হার্লেকুইন ইকথিওসিস: অদ্ভুত ত্বক নিয়ে জন্মায় যে শিশু

জন্মের পরপরই জেনির ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটি সজোরে কাঁদতে শুরু করল। তবে এই কান্না জেনি দম্পতির ঘরে খুশির বার্তা বয়ে আনল। পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনে মা-বাবা দুজনেই অত্যন্ত খুশি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, কখন মেয়ের কোমল ত্বক স্পর্শ করবেন। কিন্তু ডাক্তার জানালেন, এ মুহূর্তে তারা বাচ্চার ত্বক স্পর্শ করতে পারবেন না, কারণ এতে করে স্বাস্থ্য-ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে। তাদের জন্য যেন আচমকা আকাশ ভেঙে পড়ল।

সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটিকে তারা ছুঁয়েও পর্যন্ত দেখতে পারবেন না! বিচলিত দম্পতি তাদের মেয়েকে একনজর কেবল দেখতে চাইলেন। যখন বাচ্চাটিকে দেখানো হলো, তারা খেয়াল করলেন ওর স্নিগ্ধ কোমল শরীরের সম্পূর্ণ অংশ জুড়েই ধবধবে সাদা পুরু চামড়ার একটি স্তর আর সেটি কেমন যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে এবং ত্বকের মাঝে মাঝে রক্তবর্ণের অসংখ্য ফাটল। চোখ ও ঠোঁটগুলো বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

সন্তানের এরকম অদ্ভুত গড়ন দেখার জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না, তার নিজের চোখ যেন নিজেকেই ধোঁকা দিচ্ছিল। উপস্থিত ডাক্তারেরা তাকে শান্ত করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন এবং আশ্বস্ত করেন যে, তারা বাচ্চাটিকে সাহায্য করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু বিধ্বস্ত মাকে কোনোভাবেই শান্ত করা গেল না, তাই শেষমেশ বাধ্য হয়েই ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করতে হলো। ঘুম থেকে উঠার পর ডাক্তারেরা তাকে জানালেন, তার মেয়ে একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছে, যার নাম হার্লেকুইন ইকথিওসিস

হার্লেকুইন ইকথিওসিসে আক্রান্ত শিশু; Image source: Relayhero

কী?

এটি একটি বিরল দুরারোগ্য ব্যাধি, যা প্রধানত ত্বকের উপর দেখা যায়। হার্লেকুইন বেবি সিনড্রোম, হার্লেকুইন ফিটাস নামেও এটি পরিচিত। হার্লেকুইন নামটি ১৯৮৮ সালে প্রথম ব্যবহার করেন জেমস ডব্লিউ ল্যান্স এবং তার সহযোগী পিটার ড্রামমন্ড। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অর্ধ রক্তিম মুখের অবয়বের সাথে ইতালির বিখ্যাত কমেডিয়া ডেল’আর্টের হার্লেকুইন মাস্কের সাদৃশ্য খুঁজে পান, তাই এরকম নামকরণ করেন।

এ রোগের প্রথম লিপিবদ্ধ নজির পাওয়া যায় আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিনায়, ১৭৫০ সালে। আগে এই রোগে আক্রান্ত নবজাত শিশুরা কয়েক সপ্তাহের বেশি বাঁচত না। তবে সঠিক চিকিৎসা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আক্রান্ত অনেকেই তাদের যৌবন পার করতে সক্ষম হয়েছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্কজন হলেন ব্রিটেনের নুসরিত শাহিন

জীবিত রোগীদের মধ্যে প্রবীণতম ব্রিটেনের নুসরিত শাহিন; Image source: Channel5

কারণ

মারাত্মক এই জিনগত ব্যাধিটি এবিসিএ১২ নামক একটি প্রচ্ছন্ন জিনের মিউটেশনের কারণে ঘটে। এ জিনটি শরীরে এমন একটি ট্রান্সপোর্টার প্রোটিন অণু তৈরিতে ভূমিকা পালন করে, যা ত্বকের বহিঃস্তরে ফ্যাট পরিবহণ করে এবং এর বিকাশে সহায়তা করে। জিনের মিউটেশন কোষ থেকে এবিসিএ১২ প্রোটিন তৈরিতে বাধা প্রদান করে। ত্বকের স্বাভাবিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়, যার কারণে এ রকম অদ্ভুত চেহারার শিশু জন্ম নেয়।

বংশগতি

এ জিন পিতামাতা থেকে সন্তানের মাঝে অটোসোমাল রিসিসিভ প্যাটার্নে সঞ্চারিত হয়। এর অর্থ হলো, একটি শিশু তার বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকে একজোড়া মিউট্যান্ট বা ত্রুটিপূর্ণ জিনের কপি লাভ করলে এ অবস্থা প্রকাশ পায়। আর যেকোনো একজনের কাছ থেকে  জিনের কপি লাভ করলে সে বাহক হবে, সেক্ষেত্রে রোগ প্রকাশের সম্ভাবনা নেই। হার্লেকুইন ইকথিওসিস অত্যন্ত বিরল একটি রোগ। প্রতি পাঁচ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়।

অটোসোমাল রিসিসিভ ইনহেরিটেন্স; Image source: Healthjade

উপসর্গ

এ রোগ মূলত ত্বকের উপর প্রভাব ফেলে। আক্রান্ত শিশু নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়-

  • ত্বক শুষ্ক, ডায়মন্ড আকৃতির পুরু ত্বকীয় প্যাচ দেখা যায় (হাইপারকেরাটোসিস);
  • প্যাচগুলোর ফাঁকে ফাঁকে শাখা-প্রশাখার মতো বিস্তৃত গাঢ় ফাটল হতে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ হতে পারে;
  • নিচের চক্ষুপল্লব দুটি বাইরের দিকে ঝুলে পড়ায় (এক্ট্রোপিওন) চোখ দুটি সামনে স্ফীত হয়ে আসে;
  • বহিঃকর্ণ অনুপস্থিত থাকতে পারে, ফলে কান গর্তের মতো দেখায়;
  • নাক সমতল, ঠোঁট বাইরে বেরিয়ে আসে (এক্লাবিয়াম), যা খাদ্য গ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি করে;
  • মাইক্রোসেফালি।

ত্বকের ত্রুটিপূর্ণ বিকাশের কারণে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়-

  • দেহে পানি স্বল্পতা দেখা দিতে পারে;
  • দেহের তাপমাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে; 
  • রক্তে ইনফেকশন হতে পারে (সেপসিস);
  • শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে।

রোগ নির্ণয়

হার্লেকুইন ইকথিওসিস নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হয়-

  • শিশুর শারীরিক পরীক্ষা, যা ত্বকের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে নিশ্চিত হওয়া যায়;
  • জেনেটিক টেস্টিংয়ের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ জিন শনাক্ত করার মাধ্যমে; 
  • গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। 
Image: Pinterest

চিকিৎসা

এ রোগের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই। তবে আক্রান্ত শিশুকে সাধারণত নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সহায়ক যত্নের মাধ্যমে বাঁচানো সম্ভব। রোগের জটিলতাসমূহ প্রতিরোধ করা উচিত বা আগে ভাগে রোগ নির্ণয় করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করা প্রয়োজন। শিশু জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহ বেঁচে গেলে বিপদের আশংকা কমে আসে। সদ্যজাত শিশুর নিম্নোক্ত প্রারম্ভিক চিকিৎসার দরকার-

  • শিশুর শরীরের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য ইনকিউবেটরে রাখা দরকার। ইনকিউবেটর আর্দ্র ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে এবং বাচ্চার অবস্থা স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই রাখা উচিত;
  • পানিস্বল্পতা রোধ করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফ্লুইড ও ইলেকট্রোলাইট দেওয়া প্রয়োজন;
  • ত্বকের নিরাময়ের জন্য Isotretinoin জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়;
  • লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা হয় চোখের সুরক্ষার জন্য;
  • অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং ত্বকের প্রখরতার কিছুটা উপশম সম্ভব।

রোগ ব্যবস্থাপনা

যেহেতু এই রোগ পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়, তাই প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্বক আমাদেরকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব থেকে রক্ষা করে এবং সেইসাথে দেহের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এ কারণে আক্রান্ত  শিশুর ত্বককে পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত, আর্দ্র ও কোমল রাখা খুবই জরুরী। শুষ্ক ও আঁটসাঁট ত্বকে ফাটল ধরতে পারে এবং জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই গোসলের সময় দীর্ঘক্ষণ শরীর পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং গোসল শেষে ত্বকে অয়েন্টমেন্ট ও ময়েশ্চারাইজার প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে ত্বক সবসময় আর্দ্র থাকে।

রোগের সাথে অনবরত লড়াই চালিয়ে যাওয়া ‘অ্যানা’; Image source: Instagram/harlequindiva

জেনির কথা হয়তো কেউ কেউ জেনে থাকবেন। তিনি তার মেয়ের নাম রেখেছেন ‘অ্যানা’। মেয়েটি প্রাথমিকভাবে শংকামুক্ত হয়ে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে তাকে সবসময়ই নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও যত্নের মধ্যে রাখতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই বিপত্তি ঘটতে পারে।

জেনি অ্যানাকে প্রতিদিন দু’বার গোসলের জন্য কমপক্ষে চার ঘণ্টা ব্যয় করেন, কারণ শরীর আর্দ্র রাখার জন্য দীর্ঘক্ষণ পানিতে রাখতে হয়। পাশাপাশি প্রতি ছয় ঘণ্টা পর পর তার ত্বকে অ্যাকোয়াফোর ও দিনে একবার অ্যালোভেরা লোশন লাগাতে হয়। মেয়ের জন্য নিবেদিত বাবা-মা পুরো সময় তার যত্ন নেওয়ার তাগিদে তাদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এবং সন্তানকে বাঁচানোর জন্য সাধ্যের মধ্যে যা করা সম্ভব, ঠিক তা-ই করবেন।

সন্তান দেখতে যেরকমই হোক, যত বড় সমস্যাই থাকুক না কেন শত হলেও সে তার মায়ের গর্ভে ধারণকৃত সন্তান; তাই শুধুমাত্র একটু সঠিক চিকিৎসা ও যত্নের অভাবে সন্তানের প্রাণ তারা হারাতে দিতে পারেন না। ওরা কারো করুণার পাত্র হতে চায় না, শুধুমাত্র একটু ভালোবাসা আর যত্নই কাম্য কারণ পৃথিবীর এই আলো-বাতাসে বেঁচে থাকার ওদেরও অধিকার রয়েছে।

This is a bangla article. This is about a rare disease found in newborn babies named 'Harlequin Ichthyosis'. Necessary sources have been hyperlinked.

Featured Image: Yahoo News Australia

RB-TI/SM

Related Articles

Exit mobile version