গর্ভকালীন সময়ে নারীদের খাবার বিষয়ক নানারকম নিয়ম মেনে চলা উচিত। পুষ্টিকর সব খাবার খেতে হয়। তবে এসব বাদেও গর্ভকালীন সময়ে খাবার নিয়ে বেশ মজার এবং অদ্ভুত কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হন প্রত্যেক নারী। তাদের একেবারেই আলাদা কিছু খাবার খাওয়ার ইচ্ছা বেড়ে যায় এসময়। সেইসাথে খাবারের প্রতি আগ্রহ, পছন্দ-অপছন্দ জন্ম নেয় মায়ের গর্ভে থাকা শিশুটিরও।
পিকা: গর্ভধারণকারী নারীদের সহজাত খাদ্যাভ্যাস
খাবারের ক্ষেত্রে বিচিত্র সব উপাদান ব্যবহার করলে সেটাকে আমরা পিকা নামক নাম দিয়ে থাকি। পিকায় আক্রান্ত রোগীরা সাবান থেকে শুরু করে খাবারের মধ্যে পড়ে না এমন সব উপাদান গ্রহণ করে থাকেন। গর্ভকালীন সময়ে ঠিক একই ব্যাপার ঘটে থাকে। উদ্ভট সব দ্রব্য খেতে ইচ্ছে করে এসময় নারীদের। অনেকে ভালোবাসেন মাটি খেতে, কেউ আবার লুকিয়ে লুকিয়ে পোড়ামাটি, ইট, চল, প্লাস্টার ইত্যাদি খেয়ে থাকেন। আর সেটা কিন্তু আইসক্রিম খাওয়ার ইচ্ছের চাইতে কম কিছু নয়। পিকা সংক্রান্ত এই ব্যাপারটি কেবল যে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়। প্রতি মাসে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শারীরিক যে পরিবর্তন নারীর মধ্যে আসে সেসময়েও খাবার কিংবা খাবার নয় এমন বস্তুর প্রতি এই আগ্রহ বাড়ে। তবে ভবিষ্যত মায়েদের ক্ষেত্রে এই পুরো ব্যাপারটি হয়ে যায় চোখে পড়ার মত।
অনেকে অবশ্য এই পুরো ব্যাপারটিকে খুব স্বাভাবিক শারীরিক চাহিদা বলে মনে করেন। তাদের মতে, নারীরা এই সময় শরীরে ভিটামিন সি এর অভাবের কারণে যেমন লেবু কিংবা ভিটামিন সি যুক্ত খাবারের প্রতি আগ্রহবোধ করেন, ঠিক তেমনি শরীরে লৌহ কিংবা ক্যালসিয়ামের অভাববোধ থেকেই পাথর, মাটির মতো অদ্ভুত খাবারগুলো খেয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, মাটির সাথে পানি মেশালে যে গন্ধ ছড়ায় সেটার প্রতিও অনেকে আকৃষ্ট হন বলে জানান মায়েরা। এই অদ্ভুত ব্যাপারটি যে কেবল কোনো খাবারে সীমাবদ্ধ থাকে তা-ও কিন্তু নয়।
পছন্দের মানুষটির ধারেকাছে থাকা, না থাকলে অস্বাভাবিক বোধ করাটাও এই তাড়নার মধ্যে পড়ে থাকে। ঠিক উল্টোটাও ঘটে। কোনো মানুষকে একদম সহ্য না করতে পারা, চোখের সামনে পড়লেই তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছাও দেখা যায় অনেকের মধ্যে। পুরুষদের জন্য খাবার সংক্রান্ত এই ব্যাপারগুলো অনেকটাই অতিরিক্ত ও বানোয়াট বলে মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা নয়। নিজের খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত এই পরিবর্তন ও তাড়নাগুলো সামলানোর মতো অবকাশ নারীদের হাতে থাকে না গর্ভকালীন সময়ে।
কেন এমন হয়?
যেকোনো কার্যের পেছনে কারণ থাকতে বাধ্য। চিকিৎসকেরাও এ ব্যাপারে খুব একটা ভিন্ন কিছু ভাবেন না। উপরে একবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, শরীরে কোনো উপাদানের অনুপস্থিতি সেই উপাদানসমৃদ্ধ খাবার খেতে মানুষকে বাধ্য করতে পারে। এছাড়াও চিকিৎসকদের মতে, গর্ভধারণকালে শরীরে হরমোনের নানা রকম পরিবর্তন ঘটে, নিউরোপেপটাইড নিঃসৃত হয়। এর ফলে নারীরা খাবার নয় এমন সব বস্তু খেতে আগ্রহবোধ করেন। তবে এই আগ্রহ নির্ভর করে সংস্কৃতি এবং চারপাশে সহজলভ্য এমন বস্তুর উপরে। কিবাগাবাগা হাসপাতালের স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ডক্টর ওসী সেবাতুনজির মতে, শরীরে রক্তস্বল্পতার কারণে এমন অদ্ভুত খাবারের প্রতি গর্ভবতী নারীদের আগ্রহ জন্ম নেয়।
যেহেতু নারীরা গর্ভধারণের প্রথমদিকে কিছু খেতেই আগ্রহবোধ করে না, এর ফলে তাদের শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা যায়। ফলে শরীর সেই পুষ্টি অন্য কোনো উপাদান থেকে পাওয়ার চেষ্টা করে। মজার ব্যাপার হলো, কেবল নারীরাই নন, এসময় তাদের সঙ্গী পুরুষও মানসিক কিছু পরিবর্তনের কারণে কিছু খাবারের প্রতি আগ্রহবোধ করেন। প্রশ্ন হল, এই তাড়না কি কোনো নেতিবাচক ব্যাপার? একদম নয়। শারীরিক পরিবর্তনের ফলে গর্ভকালীন সময়ে নারীদের কোনো বিশেষ খাবারের প্রতি আকর্ষণবোধ করাটা খুব স্বাভাবিক। তবে বুঝতে হবে সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কিনা। এই যেমন, যদি কোনো নারীর এই সময়ে হুট করে অ্যালকোহলে পান করতে খুব ইচ্ছা করে তাহলে কি সেটা ঠিক হবে? না, হবে না। সেক্ষেত্রে, মাথায় রাখতে হবে যে, এই তাড়না খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কেটে যাবে। নিজের মনোযোগ অন্য কোনো দিকে সরিয়ে নেওয়াটাই হবে এ সময় সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ।
শিশুর খাদ্যাভ্যাস
না, আর দশটা শিশুর কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে মায়ের গর্ভে বাস করা শিশুটির কথা, যে কিনা এখনো জন্ম নেয়নি। আপনার মনে হতেই পারে যে, এখনো জন্ম নেয়নি এমন শিশুর কি নিজস্ব খাবারের পছন্দ থাকতে পারে? হ্যাঁ, পারে। গর্ভকালীন সময়ে কেবল মা নয়, গর্ভে নিশ্চিন্তে বড় হতে থাকা শিশুটিরও খাবার নিয়ে মতামত তৈরি হয়। বিশেষ করে মিষ্টির প্রতি মানুষের আগ্রহ শুরু হয় মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়েই। এক গবেষণায় দেখতে পাওয়া যায় যে, মিষ্টিজাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড এবং তেতো খাবারের ক্ষেত্রে কম অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড নিঃসরণ করে ভ্রূণ তার মায়ের গর্ভে থাকাকালে মিষ্টির প্রতি নিজের আগ্রহের কথা জানিয়ে দেয়।
অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড হলো সেই তরল যাতে স্বাদ এবং গন্ধের সব রাসায়নিক পদার্থ মজুদ থাকে। এটি পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারা যায় যে, ঠিক কোন কোন খাবারের স্বাদ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা বড় হয়ে যে খাবার খেতে পছন্দ করি এবং যেগুলো খেতে খুব একটা পছন্দ করি না সেটা আমরা গর্ভে থাকাকালীন সময়েই প্রকাশ করি। সেই সময় আমাদের খাবার সংক্রান্ত পছন্দগুলো পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে দেখা দেয়। তবে সেটা ১৫ থেকে ১৬ সপ্তাহের কথা। গর্ভের ২১তম সপ্তাহে ভ্রূণ নিজের গন্ধ এবং স্বাদের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে খাবারের প্রতি তার রুচিকে পুরোপুরি বোঝাতে সক্ষম হয়। তাই একটি শিশুকে গর্ভে থাকাকালীন সময়েই আপনি যে খাবারটি বেশি খাওয়াবেন কিংবা যে খাবারটির সাথে বেশি পরিচয় করিয়ে দিবেন, সে পরবর্তীতেও সেই খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি আকর্ষণ বোধ করবে। এটা তো খুব স্বাভাবিক বিষয় যে, আপনি কাউকে যে ব্যাপারটির সাথে বেশি পরিচয় করিয়ে দেবেন সে আর দশটা উপাদানের মধ্য থেকে সেই পরিচিত উপাদানটিকেই প্রথমে বেছে নেবে। এক্ষেত্রেও ঘটনাটি ঠিক তেমনই ঘটে।
এ ব্যাপারে করা এক পরীক্ষায় গর্ভকালীন সময়ের শেষ তিন সপ্তাহে সপ্তাহ প্রতি চারদিন করে গাজরের রস পান করতে দেওয়া হয় মায়েদের। এমনকি সন্তান জন্মের কিছুদিন পরেও স্তন্যদানের সময়েও গাজর গ্রহণের প্রক্রিয়াটি চালু রাখা হয়। ফলে দেখা যায় যে, শিশুরা গাজরের প্রতি বেশ সহজাত এক ধরনের আকর্ষণ নিয়ে বেড়ে ওঠে। কারণ সবসময়েই গাজরের সাথে পরিচিত ছিল তারা। অতএব, এটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, কেন শিশুরা জাঙ্ক ফুডের দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়। গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের খাদ্যাভ্যাস এক্ষেত্রে অনেকটা প্রভাব রাখে। কী? মন খারাপ হয়ে গেল? গর্ভকালীন সময়ে কেবল শাকসবজি খেয়ে থাকতে হবে ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলেন? ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। শিশুর খাদ্যাভ্যাস কেমন হবে সেটা তার বেড়ে ওঠার সময়ে পাওয়া শিক্ষা থেকেও নির্ধারিত হয়। তাই চেষ্টা করুন গর্ভকালীন সময়ে যতটা সম্ভব পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার। নিজেও সুস্থ থাকুন, গর্ভের শিশুটিকেও সুস্থ রাখুন!
ফিচার ইমেজ : BBC