আমাদের শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাসায়নিক পদার্থ হলো ‘অ্যাডিনোসিন’। শরীরের সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি জিনিস বলতে গেলে শরীরে নেই। তবে অ্যাডিনোসিনের হিসেব আলাদা, এর উপস্থিতি শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে। প্রতিটি কোষে অ্যাডিনোসিন রয়েছে, এতটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব হচ্ছে কারণ ডিএনএ তৈরির চারটি নাইট্রোজেন ক্ষারকের একটি হলো অ্যাডিনোসিন। এই আলোচনা বলতে গেলে অ্যাডিনোসিনকে ঘিরেই।
অ্যাডিনোসিনের ধারণা থেকে সরে এসে ক্যাফেইন সম্পর্কে বলা যাক। ক্যাফেইন শব্দটি আমাদের অতি পরিচিত, শুনতে শুনতে সুপরিচিত, এটি কী জিনিস, কীভাবে কাজ করে এসব ব্যাপারে বিস্তারিত জানা নেই।
ক্যাফেইন তার কাজ শুরু করে মস্তিষ্কে, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক অবস্থাকে বদলে দিয়ে। পুরো মানবদেহকে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে ইলেক্ট্রিক সিগনাল তৈরির মাধ্যমে। ইলেক্ট্রিক সিগনাল নিউরনের মাধ্যমে পৌঁছে যায় সমস্ত দেহে। ক্যাফেইন একটি নির্দিষ্ট ইলেক্ট্রিক সিগনালকে ব্যাহত করে থাকে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয়তো জানা নেই, কিন্তু ক্যাফেইনের কাজ কী সেই ব্যাপারে আমাদের নিশ্চয়ই ধারণা রয়েছে।
ক্যাফেইন শরীরে প্রবেশের পর আমাদের সহজে ঘুম পায় না, রাত জাগতে কিংবা না ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে থাকে এই ক্যাফেইন। যে রাসায়নিক পরিবর্তনের দরুণ মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রিক সিগনাল তৈরি হয়ে ঘুমের উদ্রেক করে, সেই রাসায়নিক বিক্রিয়াকেই যদি কোনোভাবে প্রতিহত করা যায়, তাহলে ঘুমের ইলেক্ট্রিক সিগনালটিও তৈরি হবে না, আমাদের আর ঘুমও পাবে না।
মস্তিষ্কের নিউরনে থাকে অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টর। আমাদের শরীরে প্রচুর রিসেপ্টর রয়েছে, রিসেপ্টরে কাঙ্ক্ষিত কোনো পদার্থ যুক্ত হয়ে দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখে। নিউরনের অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টরে এসে যখন অ্যাডিনোসিন যুক্ত হয়, তখন আমাদের শরীরে যেসব ইলেক্ট্রিক সিগনাল তৈরি হয় সেগুলো স্তিমিত হয়ে আসে। শুরুতেই বলা হয়েছে, অ্যাডিনোসিন শরীরের জন্য খুবই দরকারী একটি পদার্থ, দৈনন্দিন কার্যাবলী থেকেই শরীরে এই অ্যাডিনোসিন তৈরি হয়।
ক্যাফেইন আর অ্যাডিনোসিনের রাসায়নিক গঠন প্রায় একই হওয়াতে একটি নিউরন এই দুই পদার্থের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। মস্তিষ্কে যখন ক্যাফেইন গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন ক্যাফেইন নিজেই যুক্ত হয়ে যায় অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টরগুলোতে। অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টরে অ্যাডিনোসিন যুক্ত হয়ে যেভাবে স্নায়ুতন্ত্রকে স্তিমিত অর্থাৎ ধীর গতির করে দিতো, ক্যাফেইন যুক্ত হয়ে সেটি আর হতে দেয় না। নিউরনগুলোও অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টরে আর চিরচেনা অ্যাডিনোসিনকে খুঁজে পায় না। তখন মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রকে স্তিমিত করার পরিবর্তে উল্টোটা করে বসে, শরীরকে চাঙা করে তোলে এবং শরীরের কার্যাবলীকে দ্রুতগতির করে তুলে।
এই ক্যাফেইন শুধু যে ঘুম দূর করে তা-ই নয়, মস্তিষ্কে অ্যাডিনোসিনের অন্যান্য কাজকেও প্রতিহত করে থাকে ক্যাফেইন। মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ করে থাকে যেসকল রক্তনালী, সেগুলোকে প্রশস্ত করবার কাজও করে থাকে অ্যাডিনোসিন। রক্তনালী প্রশস্ত হলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহও বেড়ে যায়, ফলে অক্সিজেন পৌঁছায় দ্রুত এবং অধিক পরিমাণে। অ্যাডিনোসিনের পরিবর্তে যদি ক্যাফেইন কাজ করতে শুরু করে, সবকিছুই মস্তিষ্কে উল্টো হয়, স্নায়ুতন্ত্র স্তিমিত হবার পরিবর্তে দ্রুতগতিতে কাজ করতে শুরু করে, একই মসাথে রক্তনালীগুলোর বেধও কমে আসে তখন। ফলে রক্তপ্রবাহ মস্তিষ্কে কমে যায়। প্রশস্ত রক্তনালীর অধিকতর রক্তপ্রবাহের দরুণ কিছু কিছু মাথাব্যথার সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেই ক্ষেত্রে ক্যাফেইন খুবই সুন্দরমতো কাজ করে, রক্তনালীকে সংকুচিত করার মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ কমিয়ে মাথাব্যথা থেকে দেয় মুক্তি।
সব ধরনের মাথাব্যথাতেই কফি খেলে সেরে যাবে এমন কিন্তু নয়, অধিক রক্তপ্রবাহের কারণে যে মাথাব্যথার উৎপত্তি কেবলমাত্র তখনই কফি অর্থাৎ মস্তিষ্কে ক্যাফেইনের উপস্থিতি অনেক দরকারী।
ক্যাফেইন যেহেতু অ্যাডিনোসিনকে কাজ করতে দিচ্ছে না আর, সেহেতু মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রিক সিগনালের আনাগোনাও ততক্ষণে বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। মস্তিষ্কের নিচে অবস্থিত ছোট করে একটি গ্রন্থি থাকে, যার নাম পিটুইটারী গ্রন্থি, দেহের সকল গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই গ্রন্থিটি। পিটুইটারী যখন টের পায় যে, মস্তিষ্কে হঠাৎ করে ইলেক্ট্রিক সিগনালের আনাগোনা বেড়ে গেছে, সে ধরে নেয় শরীরের বাইরে হয়তো কোনো জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে এবার। পিটুইটারী গ্রন্থি তখন হরমোন ক্ষরণের মাধ্যমে বৃক্কে উপস্থিত অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে আদেশ পাঠায়, দ্রুত এপিনেফরিন নামক একটি হরমোন ক্ষরণ করতে হবে। আদেশ পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিটি এপিনেফরিন হরমোন ক্ষরণ করে রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় শরীরে।
এই এপিনেফরিনই মূলত আমাদের শরীরকে চাঙা করে তুলে। ঘুমে যে চোখ নেতিয়ে আসছিলো, এপিনেফরিনের উপস্থিতিতে চোখের পিউপিল তখন প্রসারিত হয়, ফলে অধিক পরিমাণে চোখে আলো প্রবেশ করে। হৃৎপিন্ড দ্রুত স্পন্দন তৈরি করতে শুরু করে। এতে করে শরীরের সমস্ত রক্তনালীতে রক্তপ্রবাহের মাত্রাও বেড়ে যায়, সেই সাথে রক্তের চাপও খানিকটা বৃদ্ধি পায়। পাকস্থলীতে রক্ত প্রবাহ কমে আসে, শরীরকে কার্যক্ষম করতে শক্তি তো লাগবেই, সেই শক্তি শরীর পায় যকৃৎ থেকে, যকৃতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন রক্তে চলে আসে গ্লুকোজ হয়ে, এই গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করে উৎপন্ন করে পর্যাপ্ত শক্তি। মাংসপেশি তখন পর্যাপ্ত শক্তি পেয়ে চাঙা করে তোলে পুরো শরীরকে।
এই তো গেলো শরীর চাঙা হবার ব্যাখ্যা, এবার বলা যাজ কফি খেলে অর্থাৎ শরীরে ক্যাফেইন প্রবেশ করলে আমাদের যে ভালো লাগার একটি অনুভূতি তৈরি হয় সেটি কীভাবে হয়ে থাকে। ভালো লাগার এই অনুভূতিটি তৈরি করে ডোপামিন। নিউরনের ডোপামিন রিসেপ্টরে যখন ডোপামিন সংযুক্ত হয় তখনই আমাদের মনে ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। নিউরনে যখন অ্যাডিনোসিন এসে যুক্ত হয়, তখন ডোপামিন আর নিউরনে সংযুক্ত হতে পারে না। কিন্তু আমরা যখন কফি পান করি, ক্যাফেইন নিউরনে সংযুক্ত হবার সাথে সাথে ডোপামিনকেও সংযুক্ত হবার ব্যবস্তা করে দেয়। নিউরনে তখন ক্যাফেইনের পাশাপাশি ডোপামিনও যুক্ত হয়, যার কারণে আমাদের একটা ভালো লাগা অনুভূতি তৈরি হয়।
আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে যে, কফি কিংবা ক্যাফেইন আমাদের খুবই উপকারী বস্তু, কিন্তু এর সম্মিলিত ফলাফর কিন্তু অতোটাও সুখকর নয়। শুধু যে ক্যাফেইন তা-ই নয়, অতিরিক্ত কোনো জিনিসই আমাদের জন্যে কখনো সুখ বয়ে আনতে পারে না। নিয়মিত যদি আমরা ঘুম নিবারণ করতে কফি পান করি, শরীরের সার্কাডিয়ান চক্রটি তখন যাবে উল্টে, মস্তিষ্ক ধরে নেবে রাতে না ঘুমানোই স্বাভাবিক অবস্থা, রাতে তখন আর ঘুমের বেগ তৈরি করবে না মস্তিষ্ক। আর গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম না আসা, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করাটা আমাদের কাছে নিশ্চয়ই অপরিচিত নেই। পুরো পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত। এছাড়া নিয়মিত ক্যাফেইন সেবনে আমাদের আচরণেও আসে বিরাট পরিবর্তন।
বর্তমান বিশ্বে কফি আর সাধারণ পানীয় হিসেবে পরিচিত নেই, অনেকের কাছেই নেশাদ্রব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কফি না পেলে যেন ভালোই লাগে না। ক্যাফেইন হৃৎপিন্ডের গতিকে বৃদ্ধি করবার মাধ্যমে রক্তচাপ বৃদ্ধি করে দেয়। শরীরে যখন সবসময় অতিরিক্ত ক্যাফেইনের উপস্থিতি থাকবে, তখন মস্তিষ্ক সেটাকেই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে হৃৎপিন্ডের স্বাভাবিক গতিকে বদলে সবসময় অধিক মাত্রায় নিয়ে রাখবে, সেই সাথে রক্তচাপকেও সর্বদা বৃদ্ধি করে রাখবে। রক্তে ক্যাফেইন থাকুক বা না থাকুক, রক্তচাপ ঠিকই সবসময় অধিক থাকবে।
তাই কফি পান সহ জীবনের অতিরিক্ত সবকিছুই স্বাভাবিক মাত্রায় নামিয়ে আনুন। একটি সুস্বাস্থ্যকর খাবার যখন আপনি অতিরিক্ত পরিমাণে খাবেন, সেটিও আপনার বিশেষ উপকার করতে পারবে না। সবজি শরীরের জন্য খুবই উপকারী হিসেবেই জানি আমরা, তাই না? সেই সবজি খাবারেরও নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে, দৈনিক ৩৫ গ্রাম, কোনোদিন খাবারে সবজি থাকবে না, আবার কোনো কোনোদিন এক কেজি খেয়ে ফেলবেন, এমনটি চলবে না। মানবদেহও একটি যন্ত্র, সবকিছুই এতে থাকতে হয় পরিমিত রূপে। সুতরাং বেশিদিন বাঁচতে নয়, যতদিন বাঁচবেন ধুঁকে ধুঁকে যাতে বাঁচতে না হয়, সেই লক্ষ্যে এখুনি সাবধান হউন, জীবনের সবকিছু পরিমিত পর্যায়ে নিয়ে আসুন।
ফিচার ইমেজ: medium.com