করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা সবচেয়ে কম কাদের? নিঃসন্দেহে বয়সে তরুণদের, বিশেষত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের (জাতিসংঘের সংজ্ঞানুযায়ী)।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে প্রবীণদের, যাদের বয়স ৫১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে। এদিকে বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর হারও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে তুলনামূলক বেশি, যা একটি চিন্তার বিষয়। আবার সমগ্র বিশ্বজুড়েই কোভিড-১৯ রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন ৩১ থেকে অনূর্ধ্ব ৫০ বছর বয়সী অনেকে।
এদের তুলনায় তরুণদের মৃত্যুর হার অনেক কম। এর প্রধান কারণ হলো তরুণদের শরীরের উচ্চ ও সক্রিয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। করোনায় আক্রান্ত হলেও তাই সেরে উঠছেন অনেক তরুণ। অনেকে যে আবার আক্রান্ত হয়েছেন, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না কোনো দৃশ্যমান উপসর্গ না থাকায়। অথচ তারপরও, সব মিলিয়ে করোনায় আক্রান্ত কিন্তু তরুণরাই হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত শনাক্ত ব্যক্তির ৫০ শতাংশেরই বয়স ২১ থেকে ৪০ বছর। অর্থাৎ, সাধারণভাবে আমরা যে বয়সীদের তরুণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকি, তাদের একটা বড় অংশই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
কেন তরুণদের করোনাভাইরাসে পজিটিভ হওয়ার হার এত, সে কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে সবার আগে উঠে আসবে তরুণদের অসচেতনতার বিষয়টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলছে, কাজের কারণে হোক আর অসচেতনতার কারণেই হোক, তরুণরা বাইরে বেশি সময় কাটান, এ কারণে তারা বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন।
যেহেতু তরুণদের নিজেদের মৃত্যুর আশঙ্কা খুবই কম, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে তাদেরকে খুব একটা সচেষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি দিনের পর দিন গৃহবন্দি থাকতেও তারা নারাজ। যখন-তখন, কারণে-অকারণে বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারা, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অবাধে। কেউ কেউ তো আবার ফাঁকা রাস্তা বা মাঠে প্রবল উৎসাহে ক্রিকেট-ফুটবলও খেলছেন।
বাইরে বেরোলেই দেখা যাবে, রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন একদল মানুষ। তাদের সিংহভাগই বয়সে তরুণ। সামাজিক দূরত্ব মানার বদলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াচ্ছেন তারা। এমনকি মাস্ক পরতেও তাদের বেজায় আপত্তি। অনেকে তো মাস্ক পরছেনই না, আবার এমন অনেকেও আছেন যারা মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রাখছেন, কিংবা নাক ও মুখ বের করে দিয়ে কথা বলছেন।
কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না ধূমপায়ী তরুণদেরও। গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে উঠে এসেছে, করোনাকালীন মহাবিপর্যয়ের মাঝেও বরাবরের মতোই বেপরোয়া ধূমপায়ীরা। কোভিড-১৯ মূলত শ্বাসযন্ত্রের রোগ, এ কথা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ধূমপান করছেন তারা। এক সিগারেট কয়েকজন ভাগাভাগি করে খাওয়ার দৃষ্টান্তও দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদের বিপদ তো ডেকে আনছেনই, পাশাপাশি পথচারী অন্য অনেকেরও পরোক্ষ ধূমপান হয়ে যাচ্ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাবও ভয়াবহ।
করোনাকালে থেমে নেই মাদকের ব্যবহারও। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এখন অন্যদিকে হওয়ায়, মাদক বাণিজ্য যেন আরো রমরমা হয়ে গেছে। এবং সেই মাদক গ্রহণের তাড়নায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন নেশাগ্রস্ত তরুণরা। মাদক জোগাড় করতে পারলে কোনোপ্রকার সাবধানতার বালাই ছাড়াই মাদক গ্রহণে মেতে উঠছেন তারা।
এসব কারণেই আইইডিসিআরের ভাইরলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলছেন,
“তরুণরা উদ্বিগ্ন বোধ করছেন না। কারণ তারা দেখছেন যে আক্রান্ত হলেও তাদের উপসর্গগুলো খুব গুরুতর নয়। অনেক সময় তাদের মধ্যে কোন উপসর্গই দেখা যায় না। তারা দেখছে যে মূলত বয়স্করাই বেশি মারা যাচ্ছেন। তাই করোনাভাইরাসকে তারা হালকাভাবে নিচ্ছেন।”
অবশ্য সব তরুণই যে এমন ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা অসচেতনতায় বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন, তা বলা যাবে না। চলমান দুর্যোগে অনেক তরুণেরই আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। তারা হয়তো ইতঃপূর্বে টিউশন, রাইড শেয়ারিং, সেলসম্যান কিংবা অন্য যেকোনো পার্ট টাইম চাকরি করে নিজেদের ও পরিবারের খরচ চালাত। এই মুহূর্তে তাদের নিশ্চিত আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও জীবিকার তাগিদে নিয়মিত বাড়ির বাইরে যেতে হচ্ছে তাদের।
তাছাড়া তরুণদের একাকিত্বে ভোগার বিষয়টিকেও এড়িয়ে গেলে চলবে না। ‘লোনলিনেস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড: এজ, জেন্ডার অ্যান্ড কালচারাল ডিফারেন্সেস ইন লোনলিনেস’ শিরোনামের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মূলত বয়স্করাই একাকিত্বের সমস্যায় ভুগলেও, বর্তমান করোনাকালীন গৃহবন্দি সময়ে তরুণ প্রজন্মই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন। এর ফলে তারা আরো বড় ধরনের নানা মানসিক সমস্যার দিকেও ধাবিত হচ্ছেন। তাই খানিকটা সঙ্গ লাভের আশাও আরেকটি কারণ তাদের বার বার বাড়ির বাইরে বের হতে চাওয়ার।
তবে তরুণরা যে কারণেই বাড়ির বাইরে যান না কেন, একটি কথা অনস্বীকার্য যে তারা ঝুঁকির মুখে ফেলছেন অন্যদের। যেহেতু করোনায় আক্রান্ত হলেও সাধারণত তাদের কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, কিংবা গেলেও খুব কম যায়, তাই বাইরে থেকে ফিরে নিজেদের অজান্তেই তারা সংক্রমিত করছেন তাদের পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়দের।
তরুণদের অসচেতনতার ফলেই মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা, যারা আগে থেকেই টিউবারকোলসিস, নিউমোনিয়া, রক্তরোগে ভোগেন, কিংবা রয়েছে হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, ডায়াবেটিস। এছাড়া তরুণদের অসচেতনতার ফলেই তারা নিজেরা আক্রান্ত হয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যবস্থার উপর চাপ ফেলছেন। আবার তাদের কারণে শিশু বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের অবস্থা গুরুতর হলে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ।
তরুণদের নিয়ে চিন্তিত বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরাও। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তরুণ প্রজন্মই হয়তো ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ অর্থাৎ সংক্রমণ কমে আসার পর আবার ঊর্ধ্বগতিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী হতে পারে।
তাই সময় থাকতেই সচেতন হতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। যদি একান্তই বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে, তাহলে তো যেতে হবেই। কিন্তু স্রেফ ঘরে বসে ভালো লাগছে না, ধূমপান বা মাদক গ্রহণ করতে হবে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে হবে, এ ধরনের কোনো স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা নিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। বরং চেষ্টা করতে হবে ঘরে বসেই যতটা সম্ভব মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার।
পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে হতে হবে আরো বেশি সচেতন। তাদের নিজেদের তেমন কোনো মৃত্যুঝুঁকি না থাকলেও, অন্যদের কথা চিন্তা করে তাদেরকে অবশ্যই যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সেই সঙ্গে তাদেরকে হতে হবে সহানুভূতিশীল। কেবল নিজেদের খারাপ লাগা নিয়ে পড়ে না থেকে, আশেপাশের শিশু কিংবা বৃদ্ধদের ব্যাপারেও তাদেরকে সহমর্মী হতে হবে, তাদের সকলের কষ্ট বা সমস্যার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।