![](https://assets.roar.media/assets/8L8ABxeAnTKO0dTd_18-02-05-contraception-prev.jpg?w=1200)
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়িই প্রায় ৬০ বছর আগে থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ কিছুটা হলেও কমানো যায়। হাজারো প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ সারা বিশ্বব্যাপী দম্পতিরা ব্যবহার করছেন এই পদ্ধতি। তবে প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও এই পদ্ধতিতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বেশিরভাগই নারীকেন্দ্রিক। পুরুষদের জন্য থাকা পদ্ধতির পরিমাণ খুবই কম। তবে গবেষকরা পুরুষদের উপযোগী নানা ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা হচ্ছেন। তাদের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আসতে পারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। সেসব নিয়েই এখানের আয়োজন।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী?
এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একজন পুরুষ ও একজন নারী নিয়মিত যৌনমিলন করলেও নারী গর্ভবতী হয় না। গর্ভবতী হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পুরুষের শুক্রাণুকে নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিশতে বাধা দেওয়া হয় কিংবা, নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ু পর্যন্ত আসতে বাধা দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি ছাড়াও আরো অনেক প্রক্রিয়া আছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দুই ধরনের। একটি স্থায়ী আর অন্যটি অস্থায়ী। অস্থায়ী পদ্ধতি পুরুষের জন্য মূলত কনডমেই সীমাবদ্ধ। আর নারীর জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, প্রোজেস্টেরন অনলি পিল, আইইউডি, প্যাচ, ইমপ্ল্যান্ট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি আছে। এগুলোর কোনো কোনোটি স্বল্প মেয়াদে কাজ করে, আবার কোনো কোনোটি দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করে।
স্থায়ী পদ্ধতিতে পুরুষের জন্য করা হয় ভেসেকটমি অপারেশন, যাতে অণ্ডকোষ থেকে শুক্রাণু ইউরেথ্রা (মূত্রনালী) পর্যন্ত আসার রাস্তা কেটে দেওয়া হয়। আর নারীদের জন্য আছে টিউবেকটমি অপারেশন, এতে ফেলোপিয়ান টিউবের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/esD8lS1xqpQ0cWGL_Screenshot_1.png)
সমস্যা
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর প্রকারভেদ থেকে বোঝা যায় এর উন্নতিতে যত কাজ করা হয়েছে সবই ছিল নারীকেন্দ্রিক। তাই এর সমস্যাগুলোতেও নারীদেরই বেশি সম্মুখীন হতে হয়। নিয়ম করে প্রতিদিন একই সময় পিল খাওয়া প্রতিটি নারীর জন্যই অনেক চাপের। ইন্ট্রা ইউটেরিন ডিভাইস বা আইইউডি ব্যবহার করাও নারীদের জন্য ব্যথাদায়ক। তাছাড়া এগুলো হরমোনের মাধ্যমে কাজ করে বলে উচ্চ রক্তচাপ, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যাথাসহ বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে।
অন্যদিকে পুরুষ কনডম ব্যবহার করলেও এতে অপরিকল্পিত গর্ভের সম্ভাবনা থাকে। আর ভেসেকটমি করলে পুনরায় সহজে আর সন্তান নিতে পারবেন না।
![](https://assets.roar.media/assets/bJFh6qUfTiZvMG82_Screenshot_2.png)
সম্ভাবনা
নারীদের উপর জন্ম নিয়ন্ত্রণের চাপ কমানোর জন্য গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্য দরকার ছিল পুরুষদের জন্য সহজে ব্যবহার উপযোগী কোনো পদ্ধতি বের করা। সেই উদ্দেশ্যে গত নভেম্বরের শেষের দিকে একটি পরীক্ষা শুরু করা হয়েছে। এতে পুরুষদের জন্য একপ্রকার জেল ব্যবহার করা হচ্ছে যা জন্ম নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবে। পরীক্ষায় ৪২০ জন তরুণ ও সুস্থ দম্পতিকে ২০ সপ্তাহ ধরে পর্যবেক্ষণ করা হবে। তবে এই জেলটির কাজের ধরন একটু আলাদা।
![](https://assets.roar.media/assets/VbxTIXDFPMC57Srw_4985-19-72p-i1.png)
জেলটি মূলত প্রজেস্টিন ও টেস্টোস্টেরন হরমোনের মিশ্রণে তৈরি। প্রজেস্টিনের বাণিজ্যিক নাম নিস্টোরন। দুই হরমোনকে একত্রে Nes/T বলা হয়। প্রজেস্টিন আগে থেকেই নারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি নারী শরীরের প্রজেস্টেরন হরমোনের একটি কৃত্রিম রূপ। এটি ডিম্বাণুর নিষেক ও গর্ভবতী হওয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
এই উপাদান পুরুষ দেহে শুক্রাণুর সংখ্যা কমিয়ে দেয় এবং একইসাথে টেস্টোস্টেরণের মাত্রাও কমিয়ে দেয়। এতে পুরুষের দেহে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। চামড়ায় ব্রণ হওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
বাইরে থেকে টেস্টোস্টেরন দেওয়া হলে শরীরে হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। একইসাথে শুক্রাণু তৈরিও অনেক কমে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/O2x2zdULTCTFEpiq_5c069ed05930f83774677233-750-500.jpg)
প্রজেস্টিন ও টেস্টোস্টেরন হরমোনের মিশ্রণে তৈরি এই জেলটি দেওয়া হবে পুরুষের পিঠ ও কাঁধে। সেখান থেকে চামড়ার মাধ্যমে শোষিত হয়ে কাজ করবে এটি। বিশ্বের সাতটি দেশের নয়টি স্থানে এর পরীক্ষা চালানো হবে। দেশগুলো হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিলি, ইতালি, কেনিয়া, স্কটল্যান্ড এবং সুইডেন।
প্রাথমিকভাবে শুরুটা হয়েছে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল, ক্যালিফোর্নিয়া ও কানসাস অঞ্চল দিয়ে। প্রথম ২০ সপ্তাহ অন্যান্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাথে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে। এরপর শুক্রাণুর সংখ্যা কমে গেলে পরবর্তী এক বছর দম্পতিদের শুধুমাত্র জেল ব্যবহার করতে বলা হবে। এরপর তারা জেল ব্যবহার করা বন্ধ করে দেবে। তখন আরো ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই সময়ে দেখা হবে শুক্রাণুর সংখ্যা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কোনো প্রভাব পড়ে কিনা।
পুরো গবেষণা প্রক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা করছে এনআইএইচ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব সেবার একটি অংশ হচ্ছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউড অব হেলথ বা এনআইএইচ। তাদের সাথে একত্রে কাজ করছে পপুলেশন কাউন্সিল। এরা একটি অলাভজনক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা। এই গবেষণা প্রক্রিয়া শেষ করতে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। কারণ এটি সফল হওয়ার পর আরো হাজার হাজার মানুষের উপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তারপর ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ-র কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে আসতে হবে। সুতরাং এখনো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।
সমালোচনা
পুরুষদের জন্য এই নতুন প্রক্রিয়া আসার ঘোষণায় নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রশংসা ও আফসোস দুইই করেন। কেউ কেউ বলছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের প্রক্রিয়াগুলোতে অনেক ব্যথা ও কষ্ট সহ্য করতে হয়। অন্যদিকে পুরুষদের জন্য শুধু জেল মাখালেই চলে। এতে তাদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এক নারী টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন, “পুরুষরা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য শুধুমাত্র কাঁধে জেল লাগালেই হবে? না, তোমাদেরকেও আমাদের মতো প্রতি রাতে পিল খেতে হবে, ইনজেকশন নিতে হবে আর ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করতে হবে।”
আরেক নারী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কারণে সৃষ্টি হওয়া তার একটি ক্ষতের ছবি দিয়ে নারীদের জন্যও আরামদায়ক জেলের ব্যবস্থা চান। তবে তাদের জন্য সুসংবাদ হচ্ছে, যারা পুরুষদের জেল নিয়ে কাজ করছেন তারা নারীদের জন্যও এরকম কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। আবার পুরুষদের এই প্রক্রিয়া যদি সফল হয়, তবে নারীদের আর জন্ম নিয়ন্ত্রক না ব্যবহার করলেও হয়তো চলবে।
![](https://assets.roar.media/assets/6saAJuuTpT1HUZXs_Screenshot_4.png)
অন্যদিকে এই পদ্ধতি নিয়ে কিছু সংশয়ও আছে। কারো পক্ষেই তার পিঠ আর কাঁধের অংশ পুরোপুরি জেল দিয়ে মাখানো সম্ভব নয়। তার নারী সঙ্গী যদি জেল লাগিয়ে দিয়ে সাহায্য করে, তাহলে সেই হরমোনের কারণে নারীর কোনো ক্ষতি হবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়। এজন্য শুধুমাত্র জেল মাখানোর পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এই হরমোন চামড়া গলিয়ে শরীরে প্রবেশ না করে যেন।
আবার এটি কনডমের ব্যবহার কমিয়ে দেবে কিনা তা নিয়ে আছে বিতর্ক। কারণ কনডম শুধু জন্ম নিয়ন্ত্রণই করে না, এটি যৌনবাহিত রোগও প্রতিরোধ করে। তাছাড়া সব পুরুষ এই জেল ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে কিনা তারও ঠিক নেই। তাই সমস্যার পাশাপাশি এর সীমাবদ্ধতা নিয়েও কাজ করা জরুরী।
শেষকথা
পুরুষদের জন্য নতুন এই পদ্ধতিতে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও একে নিয়ে এখনই বেশি আশা করা উচিত নয়। কারণ এর আগে পুরুষদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি নিয়েও অনেক আশা করা হয়েছিল, যা কাজ করেনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সার্বিকভাবে যদি সফল হয় জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে।