নাবিল সপ্তম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী। অন্যান্য বিষয় বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করতে পারলেও গণিতে সে ভীষণ রকমের কাঁচা। নাবিলের ভাষ্যমতে, গণিত বিষয়টি তার মাথায়ই ঢুকতে চায় না! কোনো রকমে বইয়ের দু-চারটে গাণিতিক সমস্যার সমাধান মুখস্ত করে পরীক্ষায় বসে; ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়।
এহেন কার্যকলাপের জন্য বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে সে। তাকে অমনোযোগী আখ্যা দিয়ে মা-বাবাকে তিরস্কার করেছেন তিনি। এদিকে মা-বাবাও তাকে অমনোযোগী, দুষ্টু ও ভবিষ্যত নিয়ে উদাসীন মনে করছে। কিন্তু নাবিলের সমস্যাটা কেউ বুঝতেই চাইছে না। বারবার চেষ্টা করার পরও তাকে দফায় দফায় সবার বকাঝকা শুনতে হচ্ছে।
নাবিলের মতো অনেক কিশোর-কিশোরীই কৈশোরে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকে। এর নাম ডিসক্যালকুলিয়া বা অঙ্কে অক্ষমতা। এটি একটি নিউরো-কগনিটিভ সমস্যা।
ডিসক্যালকুলিয়া কী?
সংখ্যা সম্বন্ধীয় সাধারণ তথ্য বা গণিতের পদ্ধতি মনে রাখতে না পারা, ধীরগতিতে অঙ্ক করা ইত্যাদি শিক্ষা সম্বন্ধীয় বিকারকে ডিসক্যালকুলিয়া বলা হয়। ডিসক্যালকুলিয়া অাক্রান্ত শিশুদের প্রধান সমস্যা হলো গণিতের মূল ধারণা অনুধাবন করতে না পারা। গণিত কীভাবে কাজ করে তা অনুধাবন করতে তাদের সমস্যা হয়। তাদের কেউ কেউ হয়তো গণিতে কী করতে হবে তা শিখতে পারে, কিন্তু এটা বুঝতে পারে না যে কেন করতে হবে। অর্থাৎ তারা পেছনের যুক্তি বুঝতে পারে না। আবার কেউ কেউ গণিতের পেছনের যুক্তি বুঝতে পারলেও তা কখন ও কোথায় ব্যবহার করতে হবে তা নির্ণয় করতে পারে না। মনে রাখা দরকার, এসব শিশু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয়। ধারণা করা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ৫-৭ শতাংশের মধ্যে ডিসক্যালকুলিয়া থাকতে পারে।
প্রত্যেক শিশু নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী পড়াশোনা শেখে। শিক্ষকের বাড়তি প্রচেষ্টা আর নিয়মিত অনুশীলন সত্ত্বেও যদি কোনো শিশু গণিতে যথাযথ উন্নতি না করে বা সমস্যার অবনতি ঘটে, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে শিশুটি ডিসক্যালকুলিয়ায় ভুগছে।
শ্রেণীবিন্যাস
ডিসক্যালকুলিয়া রোগটির অাবিষ্কর্তা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ডাক্তার লেডিস্লাভ কস্ক একে উপসর্গের ভিত্তিতে ছয়টি প্রকরণে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো:
১. ভার্বাল ডিসক্যালকুলিয়া
অাক্রান্ত ব্যক্তির কথ্যভাষায় উপস্থাপিত গাণিতিক যুক্তি বা চিহ্নগুলো বুঝতে অসুবিধা হয়। অর্থাৎ তারা মূদ্রিত গাণিতিক সংখ্যা ও চিহ্ন পড়তে এবং লিখতে পারলেও কথায় প্রকাশ করতে বা বুঝতে পারেন না। যেমন: ভার্বাল ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত একজন ব্যক্তি বইয়ে মূদ্রিত ‘৭’ সংখ্যাটি দেখে চিনতে পারলেও তার সামনে “সাত” শব্দটি উচ্চারণ করা হলে তা দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে তা তিনি অনুধাবন করতে পারবেন না।
২. প্রাক্টোগনস্টিক ডিসক্যালকুলিয়া
অাক্রান্ত ব্যক্তি সংখ্যাজ্ঞানের সাথে বাস্তব জীবনের উপমার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না। তারা সাধারণ সংখ্যা, চিহ্ন এবং ধারণার সাথে পরিচিত হলেও বাস্তব জীবনে ঘটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম হন। যেমন: প্রাক্টোগনস্টিক ডিসক্যালকুলিয়ায় একজন ব্যক্তি ৩টি কলা এবং ৩টি লেবু সমান সংখ্যক কি না, তা বুঝতে পারবেন না।
৩. লেক্সিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া
অাক্রান্ত ব্যক্তির গাণিতিক সংখ্যা, চিহ্ন এবং সমীকরণ পড়তে এবং অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়। গাণিতিক বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকলেও গাণিতিক সংখ্যা অনুধাবনের বেলায় তাদের অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন: লেক্সিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত একজন ব্যক্তির সামনে “সাত” শব্দটি উচ্চারণ করা হলে তা দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে তা তিনি অনুধাবন করতে পারলেও বইয়ে “৭” সংখ্যাটি দেখে চিনতে বা পড়তে পারবেন না।
৪. গ্রাফিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া
অাক্রান্ত ব্যক্তির গাণিতিক সংখ্যা, চিহ্ন এবং সমীকরণ লিখতে অসুবিধা হয়। গাণিতিক বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকলেও গাণিতিক প্রতীকগুলো লেখার বেলায় তাদের অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন: গ্রাফিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত একজন ব্যক্তির সামনে “সাত” শব্দটি উচ্চারণ করা হলে বা ৭ সংখ্যাটি লেখা থাকলে তা দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে তা তিনি অনুধাবন করতে পারলেও নিজে ৭ সংখ্যাটি লিখতে পারবেন না।
৫. ইডিওগনোস্টিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়া
অাক্রান্ত ব্যক্তির বিভিন্ন গাণিতিক বিষয় সম্পর্কে ধারণার অস্পষ্টতা দেখা যায়। সাধারণভাবে গাণিতিক সংখ্যা, প্রতীক ও চিহ্ন বুঝতে পারলেও বিভিন্ন গাণিতিক যুক্তি ব্যাখ্যা করতে তারা অসমর্থ হন। যেমন: ইডিওগনোস্টিক্যাল ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত একজন ব্যক্তি বিভিন্ন সংখ্যা, প্রতীক লিখতে ও বুঝতে পারলেও গড়, শতকরা, লগারিদমের মতো গাণিতিক বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারেন না।
৬. অপারেশনাল ডিসক্যালকুলিয়া
অাক্রান্ত ব্যক্তির কথ্য অথবা লেখ্য ভাষায় প্রকাশিত গাণিতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে অসুবিধা হয়। সাধারণভাবে গাণিতিক সংখ্যা, প্রতীক ও চিহ্ন বুঝতে পারলেও সমীকরণ সমাধানের সময় বিভিন্ন সংখ্যা ও প্রতীকের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে তাদের অসুবিধা হয়। যেমন: অপারেশনাল ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত একজন ব্যক্তি গাণিতিক সমীকরণবিশিষ্ট কোনো সমস্যা সমাধানের সময় ৫ এর বদলে ৭ লিখে ফেলতে পারেন
ইতিহাস
ডিসক্যালকুলিয়া শব্দের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৪৯ সাল থেকে। এই শব্দটি গ্রিক শব্দাংশ ‘dys’ (যার অর্থ খারাপ) এবং ল্যাটিন শব্দ ‘calculare’ (যার অর্থ গণনা করা) এর সমন্বয়ে গঠিত, যার সামষ্টিক অর্থ ‘খারাপভাবে গণনা করা’।
ডিসক্যালকুলিয়ার ইতিহাস বেশ নতুনই। এটি যে একটি শিখন অক্ষমতা তা সর্বপ্রথম সবার গোচরে অানেন ডাক্তার কস্ক, ১৯৭৪ সালে। তিনি ডিসক্যালকুলিয়াকে ছয়টি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। ২০০০ সালে ডেভিড গিয়ারী ও তার সহকর্মীরা “mathematical disabilities” শব্দটি ব্যবহার করেন এবং একে তিনটি উপশ্রেণীতে (Semantic, Procedural এবং Visual-spatial Memory) বিভক্ত করেন। গিয়ারি দেখান, যেসব শিক্ষার্থী উডকক-জনসন ম্যাথমেটিক্স রিজনিং টেস্ট নামক এক বিশেষ পরীক্ষায় ৩৫ শতাংশের কম নম্বর পেয়ে অাসছে, তাদের ডিসক্যালকুলিয়া হয়েছে বা হওয়ার অাশঙ্কা রয়েছে।
কারণ
ঠিক কী কারণে ডিসক্যালকুলিয়া হয় তা এখনো গবেষকদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১) জিনগত কারণ
বিভিন্ন জিনগত ব্যাধি, যেমন: টার্নারস সিনড্রোম, ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম, ভেলোকার্ডিওফেসিয়াল সিনড্রোম, উইলিয়াম’স সিনড্রোমের কারণে শিশুদের মধ্যে ডিসক্যালকুলিয়া দেখা দিতে পারে।
২) পরিবেশগত কারণ
গর্ভাবস্থায় মায়ের মদ্যপান কিংবা মাদকদ্রব্য গ্রহণ নবজাতকের ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত হওয়াকে ত্বরান্বিত করে।
৩) রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন মানসিক বৈকল্য, যেমন: ADHD, ডিসলেক্সিয়া, ডিসপ্রেক্সিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও ডিসক্যালকুলিয়া হতে পারে।
উপসর্গ
নিচের উপসর্গগুলো দেখলে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে:
স্কুল শুরু হওয়ার আগে
- সংখ্যা গণনা করতে অসুবিধা হওয়া।
- একই বয়সের অন্য শিশুদের তুলনায় সংখ্যা মনে রাখতে সমস্যা হওয়া।
- সংখ্যার প্রতীকগুলো (১, ২, ৩…) বুঝতে অসুবিধা হওয়া।
- বইয়ে মূদ্রিত সংখ্যা চিনতে অসুবিধা হওয়া।
- সংখ্যার প্রতীক ও কথায় লিখিত রূপের মধ্যে সামঞ্জস্য করতে না পারা।
- সংখ্যাজ্ঞানের সাথে বাস্তব জীবনের উপমার সম্পর্ক স্থাপন না করতে পারা। যেমন: ৩টি কলা, ৩টি লেবু ও ৩টি শিশু সমান সংখ্যক কি না, তা বুঝতে না পারা।
- বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন, আকার বা সংখ্যাগত ছন্দের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারা। যেমন: এক বাক্সে রাখা গোল বল আর চৌকো টুকরোকে আকার অনুযায়ী আলাদা আলাদা বাক্সে রাখতে না পারা।
স্কুলের প্রাথমিক এবং মধ্যস্তরে
- সংখ্যা এবং চিহ্ন চিনতে না পারা।
- সাধারণ গাণিতিক প্রক্রিয়াসমূহ, যেমন: যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে না পারা।
- শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে না পারা।
- কোনো বস্তুর পরিমাপ, যেমন: দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নির্ণয় করতে না পারা।
- সময় বলতে অসুবিধা হওয়া।
- মৌখিক গণিত বা মানসাংক করতে সমস্যা হওয়া।
- টেলিফোন নাম্বার মনে রাখতে অসুবিধা হওয়া।
- মাধ্যমিকে পড়েও ছোট ছোট যোগ-বিয়োগের জন্য হাতের ব্যবহার করা।
- সংখ্যা সংক্রান্ত, বা যুক্তি এবং পরিকল্পনা প্রয়োজন এমন কোনো খেলায় অংশগ্রহণ না করা।
প্রাপ্তবয়স্ককালে
- দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ বা যোগ করতে না পারা।
- উচ্চ পর্যায়ের গাণিতিক সমস্যা বুঝতে না পারা।
- টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে না পারা।
- স্থান, কাল এবং দূরত্বের সংজ্ঞা বুঝতে না পারা।
- একই সমস্যার বিভিন্ন সমাধান বের করতে না পারা।
- দূরত্ব আর গতির অনুমান করতে হয় এমন খেলা এবং গাড়ি চালানোর মতো কাজ করতে না পারা।
রোগ নির্ণয়
একটি শিশুর ডিসক্যালকুলিয়া হয়েছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য খুব একটা সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই। তাই বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে পরীক্ষা করানোই সর্বোত্তম পন্থা। মূলত বয়সের অনুপাতে শিশুর কগনিটিভ অ্যাবিলিটি যাচাইয়ের মাধ্যমে এই রোগটি নির্ণয় করা হয়। এছাড়াও ব্রায়ান বাটারওয়ার্থের ডিসক্যালকুলিয়া স্ক্রিনারের মাধ্যমেও সুফল পাওয়া যায়।
করণীয়
খেলার ছলে অঙ্ক বোঝানো: শিশুকে সাধারণ জিনিস, যেমন: ফল, সবজি, বাসন, খেলনা ইত্যাদির সাহায্যে সংখ্যার ধারণা বোঝানো যেতে পারে। যেহেতু অঙ্ক সাধারণ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই শিশুকে টাকা-পয়সার হিসাব, সময় ও গতির সঙ্গে গণিতের সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
উৎসাহ এবং সহযোগিতা প্রদান: শিশুর ভালো বৈশিষ্ট্য এবং গুণ নিয়ে তার সাথে কথা বলতে হবে। নিজের পছন্দসই কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে তার অাত্মবিশ্বাস বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
ডিসক্যালকুলিয়া সম্পর্কে সচেতনতা: যেকোনো শিখন অক্ষমতার ব্যাপারে সচেতনতাই সেটি নিরাময়ের প্রধান পূর্বশর্ত। তাই অভিভাবকের উচিত শিশুকে বোঝানো, যে তার সমস্যা সম্পর্কে তারা সচেতন অাছেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তা কামনা: অভিভাবকের উচিত শিক্ষকদেরকে শিশুর সমস্যার কথা জানিয়ে সাহায্য চাওয়া। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হিসেবে ডিসক্যালকুলিয়ায় অাক্রান্ত শিশুর কিছু বিশেষ সুবিধা প্রাপ্য। এগুলো হলো- পরীক্ষায় একটু বেশি সময় প্রদান কিংবা ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সুযোগ প্রদান ইত্যাদি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া: যেকোনো ধরনের শিখন বৈকল্য শিশুর ব্যক্তিত্ব এবং আত্মবিশ্বাসকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।ফলে সে উদ্বেগ এবং মানসিক চাপে ভুগতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাকে এই সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারবেন।