Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিওফ্যাগি: মাটি খাওয়ার অদ্ভুত এক আসক্তি

জিওফ্যাগি বা মাটি খাওয়ার অভ্যাস খুব একটা নতুন কিছু নয়। প্রতিটি দেশেই শিশু, গর্ভবতী নারী কিংবা যেকোনো বয়সের যেকোনো মানুষের মধ্যে এই অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়। কারো কাছে এই অভ্যাস চলে আসে অনুকরণের মাধ্যমে। কারো ক্ষেত্রে ব্যাপারটি হয় স্বল্পস্থায়ী, কারো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু প্রশ্ন হলো- মানুষ কেন খাবার উপযোগী আর সবকিছু বাদ দিয়ে মাটি খেতে আগ্রহ বোধ করে? আসলেই কি মাটি ক্ষতিকর আমাদের শরীরের পক্ষে, নাকি কিছু ইতিবাচক দিকও আছে এই উদ্ভট খাদ্যাভ্যাসটির? ক্যামেরুনবাসী শীলা নামক এক তরুণী জানায়, তার মাটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে নিজের খালার কাছ থেকে খুব ছোট্ট বয়সে। ‘কাওলিন’ নামক একরকমের মাটি, যা কিনা প্যাকেটজাত অবস্থায় বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, সেটিই গ্রহণ করতেন শীলার খালা। আরো অনেকের মধ্যেই কাওলিন গ্রহণের অভ্যাস আছে বলে জানান শীলা। কাওলিন! কী এটি? চলুন, জেনে আসি কাওলিন সংক্রান্ত কিছু তথ্য।

মাটির খাবার; Source: BBC

বাজারে, বিশেষ করে ক্যামেরুনে কাওলিন খুব সহজপ্রাপ্য একটি উপাদান। বাংলাদেশেও যে এটি পাওয়া যায় না, তা নয়। এটি একধরনের শিল্পকাজে ব্যবহৃত খনিজ মাটি। জিওফ্যাগির ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এটি। কোনোরকম বাজে প্রভাব ছাড়াই এটি গ্রহণ করা সম্ভব। ফলে নিজের নিরাপত্তাটাও বেশ নিশ্চিত করতে পারেন এক্ষেত্রে জিওফ্যাগির ভুক্তভোগীরা। তবে কেবল যে কাওলিন তাদেরকে সাহায্য করে এমনটা নয়। জিওফ্যাগিতে আক্রান্ত মানুষ ছড়িয়ে আছে পৃথিবী জুড়ে এবং তাদের নিরাপত্তা ও সন্তুষ্টি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে মাটিকে ভিন্ন উপায়ে ব্যবহারও করছে বিভিন্ন দোকানগুলো। এবং এক্ষেত্রে প্রশাসন অবশ্যই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কারণ, পণ্যটি তো মাটি। কোনো মাদক নয়!

যুক্তরাষ্ট্রের করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওফ্যাগি বিশেষজ্ঞ সেরা ইয়াং বলেন, পৃথিবীতে জিওফ্যাগির ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রায় দুই যুগ ধরে পৃথিবীজুড়ে এই ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা চালান ইয়াং। আর্জেন্টিনা, নামিবিয়া এবং ইরানের মতো দেশগুলোতে মাটিকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করার এই অভ্যাসটি প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। দুটো বিশেষ দল- শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অন্য যে দেশগুলোতে জিওফ্যাগির পরিমাণ কম দেখা গিয়েছে, সেগুলোতে অনেকেই ব্যাপারটি ঠিক প্রকাশ করার মতো বলে মনে করেন না বিধায় এমন হয়েছে বলে মনে করেন ইয়াং। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় নিশ্চয় মাটি কিনতে পাওয়া যায় না। সেখানেও এই প্রবণতা দেখেন ইয়াং। তানজানিয়ার এক ছোট্ট গ্রামে গ্রাম্য একজন নারী ইয়াংকে জানান যে, গর্ভকালে দিনে দুবার তিনি দেয়াল থেকে মাটি উঠিয়ে খেতেন।

চিত্রে জিওফ্যাগি; Source: Wikimedia Commons

কথাগুলো অনেক বেশি অবাক করা এবং শরীর গুলিয়ে ওঠার মতো হলেও একটি ব্যাপার তো মানতেই হবে যে, মানুষ নিজে ঠিক করে তার খাবার। তাই আমরা সভ্য সমাজে সবাই যেটিকে খাবার মনে করি আর যা আমরা খেতে পারি না সেগুলোই সবকিছু নয়। এর বাইরেও এমন অদ্ভুত কিছু খাওয়ার আসক্তি থাকতে পারে। মানুষ একত্রে এমন ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের নাম দিয়েছে ‘পিকা’। ক্যামেরুনে ব্যাপারটি অদ্ভুত কিছু নয়। কেনিয়াতে দোকানে নানা দোকানে প্যাকেটজাত মাটি কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলোর অনেক ধরনের স্বাদও আছে। আমেরিকার জর্জিয়া নিজের হোয়াইট ডার্ট বা সাদা মাটির মানের জন্য বিখ্যাত। এগুলোর কোনোটাতেই লেখা থাকে না যে মানুষের খাবারের জন্য তৈরি হয়েছে প্যাকেটগুলো। তবে সবাই জানে, এমন হরেক মাটির উদ্দেশ্য কী!

আফ্রিকান যেকোনো মুদি দোকানে গিয়ে ‘প্রেগনেন্সি ক্লে’ চাইলে অবশ্যই খাওয়ার উপযোগী মাটি পাওয়া যাবে বলে জানান ইয়াং। কেবল তথ্যই জানেননি ইয়াং, সেইসাথে চেখে দেখেছেন প্যাকেট করা মাটিগুলো। প্রথমে খানিকটা শক্ত বলে মনে হলেও নিমেষে নরম হয়ে জিহ্বার সাথে আটকে যায় উপাদানটি। অনেকটা নরম মাংসের তালের মতো বলে নিজের জানান ইয়াং। বাস্তবেও আমরা মাটি বলতে যেটাকে বুঝে থাকি সেটি হলেও আরো একটু বেশি প্রক্রিয়াধীন এবং মানসম্পন্ন এই প্যাকেটজাত মাটি। শরীরের লৌহের অভাব পূরণ করা ছাড়াও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করে দেয় এই মাটি। অন্যদিকে খাবারের প্রস্তুতিতে, খাবারের বিষাক্ততা কমাতে এবং সেটাকে উপাদেয় করে তুলতে মাটির ব্যবহার অনেক আগে থেকেই চলে আসছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একর্ন নামক বাদামজাতীয় উপাদান দিয়ে তৈরি রুটি ক্যালিফোর্নিয়াতে বেশ ভালো চললেও এমনিতে সেটি খেতে উপাদেয় নয়। প্রথমে তাই মাটির সাথে বাদাম গুঁড়ো করে তারপর খাবারের উপযোগী হিসেবে তৈরি করা হয় একর্নকে।

খাবার টেবিলে মাটি; Source: BBC

অনেকে আবার ভাবেন, মাটি খাওয়ার সাথে রক্তস্বল্পতার ব্যাপারটি ভালোভাবে জড়িত। শরীর আয়রন না থাকলে সেটি রক্তাল্পতা তৈরি করে। আর সে কারণেই মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, যাদের শরীরে রক্তস্বল্পতার মতো ব্যাপার আছে, তারা মাটি খাওয়ার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, খাবারের অভাব দেখা দিলে এবং যথাযথ পুষ্টি না পেলে মানুষ জিওফ্যাগির প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে পূর্বে দেখানো কারণের তুলনায় এই কারণটিকে বেশ নড়বড়ে এবং দুর্বল মনে হওয়ায় অনেকেই এটিকে গোনার মধ্যেই ধরেন না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জুলিয়া হোমেস বলেন, শারীরিক কোনো চাহিদার চাইতে মানসিক ব্যাপারটাই অনেক বেশি সাহায্য করে মানুষকে জিওফ্যাগিতে আক্রান্ত হতে। তার মতে, মানুষ যদি তার চারপাশে দেখতে পায় যে, সবাই আইসক্রিম বা চকোলেটের প্রতি আসক্তি বোধ করছে কিংবা চিপস বা পিজ্জা খেতে চাইছে, তাহলে মানসিকভাবে সে-ও এমন কিছুই খেতে চাইবে কিংবা খাওয়ার আগ্রহ বোধ করবে। কিন্তু ক্যামেরুনে, যেখানে অনেকেই মাটি খেতে, অর্থাৎ জিওফ্যাগি বিষয়টির সাথে অভ্যস্ত, সেখানে অন্যরাও তেমন কিছুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে সেটাই স্বাভাবিক। সহজলভ্যতাও এক্ষেত্রে একটি বড় ব্যাপার। যেটি আপনার হাতের কাছে নেই, সেটি সম্পর্কে আপনি নিশ্চয় খুব বেশি ভাববেন না এবং খাওয়ার আগ্রহ জন্মানোর জন্য যে চিন্তাটুকু করার দরকার পড়ে সেটিও করবেন না।

মাটি খাচ্ছে তোতারা; Source: Twitter

গবাদিপশু, হাতি, তোতা, বাঁদুরের মতন প্রাণীরাও জিওফ্যাগিতে অভ্যস্ত। নিজেদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদা থেকেই তারা এই অভ্যাসটি আয়ত্ত করেছে। আর সেটা যে উপকারী, তা-ও সবাই মেনেও নিয়েছে। তবে এই সবাই এখনো এটি মেনে নিতে পারেননি যে, একই ব্যাপারটি মানুষের ক্ষেত্রেও কখনো কখনো স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে। ২০০০ সালে ইউএস এজেন্সি ফর টক্সিক সাবস্ট্যান্সেস এন্ড ডিজিজ রেজিস্ট্রি এক গবেষণার ফলাফল হিসেবে জানায় যে, সেখানে মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম মাটি গ্রহণ করছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান না, কারণ তাদের বক্তব্যানুসারে, ব্যাপারটি পুরোপুরি সাংস্কৃতিক। ফলে এ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। তবে বাস্তবে অনেক সময় মাটির সাথে বিষাক্ত উপাদান মিশে থাকার ভয় থেকে যায়। যেটা হয়তো একটু হলেও দূর করা সম্ভব। কিন্তু যে শিশু বা বয়স্ক মানুষকে আপনি জিওফ্যাগি স্বাভাবিক না ব্যাপারটি বোঝালেন, তারা কিন্তু নিজেদেরকে অস্বাভাবিক আর সবার থেকে আলাদা কিছুই ভেবে নেবে। প্রভাবটা পড়বে মানসিক স্বাস্থ্যে। এর অর্থ এই নয় যে, মাটি খাওয়ার ব্যাপারটি ভালো না খারাপ সেটা নিয়ে কোনো উপসংহার টেনে ফেলা গেল। তবে যা করা সহজ, যে উপায়ে করা সহজ এবং কম ক্ষতিকর সেটি অবলম্বন করাই উচিত। তা জিওফ্যাগি নামক অভ্যাসটি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেই হোক কিংবা অভ্যাসটি থেকে কাউকে সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে হোক।

ফিচার ইমেজ: Alibaba

Related Articles