ওয়েট ট্রেনিংয়ের ব্যায়ামগুলোকে সাধারণত দুটি বিষয়ের উপর প্রাধান্য দিয়ে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। প্রথমত, ব্যায়ামটি কীভাবে পেশীগুলোতে কাজ করে এবং দ্বিতীয়ত, ঐ ব্যায়ামে পেশীর কোন কোন অংশ কাজ করে। এগুলো কম্পাউন্ড এবং আইসোলেশন হিসেবে পরিচিত।
‘এই দুই ধরনের ব্যায়ামের মধ্যে কোনটি অনুসরণ করা উচিত?’ এমন প্রশ্নে নানা রকম উত্তর পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের জিমগুলোতে এসব নিয়ে রাশভারী বিতর্কও চলে। বিতর্কের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, দুর্ভাগ্যবশত অভিজ্ঞদের কাছে দুই দলই ভুল। কম্পাউন্ড কিংবা আইসোলেশন, দুই ধরনের ব্যায়ামই ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে, বিভিন্ন ধরনের রুটিনে ব্যবহৃত হয়। পুরোটাই নির্ভর করে আপনার শারীরিক কাঠামো এবং ব্যায়ামের উদ্দেশ্যের উপর।
চলুন, এই দুই ধরনের ব্যায়াম পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নিয়ে নিজের জন্য কোনটি ফলদায়ক হবে তা বিবেচনা করা যাক।
কম্পাউন্ড এক্সারসাইজ
কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলোতে মূলত একইসাথে একাধিক পেশী এবং পেশী গ্রন্থি অংশগ্রহণ করে। একটি পেশী প্রধান হিসেবে প্রাধান্য পায়, কিন্তু একইসাথে আনুষাঙ্গিক আরো পেশী কাজ করে। প্রচলিত কম্পাউন্ড এক্সারসাইজ এবং তাদের প্রধান ও আনুষাঙ্গিক পেশীগুলো সম্পর্কে জানা যাক এখন।
বেঞ্চ প্রেস (Bench Press)
ফ্ল্যাট, ইনক্লাইন কিংবা ডিক্লাইন, ডাম্বেল ব্যবহার করে কিংবা বারবেল- বেঞ্চ প্রেসের মূল উদ্দেশ্যই থাকে চেস্ট ওয়ার্কআউট। কিন্তু সাথে সাথে কাঁধ এবং ট্রাইসেপও ব্যাপকভাবে জড়িত।
ওভারহেড শোল্ডার প্রেস (Overhead Shoulder Press)
এটি মূলত কাঁধের ওয়ার্কআউট হলেও সেকেন্ডারি পেশী হিসেবে ট্রাইসেপ অংশগ্রহণ করে।
ডিপস (Dips)
প্যারালাল বার ব্যবহার করে দুই ধরনের ডিপস ওয়ার্কআউট প্রচলিত। একটিতে প্রধান পেশী হচ্ছে চেস্ট। কিন্তু সেকেন্ডারি পেশী হিসেবে ট্রাইসেপ এবং কাঁধ অংশগ্রহণ করে। অপরটি ব্যবহৃত হয় ট্রাইসেপ ওয়ার্কআউট হিসেবে। এখানে সেকেন্ডারি পেশী হিসেবে চেস্ট এবং কাঁধ অংশগ্রহণ করে।
রো’স (Rows)
ডাম্বেল, বার্বেল কিংবা মেশিন; এই ব্যায়ামটিতে যা-ই ব্যবহার করুন না কেন, এটি ব্যাক ওয়ার্কআউট হিসেবে প্রচলিত। কিন্তু ব্যাপকভাবে বাইসেপ এবং ফোরআর্মসের পেশীর ব্যায়ামে জড়িত।
পুল-আপ এবং চিন-আপ (Pull-up and Chin-up)
উপরের পেছনের পেশী কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাইসেপ এবং আপার-বডির সহনশক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে।
ডেডলিফট (Dead Lift)
এটি মূলত হ্যামস্ট্রিং এবং কোমরের সহনশীলতা বৃদ্ধিতে কাজ করে। সাথে সাথে উপরের এবং নিচের, শরীরের উভয় অংশকে শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করে।
এছাড়াও আরো অসংখ্য ব্যায়াম রয়েছে যেগুলো একইসাথে একের অধিক পেশী গ্রন্থি নিয়ে কাজ করে, যারা প্রত্যেকে কম্পাউন্ড এক্সারসাইজের অন্তর্ভুক্ত।
আইসোলেশন এক্সারসাইজ
যে ব্যায়ামগুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি পেশীর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং সেকেন্ডারি কোনো পেশীকে পুরোপুরি এড়িয়ে যায়, মূলত সেগুলোই আইসোলেশন এক্সারসাইজের আওতায় পড়ে। প্রধান প্রধান আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলো হলো-
ফ্লাট, ইনক্লাইন এবং ডিক্লাইন ফ্লাই (Flat, Incline and Decline Fly)
এটি শুধুমাত্র বুকের জন্য। এই ব্যায়ামগুলোতে সাধারণত ডাম্বেল এবং ক্যাবল ব্যবহার করা হয়।
ফ্রন্ট রাইজ (Font Rise)
প্রধান এবং একমাত্র পেশী হচ্ছে কাঁধ।
বাইসেপ কার্লস (Bicep Curl)
ডাম্বেল, বারবেল এবং ক্যাবল ব্যবহার হওয়া ওয়ার্কআউটগুলোর টার্গেট পেশী হচ্ছে বাইসেপ।
ট্রাইসেপস এক্সটেনশন (Triceps Extension)
শুধুমাত্র ট্রাইসেপে লক্ষ্য রাখে।
লেগ কার্ল (Leg Curl)
এটি শুধুমাত্র হ্যামস্ট্রিং এর ব্যায়াম।
লেগ এক্সটেনশন, কাফ রাইজ সহ আরো অসংখ্য ব্যায়াম রয়েছে যেগুলো একটি মাত্র পেশীতে কাজ করে।
কম্পাউন্ড বনাম আইসোলেশন
এতক্ষণ কম্পাউন্ড এবং আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলোর ব্যাপারে জেনেছি। এখন তাহলে তাদের মধ্যে তুলনা করে নিজেদের জন্য ফলদায়ক ব্যায়াম পদ্ধতিটি বেছে নেওয়া যাক।
প্রথমত, কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলো একের অধিক পেশীকে একইসাথে ব্যবহার করে। ফলে প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা পেশীর জন্য আলাদা ব্যায়ামের প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ, সীমিত ব্যায়াম এবং অল্প সময়ের মধ্যেই অধিক পেশী টিস্যুকে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে কম্পাউন্ড এক্সারসাইজ ব্যায়ামকারীকে সর্বোচ্চ ফলাফল দেয়। তাছাড়া একইসাথে অধিক পেশী গ্রন্থিকে কাজে লাগানোর ফলে আপনি প্রয়োজনে ব্যায়ামগুলোতে বেশি ভার ব্যবহার করতে পারবেন, যা পেশীর ধারাবাহিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অপরদিকে, যেহেতু আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলো স্বতন্ত্র পেশী গ্রন্থির উপর কাজ করে, সেহেতু আপনি চাইলেই ব্যায়ামগুলোতে বেশি ভার ব্যবহার করতে পারবেন না। তাছাড়া নিয়মিত নির্দিষ্ট কিছু পেশীর জন্য আলাদা আলাদা ব্যায়ামের ফরে শরীরে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, যা শারীরিকভাবে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলো আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলো থেকে অনেক বেশি ক্রিয়ামূলক। ব্যায়ামগুলো মাধ্যাকর্ষ বলের বিপরীতে করা পুশ, পুল এবং স্কোয়াড নির্ভর হওয়ায় বাস্তব জীবনের গতিবিধির সাথে অনেকাংশেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তৃতীয়ত, কম্পাউন্ড এবং আইসোলেশন এক্সারসাইজের মধ্যে সবচাইতে বড় পার্থক্য হচ্ছে, তাদের ‘ফ্যাট বার্নিং’ বা চর্বি পোড়ানোর ক্ষমতা। লম্বা সময় ধরে প্রায় সব রকম পেশী নিয়ে কাজ করার ফলে কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্যালরি পোড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রত্যেকটি কম্পাউন্ড এক্সারসাইজ সেশনের পরও প্রায় ঘণ্টা খানেকের মতো ফ্যাট-বার্নিং কার্যক্রম বজায় থাকে।
তাহলে কি আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলোর কোনো স্থান নেই?
উপরোক্ত ৩টি অংশে কম্পাউন্ড এক্সারসাইজের গুণগান শুনে মনে হতেই পারে, কম্পাউন্ড এক্সারসাইজই সব। কিন্তু জেনে রাখা উচিত যে, ওয়ার্কআউট রুটিনে প্রচুর নির্দিষ্ট জায়গা আছে, যেখানে আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
সাধারণত বেঞ্চ প্রেসগুলো বুকের ব্যায়াম হিসেবে কাজ করে এবং আনুষঙ্গিক পেশী হিসেবে ট্রাইসেপ এবং কাঁধকে সাথে রাখে। এখন ধরুন, একটি বেঞ্চ প্রেস সেশনের পর আপনার মনে হলো, রুটিনে বাড়তি বুকের ব্যায়াম রাখা উচিত। কিন্তু সাথে সাথেই আপনি ট্রাইসেপ এবং কাঁধকে বাদ দিতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই ফ্ল্যাট, ইনক্লাইন কিংবা ডিক্লাইন ফ্লাইয়ের মতো আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলো প্রতি নির্ভর করতে হবে।
এছাড়াও, বাইসেপ, ট্রাইসেপ এবং কাফের মতো ছোট ছোট পেশীগুলোকে সমৃদ্ধ করার জন্য আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলোই একমাত্র উপায়।
অভিজ্ঞরা যা বলেন
‘কম্পাউন্ড, নাকি আইসোলেশন’ বিতর্কে, কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলো অনেকাংশে এগিয়ে থাকলেও, ওয়ার্কআউট রুটিন থেকে আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলোকে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যায়ামের এই দুটি পদ্ধতিই ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে আপনি কী উদ্দেশ্য নিয়ে পদ্ধতিগুলোর উপর নির্ভর করছেন, সে ব্যাপারে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞদের সাধারণ কিছু পরামর্শও রয়েছে।
- আপনার প্রাথমিক উদ্দেশ্য যদি ফ্যাট বার্নিং এবং কার্যক্ষমতা সংশ্লিষ্ট হয়। অর্থাৎ আপনি যদি শারীরিক শক্তি, সক্ষমতা, অ্যাথলেটিক কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে ওয়ার্কআউট রুটিনে কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলোকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলোকে সীমিত করে ফেলা কিংবা প্রয়োজনে পুরোপুরি বয়কট করাও বুদ্ধিমানের কাজ।
- কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমৃদ্ধ পেশী তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে থাকলে, কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলোর সাথে সাথে নিয়মিত আইসোলেশন এক্সারসাইজগুলোর প্রতিও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
- ব্যায়ামে নতুনদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, পুরোপুরি কম্পাউন্ড এক্সারসাইজগুলোর উপর নির্ভর হওয়া।
আশা করি, ওয়েট ট্রেনিংয়ের সেশনগুলোতে আর কখনো ‘আইসোলেশন, নাকি কম্পাউন্ড’ দ্বন্দ্বে ভুগবেন না। কিন্তু যাদের এখনো ওয়েট ট্রেনিং এর ব্যায়ামগুলো শুরু করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সুস্থ এবং সবল থাকতে চান, তাদের জন্য এই দুটি লেখা কাজে আসতে পারে-
১. নিজেকে সুস্থ এবং শক্তিশালী রাখার জন্য সহজ চার ব্যায়াম
২. ব্যায়ামের আগে ও পরে যা যা করবেন।
ফিচার ছবি: twitter/therock