‘X’ (ছদ্মনাম) এর বয়স চৌত্রিশ, একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত অাছেন পাঁচ বছর ধরে। সওদাগরী চাকরি, তাই খুব সকাল সকাল দুটো খাবার মুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়েন তিনি। এরপর সারাদিন চলে এদিক-ওদিক দৌড়ঝাপ। অতঃপর নিশুতি রাতে বাসায় প্রত্যাবর্তন। স্ত্রী অার একমাত্র কন্যাকে তাই বেশি সময় দেয়া হয়ে ওঠে না অার।
রোজকার এই রুটিনে রয়েছে অারেকটি অভ্যাস। সেটি হলো উদ্বেগে ভোগা। ‘X’-কে দেখলেই বোঝা যায়, এক ভয়াবহ দুশ্চিন্তা ভর করে অাছে তার মাথায়। অার কারণগুলোও খুব তুচ্ছ, ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকরও।
এই ক্রমাগত উদ্বেগের কারণে তাকে সব সময় বিরক্ত আর খিটখিটে দেখায়। সারারাত ঘুমানোর পরেও সকালে উঠে তার ক্লান্ত লাগে। অার অফিসে ছোট ছোট কারণে রেগে যান তিনি, যা প্রকাশ করতে না পেরে বাড়ি ফিরে পরিবারের ওপর ঝাড়েন। সেই সাথে চেহারাও ধারণ করেছে জীর্ণ দশা। তাই বয়সটা মাত্র চৌত্রিশ হলেও প্রথম দর্শনে অশীতিপর বৃদ্ধ ভেবে ভুল করে অনেকেই।
‘X’ এর এই অবস্থায় শংকিত হয়ে তার স্ত্রী তাকে একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলেন। মনোবিদের সঙ্গে অালাপচারিতায় ‘X’ স্বীকার করলেন যে, সঠিক সময়ে কাজ শেষ করার চাপে বিহ্বল হয়ে পড়ার কারণে ছোট ছোট কারণে রেগে যাচ্ছেন তিনি। ‘X’ এর কাছ থেকে উপসর্গের বিস্তারিত বর্ণনা শুনে মনোবিদ জানালেন তিনি জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (GAD) ব্যধিতে অাক্রান্ত।
GAD কী?
গোটা জীবনে কখনোই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা কিংবা দুশ্চিন্তায় ভোগেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। তাই এই অনুভূতিগুলোকে মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বললেও খুব একটা ভুল হবে না। আমরা সকলেই জীবনের কোনো না কোনো মূহূর্তে উদ্বেগ অনুভব করেছি। হোক তা পরীক্ষার হলে, ইন্টারভিউয়ের বোর্ডে কিংবা বিয়ের পিড়িতে।
এ ধরনের উদ্বেগ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক। কেননা এটি মস্তিষ্কের একটি প্রতিরক্ষা কৌশল, যা অামাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক হতে সাহায্য করে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির উদ্বেগের মাত্রা এবং তীব্রতা স্বাভাবিক অবস্থাকে ছাড়িয়ে গেলে সেটিই নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অার তখন উদ্ভুত হয় এক নতুন পরিস্থিতির, যার নাম জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার।
এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বিনা কারণে দীর্ঘ সময় ধরে প্রবল উৎকণ্ঠা বা উদ্বিগ্নতা অনুভব করেন। বিনা কারণে অনুভব করা উদ্বেগ অহেতুক জানা সত্ত্বেও রোগী আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। যেমন- প্রাত্যহিক কাজ, যা তিনি প্রতিনিয়ত করেন, অথচ সেই কাজগুলো নিয়ে উৎকণ্ঠা অনুভব করেন সবসময়।
কারণ
ঠিক কী কারণে একজন ব্যক্তি GAD এ অাক্রান্ত হন, সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলাটা বেশ কঠিন। তবে গবেষকদের গবেষণায় সংক্রমণের পেছনে কিছু নিয়ামক বা রিস্ক ফ্যাক্টরের প্রভাব খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলো হলো-
মস্তিষ্কের গঠন
মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা ভয়ের প্রতি সাড়া প্রদানের কাজটি সম্পাদন করে। কোনো কারণে এই অ্যামিগডালা মাত্রাতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে উঠলে GAD এর লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের ডান পুটামেন অংশে গ্রে ম্যাটারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেও এই রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।
মানসিক কারণ
দৈনন্দিন মানসিক চাপ, কর্মক্ষেত্রের চাপ, আর্থিক সমস্যা, অপমান, অবহেলা মানবমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এছাড়াও বিভিন্ন ট্রমাটিক ঘটনা, যেমন- প্রিয়জনের মৃত্যু, অাপনজনের বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেমে ব্যর্থতা, বিবাহবিচ্ছেদ, চাকরিচ্যুতি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। এ থেকে GAD হতে পারে।
শিক্ষণ
উদ্বেগে ভোগাকে অামাদের অাত্মরক্ষার অত্যন্ত পুরনো একটি কৌশল বলা যায়। অনেক সময় অামরা কোনো পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে উদ্বেগে ভুগি। এছাড়াও শিখণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুরা বাবা-মা অথবা অভিভাবকদের উদ্বেগে ভুগতে দেখে GAD এ অাক্রান্ত হয়।
খাদ্যাভ্যাস
অধিক পরিমাণে চা, কফি কিংবা কোমল পানীয় সেবন ঘুমের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে মস্তিস্কে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং তা অতি সহজেই শ্রান্ত হয়ে পড়ে, যা মানব-মনের উদ্বেগ এবং চাপ বাড়িয়ে দেয়।
বংশগতির প্রভাব
পরিবারে আগে থেকে কেউ GAD-তে অাক্রান্ত হয়ে থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।
উপসর্গ
GAD এর উপসর্গগুলোকে মোটাদাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-
১. মানসিক উপসর্গ
মানসিক আলোড়নের কারণে সৃষ্ট GAD উপসর্গগুলো হলো-
- সবসময় বিরক্তি এবং দুশ্চিন্তা অনুভব করা।
- অকারণেই খিটখিটে ভাব প্রদর্শন করা।
- কোনো বিষয় নিয়ে মনে অনেক অাগে থেকেই উদ্বেগের জন্ম নেয়া।
- মন-মেজাজের ভারসাম্যহীনতা।
- কোনো অবস্থায় স্থির থাকতে না পারা।
- কোনো কিছুতেই মনোসংযোগ না করতে পারা।
- শব্দের প্রতি বেশিমাত্রায় সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতা প্রদর্শন করা।
২. শারীরিক উপসর্গ
দেহের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের সিমপ্যাথেটিক অংশ GAD এর শারীরিক উপসর্গের জন্য দায়ী। দৈহিক আলোড়নের কারণে সৃষ্ট উপসর্গগুলো হলো-
পরিপাকজনিত উপসর্গ
- মুখ শুকিয়ে যাওয়া।
- কোনো কিছু গিলতে সমস্যা হওয়া।
- পেটের উপরিভাগে অস্বস্তিবোধ।
- ঘন ঘন মলত্যাগের বেগ পাওয়া।
শ্বাসজনিত উপসর্গ
- নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় অসুবিধা, কষ্টবোধ।
- শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- এমন অনুভূত হওয়া।
হৃদস্পন্দনজনিত উপসর্গ
- বুক ধড়ফড় করা।
- হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যাওয়া।
- বুকে অস্বস্তিবোধ করা।
- হৃদস্পন্দন হারিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে- এমন অনুভূত হওয়া।
জেনিটো-ইউনারি উপসর্গ
- বারবার ব্যস্ততার সাথে মূত্রত্যাগের জন্য ছুটে যাওয়া।
- লিঙ্গের উত্থান ব্যর্থতা।
- মহিলাদের ঋতুস্রাবে সমস্যা।
পেশির টানটান অবস্থাজনিত উপসর্গ
- হাতে-পায়ে কাঁপুনি অনুভব।
- মাথা, ঘাড় এবং পিঠে ব্যথা অনুভব।
- মাংসপেশিতে প্রদাহ এবং অসাড়ভাব।
নিদ্রাজনিত উপসর্গ
- অনিদ্রায় ভোগা।
- ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখা।
- ঘুমের ঘোরে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠা।
চিকিৎসা
১. সাইকোথেরাপি
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT): এই থেরাপিতে একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের সাথে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে রোগীর মনে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা নিরাময়ের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেশন চলাকালে রোগীকে বোঝানো হয় এই অপ্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তা তার দৈনন্দিন জীবনের কতটা ক্ষতি করছে। সেই সাথে নিজের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের সাথে লড়াই করার প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি যোগানো হয়। এটি গর্ভবতী GAD রোগীদের জন্য ফার্স্ট লাইন ট্রিটমেন্ট হিসেবে কাজ করে।
২. ওষুধ
GAD নিরাময়ে মূলত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো-
অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি এজেন্ট: এ সমস্ত ওষুধ রোগীর উদ্বেগ কমিয়ে অানতে সহায়তা করে। এগুলো মূলত বেনজোডায়াজেপিন জাতীয় ওষুধ। Diazepam (Valium) এবং lorazepam (Ativan) এক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অারো কিছু অ্যান্টি অ্যাংজাইটি এজেন্ট হলো alprazolam (Xanax) এবং clonazepam (Klonopin)।
অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টস: কিছু অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট রয়েছে যা দীর্ঘ মেয়াদে সেবন করলে রোগীর বিষণ্নতা হ্রাস পায়। এগুলো হলো buspirone (Buspar), citalopram (Celexa), escitalopram (Lexapro), fluoxetine (Prozac, Prozac Weekly, Sarafem), fluvoxamine (Luvox, Luvox CR), paroxetine (Paxil, Paxil CR, Pexeva), sertraline (Zoloft), venlafaxine (Effexor XR), desvenlafaxine (Pristiq), duloxetine (Cymbalta)।
সেবনের এক সপ্তাহের মধ্যে ওষুধগুলোর কার্যকারিতা শুরু হয়। তবে মনে রাখা উচিত, এসব ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ যেমন- বমি বমি ভাব, ঘুম ঘুম ভাব ইত্যাদি। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এগুলো সেবন করা যাবে না।
করণীয়
প্রতিদিনকার জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন অানলে GAD রোগী সুফল পেতে পারেন। এগুলো হলো-
- নিয়মিত ব্যায়াম এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ।
- রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে (কমপক্ষে ৮ ঘন্টা) ঘুমানো।
- সম্ভব যোগব্যায়াম এবং ধ্যান করা।
- অকারণে দুশ্চিন্তা না করা।
- যেসব খাবার মনকে উত্তেজিত করে তোলে (যেমন: কফি, চা) সেগুলো গ্রহণের সময় সতর্ক থাকা।
- বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্য এবং পরিচিতজনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলা এবং তাদেরকে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা।