আসিফের (আসিফ, একটি কাল্পনিক নাম) যখন জন্ম হয়, তখন অপারেশনকারী সার্জনের মুখটাও কিছুটা কুঁচকে গিয়েছিলো। যখন তাকে তার মায়ের কোলে তুলে দেওয়া হয়, তখন চারপাশের মানুষগুলোর মুখে হাসির বদলে ফুটে উঠলো অবিশ্বাস অার অস্বস্তির একটি ছাপ। অাসবেই না বা কেন? চ্যাপ্টা নাক, ছোট ছোট হাত-পা, কুঁচকানো চোখ বিশিষ্ট শিশুটিকে দেখলে যে কেউই ভয় পেতে বাধ্য। আসিফের বাবা-মা ভয় পেয়ে গেলেন। কী এমন অভিশাপ নেমে অাসলো তাদের ঘরে? এমন নানা চিন্তায় তারা যখন জর্জরিত, তখন পরিচিত এক শিশু বিশেষজ্ঞ জানালেন অাসল রহস্য। আসিফ মূলত একটি জন্মগত রোগের শিকার, যার নাম ডাউন সিন্ড্রোম।
ডাউন সিন্ড্রোম কী?
ডাউন সিন্ড্রোম জিনগত কারণে সৃষ্ট একটি বংশগত রোগ, যা ক্রোমোজোমের অসংগতির কারণে হয়ে থাকে। একটি স্বাভাবিক শিশু ৪৬টি ক্রোমোসোম নিয়ে জন্মায়। কিন্তু ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোজোম থাকার ফলে মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭টি। এই তারতম্যের জন্য শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে যা বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই সমস্যাকে ‘ট্রাইজোমি ২১’-ও বলা হয়।
সাধারণত ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের মানসিক সুস্থ শিশুদের তুলনায় ধীর গতিতে হয়।
শ্রেণীবিন্যাস
ডাউন সিন্ড্রোমের তিনটি প্রকরণ রয়েছে।
১. ট্রাইজোমি ২১
এটি কোষ বিভাজনের অস্বাভাবিকতার কারণে হয়ে থাকে। একে ননডিসজাংশন বলা হয়। ননডিসজাংশনে ২১ নাম্বার ক্রোমোসোমের ২টি কপির পরিবর্তে ৩টি কপি তৈরি হয়। এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোম অন্য কোষে রেপ্লিকেশন শুরু করে দেয়। প্রায় ৯৫% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।
২. মোজাইক ডাউন সিন্ড্রোম
এটি একটি বিরল ক্ষেত্র যেখানে একাধিক কোষে অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোজোমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে গর্ভসঞ্চারের সময় সুস্থ কোষের পাশাপাশি একাধিক বিকৃত কোষ জন্ম নেয়। প্রায় ১% রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগ দেখা দেয় ।
৩. ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিন্ড্রোম
এক্ষেত্রে শরীরের ২১তম ক্রোমোজোমটি ভেঙে গিয়ে অন্য আরেকটি ক্রোমোজোম (সাধারণত ১৪ নাম্বার) এর সাথে যুক্ত হয়। প্রায় ৪% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে।
ইতিহাস
উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে মানুষ এই রোগটি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সারে শহরের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী আবাসনের দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা জন ল্যাংডন ডাউন খেয়াল করেন, প্রতিবন্ধীদের মধ্যে একাংশ চেহারায় অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তাদের মুখ একটু চ্যাপ্টা এবং ঘাড়টা ছোট। তিনি তাদের নাম ‘মোঙ্গলয়েড’ রাখেন।
এরপর থেকে এটি ডাউন সিন্ড্রোম নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্থান পায়। জনাব ডাউন স্বতন্ত্র এবং আলাদাভাবে এই রোগের অস্তিত্ব বর্ণনা করেন। এজন্যই তাকে ‘ডাউন সিনড্রোমের জনক’ বলা হয়। ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের চিকিৎসক জেরমি লিজেউন এই রোগকে ক্রোমোজোমাল ব্যাধি হিসেবে শনাক্ত করেন।
ক্রিয়াকৌশল
আমাদের দেহ গঠনের একক হলো কোষ বা সেল। প্রতিটি মানব কোষের মধ্যে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম নামক অঙ্গাণু থাকে, যার অর্ধেক আসে মা আর অর্ধেক আসে বাবার কাছ থেকে। একেকটি ক্রোমোজোম একটি লম্বা সূত্রক বা ডিএনএ এর সমন্বয়ে তৈরি। ডিএনএ-কে বলা হয় আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহক। অর্থাৎ আমাদের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য, যেমন আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছুই ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
শিশুদের মধ্যে যারা ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে গঠন শেষ হয় ২১ নাম্বার ক্রোমোজোমের ৩টি কপির মাধ্যমে, যেখানে কপি হওয়ার কথা ছিল স্বাভাবিক নিয়মে দুটি। এ অতিরিক্ত একটি ক্রোমোজোমের কারণে মস্তিষ্কে এবং শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
কারণ
শরীরে ক্রোমোসোম সংখ্যার অসংগতির কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়। পরিবেশ, জাতি, সংস্কৃতি ও অন্যান্য কোনো নিয়ামকের সাথে এর সম্পর্ক নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন সঠিক জানেন না যে, হঠাৎ ক্রোমোসোম সংখ্যা কেন বেড়ে যায়। কিন্তু তারা মনে করেন, কিছু নিয়ামকের জন্য এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন-
মায়ের বয়স
একজন নারী যত বেশি বয়সে মা হন, তার সন্তানের ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মানোর আশঙ্কা তত বেশি হয়। ২৫ বছর বয়সী প্রতি ১২০০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজন, ৩০ বছর বয়সী প্রতি ৯০০ জনের মধ্যে একজন আর ৪০ বছর বয়সী প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে একজন ডাউন শিশুর জন্ম দেন।
বংশগত কারণ
মা-বাবার থেকে শিশুর এই রোগটি হবার সম্ভাবনা থাকে। বাবা বাহক হলে শিশুর ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হবার ৩% ঝুঁকি এবং মা বাহক হলে শিশুর ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হবার ১০-১৫% ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও প্রথম শিশুর ডাউন সিন্ড্রোম থাকলে পরবর্তী শিশুর ডাউন সিন্ড্রোম থাকার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পায়।
উপসর্গ
ডাউন সিন্ড্রোমের উপসর্গ প্রত্যেকটি শিশুর ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে। কেউ হয়তো সুস্থ হয়, আবার কেউ সাংঘাতিক শারীরিক ও মানসিক সমস্যার শিকার হয়।
শারীরিক উপসর্গ
• জন্মের সময় শিশুর ওজন ও উচ্চতা, গড় ওজন ও উচ্চতার চেয়ে কম থাকে।
• মুখমন্ডল, বিশেষত নাকের অংশটি চ্যাপ্টা থাকে।
• গলা ও কান তুলনামূলক ছোট অাকৃতির হয়ে থাকে।
• সবসময় মুখ দিয়ে জিহ্বা বের হয়ে ঝুলতে থাকে।
• পেশী ও অস্থিসন্ধিগুলো দুর্বল ও শিথিল হয়।
• হাত দৈর্ঘ্যে ছোট কিন্তু চওড়া হয় এবং তালুতে মাত্র একটি রেখার উপস্থিতি দেখা যায়।
• দাঁতের গোড়া ছোট এবং কৌণিক আকৃতি হয়ে থাকে।
মানসিক উপসর্গ
• শিশু দেরিতে কথা বলতে শেখে।
• বুদ্ধিমত্তা সাধারণের চেয়ে নিম্নমানের হয়।
• শিশু অমনোযোগী ও ছটফটে স্বভাবের হয়।
• অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তরা কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে।
জটিলতা
ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের কিছু জন্মগত বিকৃতি এবং জটিলতা থাকতে পারে।
• কানে সংক্রমণের ফলে বধিরতা বা কানে না শোনা।
• ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি অথবা ক্যাটারাক্ট।
• থাইরয়েড, অন্ত্র ও হৃদপিণ্ডে সমস্যা
• অ্যানিমিয়া বা শরীরে রক্তের স্বল্পতা।
• লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার।
• ওবেসিটি বা শরীরে মেদ বৃদ্ধি।
• জন্মের সময় জিহ্বায় ফোলাভাব, যা থেকে পরবর্তীতে ফিসারড টাং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
• স্থায়ী দাঁত উঠার সময় বিলম্ব হওয়া।
• দাঁত তাড়াতাড়ি পড়ে যাওয়া।
• মুখে অ্যাপথাস আলসার, ওরাল ক্যান্ডিডা সংক্রমণ এবং আলসারযুক্ত মাড়ি রোগ দেখা দেয়া।
রোগ নির্ণয়
১১-১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী মায়ের রক্তে প্যাপ-এ, এইচসিজি এবং ১৬ হতে ২০ সপ্তাহের মধ্যে এএফপি, ইসট্রিয়ল, এইচসিজি ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা পরীক্ষা করে ডাউন শিশুর জন্ম হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তাছাড়া আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে গর্ভাবস্থায় ১১-১৪ সপ্তাহের শিশুর ঘাড়ের তরলের মাত্রা, নাকের হাড়ের উপস্থিতি, ‘ডাকটাস ভেনোসাস’ নামক প্রাথমিক রক্তনালীর রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি নির্ণয়ের মাধ্যমেও ডাউন শিশু জন্ম নেয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
চিকিৎসা
এটি একটি জীবনব্যাপী সমস্যা। কিন্তু দ্রুত চিকিৎসা শুরু করালে এবং থেরাপির সাহায্যে শিশুর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যেতে পারে।
আর্লি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম
এই পদ্ধতিতে একাধিক সমস্যার চিকিৎসা, যেমন দৃষ্টিশক্তির উন্নতি বা ঐচ্ছিক পেশীগুলোর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ শিক্ষক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, ফিজিওথেরাপিস্ট, অক্যুপেশনাল থেরাপিস্টের একটি দল মিলে অাক্রান্ত শিশুকে ভাষা শেখানো, রোজকার কাজকর্ম এবং সমাজে নিজেকে মেলে ধরতে শেখান।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি
প্রতি ৫০০-৭০০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু ডাউন সিনড্রোম বা ডাউন শিশু হিসেবে জন্মগ্রহণ করতে পারে। আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় ৬,০০০ ডাউন শিশুর জন্ম হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫,০০০ বা প্রতিদিন প্রায় ১৫টি ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়।
করণীয়
• গর্ভকালীন সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
• ওষুধ গ্রহণে সতর্কতা থাকতে হবে।
• প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করতে হবে।
• জন্মের পর শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
• স্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুকে লালন-পালন করতে হবে।
• বেশি বয়সে সন্তান ধারণ রোধ করতে হবে।