কলোরেক্টাল ক্যান্সার (কোলন ক্যান্সার) বা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার একটি ভয়াবহ রোগের নাম। সমগ্র বিশ্বে ক্যান্সারজনিত কারণে মৃত্যুতে প্রথম স্থানটি ফুসফুস ক্যান্সারের দখলে থাকলেও দ্বিতীয় স্থানটি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের। সারা পৃথিবীজুড়ে মার্চ মাসটি কলোরেক্টাল ক্যান্সার বা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার সচেতনতামূলক মাস হিসেবে পালিত হয়। গ্রহণ করা হয় বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচী, যাতে মানুষ প্রতিকার নয়, বরং এই ভয়াবহ রোগটির প্রতিকারে সচেষ্ট হয়।
কলোরেক্টাল ক্যান্সার কী?
কলোরেক্টাল ক্যান্সার বলতে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারকে বোঝানো হয়। এটি রেক্টাম কিংবা কোলন যেকোনো জায়গা থেকেই উৎপন্ন হতে পারে। উৎপত্তির ধরণ অনুসারে এদের নাম রেক্টাম বা কোলন ক্যান্সার হয়ে থাকে। মূলত উভয় ক্যান্সারের ধরণ ও লক্ষণ প্রায় একই। সাধারণত বৃহদান্ত্রে পলিপ সৃষ্টির মাধ্যমে এই রোগের সূচনা হয়।
কেন হয় বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার? আসুন জেনে নেওয়া যাক বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের জন্য দায়ী কারণগুলো সম্পর্কে।
১. বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষদের মাঝে এই রোগের হার বেশি। তবে ৫০ বা ৪০ এর কম বয়সীদের যে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার দেখা যায় না তা কিন্তু নয়। তবে তা খুবই বিরল।
২. পরিবারের কারো বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে তা-ও ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বাবা-মা, সন্তান কিংবা ভাইবোনের বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে আশঙ্কা তুলনামূলক বৃদ্ধি পায়।
৩. গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে পাঁচ বেলা গরু, খাসি কিংবা ভেড়ার মাংস খান, বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তাদেরই বেশি থাকে। এ ধরনের মাংসকে বলা হয় রেড মিট বা লালমাংস।
রেডমিটকে বা লালমাংস শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি উপাদান। এটি শুধু বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারই নয় বরং ওজন বৃদ্ধি, লিভার ক্যান্সার সহ আরো বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণ।
৪. শারীরিক কসরত বা পরিশ্রম না করলে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
৫. ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মাঝে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়। ডায়াবেটিস কতখানি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেটাও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৬. অধিক ওজনসম্পন্ন কিংবা স্থূলকায় ব্যক্তিদের বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
৭. ব্যক্তির খাদ্যনালীর পলিপ বা কোলনের কোনো সমস্যার পূর্বতন ইতিহাস থাকলে তা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৮. শুধুমাত্র ব্রংকাইটিস কিংবা ফুসফুসের ক্যান্সারই নয়, বরং ধূমপানে বাড়ে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের ঝুঁকিও।
৯. নিয়মিত খাদ্যতালিকায় প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, তেল চর্বি ও ভাজাপোড়া খাবারের আধিক্য এবং আঁশজাতীয় খাবার কম থাকলে তা খাদ্যের সঠিক হজম ও পরিপাকে গোলযোগ ঘটায়। বাড়ে পলিপ সহ বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি। শুধু তা-ই নয়, নিয়মিত অ্যালকোহল গ্রহণ বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে সাহায্য করে।
১০. রেডিয়েশন থেরাপি যেমন রোগ নির্ণয় সহ রোগীর বিভিন্ন জটিলতা সমাধানে কাজে লাগে তেমনি এর রয়েছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও। যেমন রেডিয়েশন থেরাপি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এ তো গেলো বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের জন্য দায়ী কারণ এবং ঝুঁকিগুলোর কথা। এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক এর লক্ষণগুলো সম্পর্কে।
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের লক্ষণ
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের প্রথমদিকে তেমন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। তাই প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব সাধারণ যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলো।
১. পেটে ব্যথা ও গ্যাস
পলিপজনিত সমস্যা কিংবা কলোরেক্টাল ক্যান্সারজনিত জটিলতায় প্রাথমিক অবস্থায় পেটে ব্যথা ও গ্যাস দেখা দিতে পারে। কখনো এই ব্যথা ও গ্যাসের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়েও চলে যেতে পারে।
২. মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন ও কোষ্ঠকাঠিন্য
মলত্যাগের অভ্যাসেও আসতে পারে পরিবর্তন। কখনো কখনো মলের ধরণ ও রঙে পরিবর্তন সহ দেখা দিতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্য।
৩. রক্তমিশ্রিত মল
বয়স চল্লিশোর্ধ হলে যদি নিয়মিত রক্তমিশ্রিত মল দেখা যায় তবে দেরি না করে অবশ্যই স্ক্রিনিং করানো উচিত। রক্তমিশ্রিত মল বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
৪. অবসন্নতা
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের আরেকটি উপসর্গ হলো অবসন্নতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী অতি সহজেই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে যান।
৫. মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ
পলিপজনিত প্রদাহ মারাত্মক আকার ধারণ করলে মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারেরও একটি লক্ষণ।
৬. ওজন কমা ও রক্তশূন্যতা
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে ওজন হ্রাস ও রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
৭. ডায়রিয়া
অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে ঘন ঘন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
৮. ঘন ঘন মলত্যাগের ইচ্ছা অনুভূত হওয়া
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর ঘন ঘন মলত্যাগের ইচ্ছা অনুভূত হতে দেখা যায়। এছাড়াও ডায়াবেটিস বৃদ্ধি, কাশির সঙ্গে রক্ত, দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য সহ নানা ধরনের উপসর্গ বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে লক্ষণীয়।
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের চিকিৎসা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের চিকিৎসা হলো অপারেশন। সেটা যে ধাপেই হোক না কেন। পলিপ কিংবা টিউমার থাকলে তা অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করে ফেলাই উত্তম। এছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেমোথেরাপিও দেওয়া হয়। বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার থেকে বাঁচার সবচেয়ে উত্তম ও কার্যকর উপায় হলো প্রতিরোধ। যদিও কোনোভাবেই নিশ্চিত কোনো প্রতিরোধক জানা যায় না, তবে কিছু ব্যাপার বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
১. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা আপনাকে বহু শারীরিক ও মানসিক সমস্যার হাত থেকে বাঁচাবে। বিশেষ করে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে আপনার বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে যাবে।
২. যেসব পশুর মাংসকে রেডমিট বলা হয় তা বহুলাংশে এড়িয়ে চলাই উত্তম। কেননা রেডমিট বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ধরনের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সবচেয়ে ভালো হয় সপ্তাহে তিনবারের চেয়েও কম এ ধরনের খাবার গ্রহণ করলে।
৩. প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আঁশযুক্ত খাবার রাখুন। আঁশ সমৃদ্ধ খাবার হজম ও পরিপাককে সুষ্ঠু করে ফলে বৃহদান্ত্র ও সুস্থ থাকে।
৪. চর্বিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলাই উত্তম। বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধে এটি হতে পারে দারুণ পদক্ষেপ।
৫. নিয়মিত হালকা শারীরিক পরিশ্রম কিংবা অনুশীলন বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধক। দৈনিক কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটাও এক্ষেত্রে খুবই কার্যকর।
৬. অ্যালকোহল গ্রহণ এবং ধূমপান উভয়ই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চেষ্টা করা উচিত যতটুকু সম্ভব পরিত্যাগ করার।
৭. নিয়মিত কোন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করছেন সেদিকে খেয়াল রাখুন। খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে সাহায্য করে। এছাড়াও খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন রসুন, মাছ, মৌসুমী ফল ও শাকসবজির মতো খাবারগুলো।
৮. নিয়মিত স্ক্রিনিং এর কোনো বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের আগেই রোগ নির্ণয় সম্ভব। এতে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে নিরাময় সম্ভব। এছাড়াও মলের সাথে অদৃশ্য রক্ত পরীক্ষা বা Fecal Occult Blood Test (FOBT) এর মাধ্যমে বৃহদান্ত্রের জটিলতা নির্ণয় করা সম্ভব। ৪৫ বছরের বেশি বয়স্ক সব মানুষের এক বছর পর পর এই পরীক্ষাটি করা উচিত। এছাড়াও কলোনস্কপির মাধ্যমে বৃহদান্ত্রের সব অংশকে দেখা যায় এবং পলিপসহ যেকোনো ধরনের জটিলতা নির্ণয় করা যায়। ৪৫ বা তার উর্ধ্ব বয়সী সবার কমপক্ষে প্রতি ৫ বছর অন্তর একবার কলোনস্কপি করা উচিত।
কলোরেক্টাল ক্যান্সার বা বৃহদান্ত্রের একধরনের নীরব ঘাতক। তবে সচেতনতা এই ঘাতকের হাত থেকে বাঁচার প্রধান উপায়। সঠিক জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস আর নিয়মিত স্ক্রিনিং এই রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে অনেকখানিই। সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে সর্বস্তরে। কেননা প্রতিকার নয়, বরং প্রতিরোধই বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের প্রধান দাওয়াই।
ফিচার ইমেজ: Everyday Health