সমঅধিকার নিয়ে নারী-পুরুষের মাঝে খানিকটা অসন্তোষ সবসময়ই কাজ করেছে। এ সমস্যা দূরীকরণে চেষ্টাও করা হয়েছে প্রচুর। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অন্তত একটি দিক থেকে পুরুষদের চেয়ে নারীরা এগিয়ে আছেন। আর সেটি হলো জীবনসীমা। গত ১০০ বছরে এই দেশগুলোতে পুরুষদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন নারীরা। বিশেষ করে, ধূমপান, শিল্প-কারখানার দূষণ এবং যুদ্ধ এসব ক্ষেত্রে পুরুষদের বিচরণ বেশি বলে তাদের জীবনসীমা অনেকটা কমে গিয়েছে। তবে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এই পার্থক্য খুব বেশি দিন থাকবে না।
এই গবেষণানুসারে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ১৯৫০ সাল থেকে দেখা কাঙ্ক্ষিত জীবনসীমা অনুসারে, আগামী ২০৩২ সালের মধ্যে নারী পুরুষের মধ্যকার এই দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে যাবে। তখন নারী ও পুরুষ উভয়ের জীবনসীমা হবে ৮৭.৫ বছর। ক্যাস বিজনেস স্কুলের পরিসংখ্যানের অধ্যাপক লেস মেহিউর করা এই গবেষণাটিতে মোট ১,০০,০০০ মানুষের স্যাম্পল নেওয়া হয়েছে। ৩০ বছর বয়স্ক এই মানুষগুলো কতদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারেন সেটা প্রতি বছরে নারী ও পুরুষের জীবনসীমার হিসাব দেখে গণনা করা হয়। সেই হিসাব ততক্ষণ পর্যন্ত করা হয় যতক্ষণ নারী ও পুরুষের গড় জীবনসীমা একই বয়স পর্যন্ত না পৌঁছায়। গবেষকের জানান-
তামাক ও অ্যালকোহল পানের ক্ষেত্রে পুরুষরা একটু হলেও পিছিয়ে আছে, যেটি তাদের গড় আয়ুকে আরেকটু বাড়িয়ে তুলেছে।
এছাড়াও হৃদপিণ্ডের সমস্যা, শারীরিক দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজ এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করার ক্ষেত্রেও পুরুষরা সবসময় নারীদের চাইতে অনেকটা এগিয়ে ছিল। গবেষকদের মতে, এই ঝুঁকিগুলো পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেকটা কমে এসেছে। অবশ্য ধারণা করা হয়েছিল যে, জীবনসীমা নিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যকার যে পার্থক্য তা খুব দ্রুতই কমে যাবে। ২০১৫ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে আসে এই তথ্য। জানা যায়, ২০৩০ সালের মাঝেই এই পার্থক্য ১.৯ বছর কমে আসবে। তবে যুক্তরাজ্যে এই পার্থক্য খুব একটা কমেনি।
১৯৫০ সালের পর থেকেই ইংল্যান্ডে নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ১৯৬৯ সাল থেকে এই পার্থক্য ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এসময় নারীরা পুরুষদের চাইতে গড় ৫.৬৮ বছর বেশি বাঁচার রেকর্ড গড়েন। ইম্পেরিয়াল কলেজের অধ্যাপক মাজিদ ইজ্জাতির মতে, এই পার্থক্যের পেছনে স্বাস্থ্য বা শারীরিক কাঠামো নয়; বরং সামাজিক পরিস্থিতিই দায়ী। তিনি বলেন –
এই পার্থক্য কমা নয়, এর উপস্থিতিই অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার। এই সাম্প্রতিক ঘটনাটি বিংশ শতকের পরই বেশি প্রকাশিত হয়েছে।
পরপর দুইটি বিশ্বযুদ্ধ পুরুষদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সাথে ছিল নতুন পুরুষদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া অত্যাধিক ধূমপানের অভ্যাস। নারীরাও যে ধূমপানে অংশ নেননি তা নয়। তবে সেটার পরিমাণ কখনোই পুরুষদের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ১৯৪০ সালে তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর সিগারেট উৎপাদন করতে শুরু করে।
সেসময় তারা বুঝতে পারে যে, প্রায় তিনভাগের দুইভাগ পুরুষ ধূমপান করছেন। অন্যদিকে, নারীরা এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন ১৯৬০ সালে। ধূমপান ও মদ্যপান ছাড়াও শিল্পকারখানার পুরুষদের বেশি অংশগ্রহণ তাদের জীবনসীমাকে কমিয়ে দিয়েছে। তবে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ভূগোলের অধ্যাপক ড্যানি ডরলিং এর মতে, এই পার্থক্য অনেকটা কমে আসছে। এই পরিবর্তনের পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে নারীদের বাইরের কাজে এগিয়ে আসা। তিনি বলেন –
যেহেতু জীবনসীমা কমে আসছে। তাই নারী ও পুরুষ সম্পর্কে আমাদের ধারণাও পরিবর্তিত হচ্ছে।
এছাড়া গর্ভনিরোধক নানা উপায় ব্যবহার করাও এই পুরো ব্যাপারটিকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। নানা কারণে আগে যে সাম্যতার অভাব নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিকভাবে ছিল, সেটি তাদের গড় আয়ুকেও অসম করে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে সমতা দুই দিক দিয়েই কমে এসেছে। একদিকে, নারীরা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে, তাদের জীবনসীমাও পুরুষদের কাছাকাছি হতে চলেছে।
স্থানভেদে বয়স সীমার ভিন্নতা
এমনটা অবশ্য এক কথায় বলা যায় না যে, নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের কাছাকাছি চলে আসছে। এই পুরো ব্যাপারটি ঘটছে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন ভিন্নভাবে। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, নারী ও পুরুষের গড় আয়ুর পার্থক্য কমে যাচ্ছে; তার মানে এই নয় যে, এই পার্থক্য সব স্থানে কমছে। এটি নির্ভর করবে আপনি কোথায় অবস্থান করছেন তার উপরও।
শ্রেণীবৈষম্যও এখানে বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। কম সম্পদশালী ব্যক্তির আয়ু সম্পদশালীর চাইতে খানিকটা হলেও কম থাকছে হিসাব অনুসারে। কাসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালে একজন বিত্তবান পুরুষ অপেক্ষাকৃত স্বল্প বিত্তবান পুরুষের চাইতে গড়ে ৮.৮ বছর বেশি বাঁচবেন। আর অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে বিত্তবান এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প বিত্তবান নারীর গড় আয়ুর মধ্যে পার্থক্য দেখা যাবে ৭.৩ বছর। এই গবেষণায় ৩০ বছরের পর মৃত্যুবরণ করা মানুষের হিসাব গ্রহণ করা হয়েছে। এর মূল কারণ হলো অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করা মানুষের সংখ্যা এড়ানো। প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য যদি মৃত্যুর কারণ হয় তখন সেটা কমবয়সে মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
জীবনসীমা যেহেতু বেড়ে যাচ্ছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মৃত্যুহারও আগের চাইতে অনেক কমে এসেছে। ১৯৮০ সালের পর থেকে এই হার অনেক কমে আসলেও, পুরুষের মৃত্যুহার নারীদের চাইতে এইসময় অনেক বেশি কমে যায়। ২০১২ সালে মৃত্যুহার আবার বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে এই হার গিয়ে দাঁড়ায় ৫,২৯,৬৫৫ জনে। আগের বছরের চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে মৃত্যুহার দেখা যায় এ বছরে। অবশ্য, ২০১৬ সালে আবার এই হার ০.৯% এ কমে আসে।
বর্তমানে নারী – পুরুষ দুজনই জীবনযাপনের পদ্ধতি নিয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন। পোশাক থেকে শুরু করে খাবার; সবক্ষেত্রেই নিয়ম মেনে তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর উপায় অবলম্বন করার চেষ্টা করছেন সবাই। তাই মৃত্যুহার কমে গিয়ে নারী ও পুরুষের গড় আয়ুর পার্থক্য সমান হয়ে আসা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। অনেকের মতে, মানুষ নতুন নতুন উপায় অবলম্বন করছে জীবনসীমা বাড়ানোর জন্য। তার মানে এই নয় যে, মৃত্যুহার কমে আসবে। এই নতুন জীবনপদ্ধতি মৃত্যুহার বাড়িয়েও দিতে পারে। হয়তো জন্ম ও মৃত্যু হার সমান হয়ে যেতে পারে। আবার নারী ও পুরুষের গড় আয়ুর পার্থক্য যদি বর্তমান অবস্থানেই থেকে যায় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তবে হ্যাঁ, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই পার্থক্য সত্যিকার অর্থেই অনেকটা কমে এসেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭৩.৪ বছর এবং নারীদের ৮০.১ বছর। গড় আয়ুর পার্থক্য এখানে প্রায় ৬.৭ বছর। অন্যদিকে, ফ্রান্সে এই পার্থক্য ৭.৮ বছর। রাশিয়ায় এই পার্থক্য ১২ বছর। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশ যেমন- বাংলাদেশে এই পার্থক্য ০.১ বছর এবং ভারতে ০.৬ বছর। তাই গবেষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে একটা সময় গিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী ও পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুর পার্থক্য কমে আসলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।