“মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে, কিন্ত সর্বত্রই সে শেকল দ্বারা আবদ্ধ”। জ্যাঁ জ্যাক রুশো-র সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা সবাই জানি। আজকের বিষয়ের সাথে এই উক্তিটি যেন খাপে খাপে মিলে যায়।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং তাঁর যুগান্তকারী থিওরি দ্য স্ট্রাকচার অব দ্য মাইন্ড নিয়ে আমরা যতটা জানি, ফ্রয়েড-কন্যা অ্যানা ফ্রয়েড সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে কম জানি।
অ্যানা ফ্রয়েডের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
অ্যানা ফ্রয়েড ছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মার্থা বার্নেসের ৬ষ্ঠ ও কনিষ্ঠ কন্যা। জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে ৩ ডিসেম্বর ১৮৯৫ সালে। তাঁকে মনোবিজ্ঞানের একটি শাখা- শিশু মনোবিশ্লেষণ এর জনক বলা হয়।
অ্যানা ফ্রয়েডের শৈশব ছিল জটিলতায় পরিপূর্ণ। অন্য ভাই-বোনদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না। তিনি বেশিরভাগ সময়ই ভুগতেন হতাশায় এবং এর থেকে উদ্ভব ঘটে এনোরেক্সিয়া বা খাদ্যের প্রতি অনীহাজনিত রোগের।
সুশ্রী না হওয়ার ফলে তিনি তার বড় বোন সোফি ফ্রয়েডকে ঈর্ষা করতেন। বাবা সিগমুন্ডের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দুই বোনে চলতো বেশ প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে, মায়ের প্রতি অ্যানার ছিল একটু ক্ষোভ।
বোনের মতো রূপ না হলেও অ্যানা ফ্রয়েড ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। ১৯১২ সালে তিনি ভিয়েনার কটেজ লাইসিয়াম স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করেন এবং তৎপরবর্তী ১৯১৪ সালে সে স্কুলেই একজন সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। অসুস্থতার কারণে ১৯২০ সালে সে চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর তিনি একে একে কাজ করেন ভিয়েনার ইন্টারন্যাশনাল সাইকোঅ্যানালিটিকাল অ্যাসোসিয়েশন (১৯২৫) ও সাইকোঅ্যানালিটিকাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে (১৯৩৫)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী দ্বারা অস্ট্রিয়া দখল হলে ফ্রয়েড পরিবার লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানে কিছুকাল কাজ করার পর অ্যানা ফ্রয়েড ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন হেম্পস্টেড চাইল্ড থেরাপি কোর্স এন্ড ক্লিনিক, যেখানে যুদ্ধাহত বা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মানসিক পরিচর্যা এবং দেখাশোনা করা হতো।
প্রতিরক্ষা কৌশল তত্ত্ব
এবার আসা যাক অ্যানা ফ্রয়েডের বহুল আলোচিত তত্ত্বে। অ্যানা ফ্রয়েডের উল্লেখযোগ্য সব কাজ শিশুদের নিয়ে হলেও তাঁর চিন্তার মূলে সবসময়ই ছিলেন তাঁর বাবা সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তাঁর কাজের উপর সিগমুন্ডের এতই প্রভাব লক্ষ্যণীয় ছিল যে প্রখ্যাত ফরাসি মনোবিশ্লেষক জ্যাকুয়াস লাকান মন্তব্য করেন, অ্যানা ফ্রয়েডের সব চিন্তাই তাঁর পিতার ধারণা থেকে নিষ্কাশিত।
প্রতিরক্ষা কৌশল কী?
আমরা ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বের তিনটি ভাগ সম্পর্কে জানি- ইদ, ইগো বা অহম এবং সুপারইগো বা অতি-অহম। ইদের লাগামছাড়া ইচ্ছা এবং সুপারইগোর সাবধান, সর্তক, নৈতিক চাহিদার মধ্যে একটি সেতু হলো ইগো বা অহম। অহম আমাদের ইদের অপূরণযোগ্য ইচ্ছাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতার আলোকে পুনঃরূপ দেয়। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন ‘রোর বাংলা’র এই লেখাটি।
কিন্ত আসলে অহম বা ইগো এই ‘পুনঃরূপ’ দেয়ার কাজটি কীভাবে করে?
ইগোর কাজ সম্পর্কে সিগমুন্ড ফ্রয়েড আমাদের অন্ধকারের মধ্যে রাখলেও তাঁর কন্যা এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেন। এতে মনোবিশ্লেষণে ফ্রয়েডের তত্ত্বের ভিত্তি আরও মজবুত হয়।
*বিঃ দ্রঃ- পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে এখানে ফ্রয়েড বলতে সিগমুন্ড ফ্রয়েড-কে বোঝানো হয়েছে এবং অ্যানা ফ্রয়েডের ক্ষেত্রে শুধু অ্যানা ব্যবহার করা হয়েছে।
ইগো এন্ড ম্যাকানিজমস অব ডিফেন্স (১৯৩৬)
অহমকে রক্ষা করার জন্য মানুষ কী ধরনের প্রতিরক্ষা কৌশল অবলম্বন করে, তার বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার এই বইটিতে। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখে নেয়া যাক ডিফেন্স ম্যাকানিজমস বা প্রতিরক্ষা কৌশল বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে।
অহমের কাজ ইদ এবং অতি-অহমের মধ্যে সাম্যাবস্থা তৈরি করা। কিন্ত এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবেই শুধু আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সমাজে চলতে হলে এমন অনেক বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয় যা আমাদের চিন্তাভাবনা অর্থাৎ অহমকে আঘাত করতে পারে। এ সমস্ত আঘাত থেকে বাঁচার জন্যই অহম কিছু কৌশল বেছে নেয়, যাকে আমরা ইগোর ডিফেন্স ম্যাকানিজম বলতে পারি।
আমরা সকলেই জেনে বা না জেনে যে যে প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করি
১) অবদমন- রিপ্রেশন ও সাপ্রেশন
অ্যানা ফ্রয়েড তাঁর বাবার মতোই বলেন যে, সবচেয়ে প্রভাবশালী ম্যাকানিজমটি হচ্ছে রিপ্রেসন বা অবদমন। ইডিপাস-ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স বা অন্য যেকোনো কিছু যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থান সাপেক্ষে সবার কাছে প্রকাশ করা সম্ভব না, মূলত সেসব ইচ্ছাকে মনের ভিতর দাবিয়ে রাখাকে অবদমন বলে। রিপ্রেশন একটি অবচেতন প্রক্রিয়া। এমন সব ইচ্ছা যা সম্পর্কে ব্যক্তি নিজেই হয়তো জানে না কিন্তু তার অবচেতন মন সেসব নিষিদ্ধ ইচ্ছাকে নিজ দায়িত্বে অবদমিত করে।
অন্যদিকে সাপ্রেশন বা জোরপূর্বক অবদমন একটি সচেতন মানসিক প্রক্রিয়া। যেমন বোঝার ক্ষমতা হওয়ার পর একটি শিশু যদি রাতে বিছানা নোংরা করা বন্ধ করে দেয় তাহলে বুঝতে হবে তার মধ্যে সাপ্রেশনের সচেতন প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গিয়েছে।
২) অস্বীকৃতি বা ডিনায়াল
অ্যানার মতে, এটি শিশুদের মধ্যে বেশি লক্ষ্যণীয়। যখন একটি শিশুর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তার মানসিক ‘বাস্তবতা’র মধ্যে মিল থাকে না তখন সে তা অদেখা বা অস্বীকার করতে চেষ্টা করে। হয়তবা মেনে নিতেই অসম্মতি জানায়। যেমন একটি খেলনা দেখে পছন্দ করা, খেলনাটি কিনতে না পারলে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক আচরণ বা কান্নাকাটির মাধ্যমে সেটি পাওয়ার চেষ্টা করা।
তবে ডিনায়াল শুধু বাচ্চাদের মধ্যেই থাকে না। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডিনায়ালের প্রকাশ ঘটে আত্মহননের মাধ্যমে। যখন সকল সম্ভাব্য পথ তাদের বন্ধ মনে হয়, তখন তারা তাদের অবস্থাকে মেনে না নিতে পেরে জীবন শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন।
৩) প্রত্যাগতি বা রিগ্রেশন
এটি অবদমনের উল্টো আচরণ। রিপ্রেশনে যেখানে আমরা অনুভূতি চেপে রাখি, এই স্টেজে যেন তা আরও বেশি করে প্রকাশ করতে চাই- অনেকটা উদগীরণের মতো। আমরা প্রায়ই বলি যে, “যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ”। আমরা প্রত্যেকে পুরনো দিনগুলোকে বেশি সুখের মনে করি এবং কোনো খারাপ সময়ের সম্মুখীন হলে ভাবি যে যদি আগের দিনে ফিরে যেতে পারতাম। এটিই হয় এই প্রক্রিয়ায়- আমরা ক্ষণিকের জন্য আমাদের অতীতের কাজগুলো করি মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে।
এবার আসা যাক আরো পরের প্রক্রিয়ায়। এগুলো আমরা গ্রহণ করি, যখন আমরা জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়ে পরিপক্কতা অর্জন করি।
৪) বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ বা ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশন
এখানে আমরা একটি বেদনাদায়ক বা অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যুক্তি ও জ্ঞানের সাহায্য নেই। একটি মজার উদাহরণ হতে পারে পরীক্ষার আগের রাতের পড়া। অনেক পড়া জমে থাকা, এই কারণে পরীক্ষায় খারাপ ফল করা- এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু পারা যায় পড়ার চেষ্টা করা এই ধরনের ম্যাকানিজমের মধ্যে পড়ে।
৫) যৌক্তিকতা বিধান বা র্যাশনালাইজেশন
অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কোনোরকম জুতা জোড়া পরে রওনা হলেন। অফিসে পৌঁছে দেখলেন দুটি ভিন্ন রঙের জুতো পরে চলে এসেছেন। এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। আমাদের এমন অসতর্ক কাজকর্মের জন্য লজ্জা বা হতাশা থেকে বাঁচতে আমরা আমাদের কাজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাই। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, গতকাল রাতে ঘুম হয়নি আর কাজের চাপের কারণে আপনার মনোযোগ ছিল না জুতোর দিকে”। ব্যাস! হয়ে গেল।
৬) পরমানন্দ বা সাবলিমেশন
ফ্রয়েডের মতে, সাবলিমেশনই সবচেয়ে কার্যকরী এবং উপকারী ডিফেন্স ম্যাকানিজম। যখন আমাদের ভেতরের অসঙ্গতি কোনো শিল্প বা যেকোনো নতুন তথ্য-জ্ঞান তৈরিতে প্রকাশ পায়, তাকে সাবলিমেশন বলে। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন নিহত হওয়ার কারণে এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যদি কেউ সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করার কাজ নেয়, তাহলে তা সাবলিমেশন।
এখানে অ্যানা ফ্রয়েড নিজেই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ছোটবেলা থেকেই বাবা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের প্রিয় কন্যা ছিলেন তিনি। বাবার প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকেই তাঁর কাজকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি তাঁর (অ্যানা) ডিফেন্স ম্যাকানিজম থিওরিটি প্রস্তাব করেন।
শেষ কথা
এই অল্প কয়টি নয়, ডিফেন্স ম্যাকানিজমের অনেক রকম ভাগ রয়েছে। একই সময়ে যে শুধু একটিমাত্র ম্যাকানিজম কাজ করে, তা-ও বলা যায় না। আমাদের একই আচরণের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা একাধিক প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করতে পারি।
ইগো বা অহমের কাজ যে শুধু ‘ভারসাম্য’ বিধান নয়, বরং ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে স্থিতিশীল রাখার জন্য তাকে পারিপার্শ্বিক ‘আক্রমণ’ থেকেও রক্ষা করা- এই ধারণাটির জন্ম দেন অ্যানা ফ্রয়েড।
সমাজ আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে আদর্শিকভাবে আমাদের অনেক কম সংখ্যক ডিফেন্স ম্যাকানিজম ব্যবহার করার কথা। কিন্ত তেমনটি কী হচ্ছে? নাকি আমাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের তালিকা সময়ের সাথে সাথে বড় হচ্ছে?
আপনাদের কী মনে হয়?
তথ্যসূত্র:
Susan Krauss Withbourne, The Essential Guide to Defense Mechanisms, Psychology Today.
New World Encyclopedia, Defense Mechanisms
Retrieved on: 19 March,2018