সুস্থ থাকতে হলে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত: ডা. দেবী শেঠী

ডা. দেবী শেঠী, সারা ভারত যাকে এক নামে চেনে, সেই বিশ্বখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে ভারতের হেনরি ফোর্ড বলা হয়। তার নারায়ণালয় ভারতের হৃদরোগ চিকিৎসাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। সময় ও অর্থ সাশ্রয় আর সেবাদানের মহান উদ্যোগে ব্রতী এই ডাক্তার WIPRO আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, যেখানে তাদের কর্মীদের সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয়। সেই প্রশ্নোত্তর পর্ব নেটিজেনদের কাছে বেশ আলোচিত হয়। আজ সেই প্রশ্নোত্তরগুলো নিয়েই এই লিখাটি।  

ডা. শেঠীকে বলা হয় হার্ট সার্জারির হেনরি ফোর্ড; Image Source: Deccan Chronicle

হৃদপিন্ড আমাদের মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। একজন সাধারণ মানুষ তার নিজের হৃদযন্ত্রের যত্ন নেয়ার জন্য কী করতে পারেন?

  • ডায়েট: শর্করা জাতীয় খাবার কম, প্রোটিন বেশি এবং যতটা সম্ভব কম তেল।
  • ব্যায়াম: দৈনিক জোরে আধঘন্টা করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন হাঁটা, লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার, সম্ভব হলে নিকট দূরত্ব হেঁটে চলাচল এবং পারতপক্ষে দীর্ঘক্ষণ স্থবির বসে থাকা পরিহার করা।
  • ধূমপান ত্যাগ করা।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখা।
  • উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা ও ডায়াবেটিস থাকলে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা

আমরা কি আমাদের চর্বিকে পেশিতে রুপান্তর করতে পারি?

এটা প্রচলিত ভয়ানক ধারণাগুলোর মধ্যে একটি। চর্বি চর্বিই, দেহের জন্য অত্যন্ত বাজে। পেশি আর চর্বির গঠন, টিস্যু এসব আলাদা। চর্বিকে পেশিতে রূপ দেয়ার ধারণাটি একটি মিথ্যা গুজব।

একটা ব্যাপার খুবই ভয়ের যে, আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ-সবল মানুষও আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং কোনো লক্ষণ ছাড়াই। এই ব্যাপারটা আসলে কী? 

হ্যাঁ, এটাকে আমরা আসলে ‘সাইলেন্ট অ্যাটাক’ বলে থাকি। আর সেজন্যই আমরা বয়স ত্রিশের বেশি এমন সবাইকে উপদেশ দিয়ে থাকি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে। ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের এটা মাথায় রাখা উচিত। 

অনেকেই বলে থাকেন, হৃদরোগ ব্যাপারটা বংশানুক্রমিক। আসলেই কি তা-ই?

 হ্যাঁ। হৃদরোগ ব্যাপারটা বংশানুক্রমিক।

হাঁটা না জগিং- কোনটা বেশি ভালো? নাকি অধিকতর তীব্র ব্যায়ামগুলো হৃদযন্ত্রের জন্য বেশি ভালো?

দুইয়ের মধ্যে সব দিক দিয়ে হাঁটাই ভালো। জগিং করলে আপনি অল্প সময়ে হাঁপিয়ে যাবেন। এছাড়াও পায়ের গোড়ালি ও হাঁটুর উপর বাজে প্রভাব পড়ে। জোরে হাঁটলে আপনি হৃদযন্ত্রের জন্য যতটা উপকার আশা করেন জগিং থেকে তার সবটাই পাবেন, উল্টো এর কোনো বাজে দিক নেই।

দরিদ্র ও অভাবী জনগণের জন্য আপনি অনেক করেছেন এবং এখনো করছেন? এই ব্যাপারে আপনার অনুপ্রেরণা কী?

খুব সহজে বললে, মাদার তেরেসা। তিনি আমার রোগী ছিলেন।

ডা. শেঠীর অনুপ্রেরণা মাদার তেরেসা, যিনি তাঁর রোগী ছিলেন; Image Source: Reader’s Digest

যারা নিম্ন রক্তচাপে ভোগেন, তারাও কি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারেন?

ব্যাপারটা খুবই বিরল বলা যায়।

কোলেস্টেরল কি ছোটবেলা থেকে জমা হওয়া শুরু হয়? নাকি পরিণত বয়সে বা ত্রিশের পর জমা শুরু হয়?

না, তা নয়। কোলেস্টেরল ছোটবেলা থেকেই নালীগাত্রে জমতে থাকে, এর জন্য পরিণত বয়স লাগে না।

অনিয়মিত ও বাজে খাদ্যাভ্যাস কি হৃদপিন্ডের উপর কোনো বাজে প্রভাব ফেলে থেকে?

যদি আপনি ভাজাপোড়া জাতীয় বিভিন্ন তৈলাক্ত খাবার খান বা এগুলোকেই ‘অনিয়মিত’ বুঝিয়ে থাকেন, তবে হ্যাঁ, এগুলো আপনার হৃদযন্ত্রের উপর বাজে প্রভাব ফেলে।

অন্য ডাক্তারদের মতো তাঁরও পরামর্শ জাংক ফুড বর্জন করার; Image Source: FoodNavigator-Asia.com

ঔষুধের সাহায্য ছাড়া কীভাবে আমরা কোলেস্টেরল কমাতে পারি বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি?

আপনার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন, সুষম খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন আর নিয়মিত হাঁটুন। খাদ্যতালিকায় বাদাম জাতীয় খাবার রাখুন। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

খুব সোজা ভাষায় হৃদযন্ত্রের জন্য কোন খাবারগুলো ভালো আর কোনগুলো খারাপ?

ফল ও শাকসবজি হচ্ছে সবচেয়ে ভালো, আর সবচেয়ে খারাপ বলতে গেলে তেল।

কোন তেল সবচেয়ে ভালো- সয়াবিন, অলিভ ওয়েল নাকি সরিষা?

সব তেলই খারাপ, বিশেষত আমরা যেভাবে খাই!

নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা বলতে আসলে কী কী পরীক্ষা করাতে হবে? আপনি কি বিশেষ কিছু বলতে চান?

সাধারণ রক্ত পরীক্ষা, যেগুলোর দ্বারা আপনি বুঝতে পারবেন আপনার সুগার নিয়ন্ত্রণে কি না, ইসিজি, সামর্থ্য থাকলে ট্রেডমিল টেস্ট ও ইকোকার্ডিওগ্রাম। আর হ্যাঁ, রক্তচাপও পরিমাপ করাতে হবে।

হার্ট অ্যাটাক হলে প্রাথমিকভাবে কী করা উচিত?

ব্যক্তিকে আগে শোয়ান এবং তার জিহবার নিচে অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষুধ দিন। খুব দ্রুত নিকটস্থ কোনো করোনারি ইউনিটে নিয়ে যান। মনে রাখবেন, মোটামুটি বড় ক্ষতিটা একঘন্টার মাঝেই হয়, আর এক্ষেত্রে সময় মহামূল্যবান। তাই কোনোভাবেই সময় নষ্ট করবেন না।

আমরা হার্ট অ্যাটাকের জন্য বুকের ব্যথা আর গ্যাসের জন্য বুকের ব্যথার মধ্যে কীভাবে ফারাক করবো?

অনেক ডাক্তারের জন্যেও ব্যাপারটা কঠিন, যদিও অভিজ্ঞ ডাক্তাররা প্রায়ই সঠিক অনুমান করতে পারেন। ইসিজি ছাড়া বোঝা মুশকিল। আর তাছাড়া এটা নিজেরা না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

তরুণ প্রজন্মের মাঝে হৃদরোগ বাড়ছে, আপনার মতে এর কারণ কী?

আমি ৩০-৪০ বছর বয়সের অনেকের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া ও জটিল নানা জিনিস দেখি। আলসে জীবনযাত্রা, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, নেশা, ভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড ইত্যাদিই মূল কারণ। আপনি জেনে অবাক হবেন, আমরা জাতিগতভাবেই ইউরোপিয়ানদের চেয়ে তিনগুণ বেশি হৃদরোগের ঝুঁকিতে।

একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে কি ১২০/৮০ এর বাইরে রক্তচাপ থাকার পরেও তার সুস্থ থাকা সম্ভব?

হ্যাঁ, সম্ভব।

এটা কি সত্য যে, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ হলে সেক্ষেত্রে সন্তানের হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে?

হ্যাঁ, এটা প্রায়ই হয় এবং অবৈজ্ঞানিক কিছু না।

চাপমুক্ত থাকাও সুস্থতার জন্য অতি জরুরি; Image Source: Indea.me

আমরা অনেকেই অনিয়মিত জীবনযাপন করি, রাত জাগি। এগুলো কি হৃদযন্ত্রের জন্য খারাপ?

আপনি যখন বয়সে তরুণ, প্রকৃতিই আপনাকে এসব অনিয়মিত জীবনের কুপ্রভাব থেকে আপনাকে প্রতিরক্ষা দেয়। কিন্তু যখন বয়স বাড়বে, নিজের দেহঘড়িকে সম্মান করুন ও যত্ন নিন।

উচ্চ রক্তচাপের ঔষুধের কি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?

হ্যাঁ, প্রায় সব ঔষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তবে আধুনিক উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধী ঔষধগুলো বেশ নিরাপদ।

অ্যাসপিরিন ও মাথাব্যথার ঔষধগুলো কি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়?

না।

রাতজাগা কর্মীদের কি হৃদরোগের ঝুঁকি দিনের কর্মীদের চেয়ে বেশি হয়?

না।

ডায়াবেটিস আর হার্ট অ্যাটাকের মাঝে কি কোনো যোগসূত্র আছে?

হ্যাঁ, অবশ্যই নিবিড় যোগসূত্র আছে। ডায়াবেটিস রোগীদের যাদের সুগার নিয়ন্ত্রণে নেই, তাদের ঝুঁকির মাত্রা বেশি।

সুস্থ থাকার জন্য পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই; Image Source: youtube.com

ব্যস্ত সূচীর মাঝে সেভাবে হাঁটা হয় না, সেক্ষেত্রে কী করা?

সোজা ভাষায় বলি, একটানা বসে থাকবেন না। লাগলে অফিসে এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে যান। কোনো কারণ ছাড়া অন্য ফ্লোরে সিঁড়ি দিয়ে যান। এতেও অনেক কাজ হয়। বাড়িতে টুকিটাকি কাজ করুন, এটাও ভাল।

ইয়োগা কি উপকারী?

হ্যাঁ, অবশ্যই। এটি চাপমুক্ত রাখে, যা হার্টের জন্য উপকারী। 

আমাদের জীবনে নানা চাপ। নানা কারণে আমাদের হৃদযন্ত্র অত্যধিক চাপের মুখোমুখি হয়? একজন ডাক্তার হিসেবে আপনি চাপমুক্ত থাকার জন্য কি উপদেশ দেবেন?

জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। দেখুন, জীবনের প্রতিটা ব্যাপারই যে একদম নিখুঁত হতে হবে, সবই যে সাফল্যমন্ডিত হতে হবে- এমন তো নয়। একটু অন্য আঙ্গিকে দেখুন জীবনটাকে।

ফিচার ইমেজ: smartceo.co

Related Articles

Exit mobile version