাড়া শুধু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
অ্যাপ থেকেই জানা যাবে ক্যান্সারের পূর্বাভাস
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক একটি মেশিন লার্নিংভিত্তিক অ্যালগরিদম তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে চোখের সাদা অংশ অর্থাৎ স্ক্লেরার বিশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার সম্পর্কে মন্তব্য করা সম্ভব হবে। একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডফোনের মতো দেখতে ডিভাইস দরকার হবে। গ্রাহক একটি সেলফি তুলবেন এবং সেই সেলফিটি অ্যাপ তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিশ্লেষণ করে স্ক্লেরাতে বিদ্যমান বিলিরুবিনের পরিমাণ জানিয়ে দেবে।
রক্তের লোহিত কণিকার ভাঙনের ফলে বিলিরুবিন উৎপন্ন হয়, জন্ডিস রোগীদের ক্ষেত্রে যেটির অত্যধিক উপস্থিতি ত্বক এবং চোখের সাদা অংশের হলুদ রঙ ধারণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চোখের সাদা অংশে উপস্থিত বিলিরুবিনের পরিমাণ নির্ণয় করে অ্যাপটি অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার সম্পর্কে আভাস দিতে পারবে।
রক্তচাপ নির্ণয় যখন একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট
রক্তচাপ মাপা মানেই যেন কিছুটা ঝক্কি পোহানো; স্টেথেস্কোপ, কাফ নিয়ে বসে স্থির হয়ে বসে থাকা। নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে খামের কোণে লাগানো স্ট্যাম্পের চেয়েও ছোট একটি প্যাচ শরীরে লাগানো থাকবে যেটি দিব্যি করতে পারবে রক্তচাপ নির্ণয়ের কাজটি। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান ডিয়েগোর একদল গবেষক কর্তৃক আবিষ্কৃত এই প্যাচটি যেকোনো আঙুলে অথবা গলায় লাগিয়ে রাখা যেতে পারে। প্যাচটি আলট্রাসনিক তরঙ্গের মাধ্যমে কাজ করে।
এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রথম পরিধানযোগ্য ডিভাইস, যেটি মানুষের ত্বক ভেদ করে কোষ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। প্রেরণকৃত শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারকারীর রক্ত ও কোষসমূহে প্রতিফলিত হয়ে ফেরত আসবে। এই গৃহীত তথ্যাদি সংযুক্ত ল্যাপটপে পাঠানো হলে সেখানেই প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ণীত হবে রক্তচাপ। প্রাথমিকভাবে এই প্যাচটিকে একটি ল্যাপটপ ও শক্তি উৎসের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে, তবে পরবর্তীতে আরও উন্নয়নের মাধ্যমে এটি আরও গ্রাহক বান্ধব হয়ে উঠবে।
তড়িৎ সংকেত এখন সারাবে অসুখ
তড়িৎ শক্তিকে ওষুধ অর্থাৎ রোগের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহারের সর্বপ্রথম উদাহরণ হলো পেসমেকার। শরীরে কৃত্রিম উপায়ে সংস্থাপিত কার্ডিয়াক পেসমেকার হৃদপিণ্ডের অবিরাম ছন্দ তৈরির কাজটি করে থাকে তড়িৎ সংকেতের মাধ্যমে। সম্প্রতি তড়িৎশক্তিকে রোগের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা আরও এক ধাপ এগিয়েছেন।
ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন নামক এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্কে স্থাপিত পেসমেকারটি উৎপন্ন করবে ইলেকট্রিক ইমপালস। ইতিমধ্যে এই প্রযুক্তিটি স্ট্রোক, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (শুচিবায়), পার্কিনসন্স ডিজিজ, অ্যালঝেইমারস ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের স্মৃতি, চিন্তন ও সমন্বয় দক্ষতা, বিচারিক দক্ষতার উন্নয়ন সাধনে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো-
১) হাতের মুঠোয় ডায়াবেটিস (ইতিহাস, লক্ষণ, চিকিৎসা, ব্যায়াম ও ফিজিওথেরাপি)
২) মাথায় যত প্রশ্ন ঘোরে