বিশ্বজুড়ে চলমান মহামারিতে মানুষের জীবনযাপনের ধরনের মধ্যে এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে করোনাভাইরাসে এবং প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। টেলিভিশন এবং অন্যান্য মিডিয়াতে প্রায় সারাক্ষণই প্রচার হচ্ছে এই মহামারির খবরাখবর। অবস্থাটা এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, আজকাল মৃত্যুর সংবাদও মানুষের মনে সংবেদনশীলতা তৈরি করতে রীতিমতো ব্যর্থ হচ্ছে।
মহামারির প্রথম কয়েক মাস প্রায় সবাইকেই কাটাতে হয়েছে ঘরে বসে। কিন্তু অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে কোনো দেশই বেশি দিন সম্পূর্ণ লকডাউন জারি করে রাখতে পারেনি। জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে মানুষকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু ঠিক যেন চলতে শুরু করেছে আগের মতোই। পুরোপুরিভাবে শুধুমাত্র বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
দীর্ঘদিন যাবৎ চলমান এই মহামারি ও লকডাউন প্রাপ্তবয়স্কদের চাইতে শিশুদেরকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করছে। মার্কিন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. ম্যারি মার্গারেটের মতে, যেকোনো কমিউনিটি সংকট শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তখন শিশুদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা, আচরণগত সমস্যা, ঘুমের সমস্যা থেকে শুরু করে আত্নহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। এতে করে তাদের আচার-আচরণগত ব্যাপক পরিবর্তন সেসময়ে পরিলক্ষিত হয়, যা তারা পরবর্তীতেও দীর্ঘদিন ধরে ধারণ করতে পারে।
করোনা মহামারির ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ যেমন ব্যহত হচ্ছে, অন্যদিকে অবনতি হচ্ছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনা, খেলাধূলা বন্ধুদের সাথে মেশা ইত্যাদি প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। ফলে তাদের মানসিক জগতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন, যা কিনা তাদের মনোসামাজিক বিকাশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি শিশুর ওপর সেই প্রভাব পড়তে দেয়া যাবে?
বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই ঘরে থাকাকালীন অবস্থায় শিশুদের মহামারির প্রভাব থেকে রক্ষা করে তাদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের গতিকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রথমত, শিশুর মধ্যে তৈরি করতে হবে বেশ কিছু নতুন অভ্যাস। যেমন- কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, বাইরে গেলে সাথে স্যানিটাইজার বহন করা, মাস্ক পরিধান করা ইত্যাদি। সর্বোপরি নিজেকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস এই মহামারিকালে শিশুর মধ্যে তৈরি করে ফেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহামারির কাল শেষ হবার পরও যাতে শিশুদের মধ্যে পরিষ্কার থাকার চেষ্টা বজায় থাকে, সেটা নিশ্চিত করুন। এই অভ্যাসটি তাদেরকে সুরক্ষিত রাখবে নানান ধরনের রোগ-জীবাণু থেকে।
শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সুষম খাদ্যের। শিশুকে প্রতিদিন তিনবেলা সুষম খাদ্য প্রদানের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র পর্যাপ্ত খাবার এবং পরিমিত ঘুম শিশুকে অনেকাংশে সুস্থ রাখতে পারে। দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকায় স্বল্প ঘুম কিংবা অতিরিক্ত ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি হবার আশঙ্কা থাকে। বিশেষত সকালে স্কুলে যাবার তাড়া না থাকায় শিশু বেশি রাত জাগতে পারে যার ফলে সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। এ ব্যাপারে অভিভাবকের বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং স্বাভাবিকভাবেই এসময় শিশুরা বিভিন্ন ডিভাইসের স্ক্রিনে অনেক বেশি সময় কাটায়। সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিলে তা তাদেরকে অন্য কাজে সচল থাকার সুযোগ তৈরি করে দেবে।
সারাদিন টেলিভিশন-মিডিয়াতে চলতে থাকা নেতিবাচক সংবাদ থেকে শিশুকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। কেননা অতিরিক্ত নেতিবাচক সংবাদ শিশুর সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সে প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে, যা তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই নেতিবাচক সংবাদের মধ্যে দিয়ে তাকে না নিয়ে বরং বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপ করলে, জ্ঞান দ্বারা সমৃদ্ধ হবার পাশাপাশি সে নিজেকে পরিবারের একজন পূর্ণাঙ্গ এবং গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে করতে শুরু করবে। যা তাকে স্বাভাবিক রাখা থেকে শুরু করে মানুষ হিসেবেও সমৃদ্ধ করবে।
সাধারণভাবে আমাদের দেশের অভিভাবকেরা শিশুর মানসিক বিকাশকে প্রায় পাত্তাই দিতে চান না। তারা শুধুমাত্র শিশুর পড়াশোনার ওপরই গুরুত্বারোপ করে থাকেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হলে বাকি সবকিছুই বাধাগ্রস্থ হবে। তাই শিশুর ওপর পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাসায় থাকার ফলে শিশু যেহেতু পড়ার জন্য অতিরিক্ত সময় অনেক বেশি পায়, তাই সে সময়টাতে শ্রেণীকক্ষের পড়ার বাইরে তাকে শিশু সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে সে ছোট্ট বয়স থেকেই রুচিশীল পাঠক হয়ে উঠবে, যা তার মানসিক বিকাশের গতিকে ত্বরান্বিত করবে।
শিশুর বিকাশের আরেকটি জরুরি দিক হচ্ছে পরিপূর্ণ শারীরিক বিকাশ। পর্যাপ্ত খেলাধূলা, আলো-বাতাস না পেলে তার শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হবে, যা তার মানসিক বিকাশের ওপরও প্রভাব ফেলবে। মনে রাখা দরকার, শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক না রাখলে কোনোকিছুই ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। স্কুলে শিশু প্রতিদিন খেলাধুলার সুযোগ পেত, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেটা এখন সে আর পাচ্ছে না। এজন্য প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে ঘরের ভেতরে কিংবা ছাদে খেলাধুলা করার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিদিন কিছুক্ষণ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে তার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। সেটা সম্ভব না হলে তার সাথে বিভিন্ন ইনডোর গেমস খেলা যেতে পারে।
তবে শারীরিক কাজ করা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময় শরীরচর্চা করা যেতে পারে। ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে ঘরে বসে তাদের ইয়োগা করার চর্চাও তৈরি করতে পারেন। এতে শিশুর শ্বাসঃপ্রশ্বাস ঠিক থাকবে এবং সে শারীরিক এবং মানসিক উভয়ভাবেই উৎফুল্ল বোধ করবে।
যেকোনো সংকটই শিশুর ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। শিশুদের মনের মধ্যে সেসব ঘটনা অত্যন্ত নীরবে, সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করে এবং বহুদিন যাবৎ শিশুর মধ্যে এসবের প্রভাব রয়ে যায়। তাই এই সময়ে শিশুর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ তার মনোসামাজিক জগতকে ঠিক রাখবে। অভিভাবকের উচিৎ তাকে এসময়ে সাধারণ সময়ের চাইতে আরও বেশি যত্ন নেওয়া, যেন তার স্বাভাবিক বিকাশ কোনোভাবে ব্যহত না হয়।
মনে রাখা দরকার, এই সময়ে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। অভিভাবক নিজে ভালো থাকলে শিশু নিরাপদবোধ করে। তাই নিজেদের ভবিষ্যৎকে বাঁচাতে নিজে ভালো থাকা এবং শিশুকে ভালো রাখার বিকল্প নেই।