জ্যোতির কিছুই ভালো লাগে না আজকাল। কেনই বা লাগবে? তার বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকে সারাক্ষণ। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনকে কটু কথা শুনিয়ে দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া! বাড়ির ভেতর এই মন খারাপের দিনে তার কোনো বন্ধু নেই। থাকবেই বা কিভাবে? এই শহরে নতুন এসেছে ওরা!
শহরটার নাম নড়াইল। ছোট্ট একটা জেলা শহর। ওদের বাড়ির কিছুদূর দিয়ে শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। ওর মন খারাপ হলে সেখানেই গিয়ে বসে থাকে আট বছরের জ্যোতি! আর এভাবে বসে থাকতে গিয়েই ও একজন বন্ধু জুটিয়ে ফেলল। একদিন আনমনে নদীর পাশে বসে ঘাসের ডগায় ফুটে থাকা ছোট্ট ফুলগুলো দেখছিল সে। এমন সময় পাশের ঝোপালো আমঝুম গাছের তলায় কিসের যেন শব্দ শোনা গেলো! একটু ভয়ও পেলো সে। এই সন্ধ্যের সময় ওখানে আবার কি? কিন্তু না! কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ওখান থেকে উকি দিলো একটি ছেলে!
ওর বয়সীই হবে। শ্যামলা রঙের, একটা হাফপ্যান্ট পরে আছে শুধু। ওকে সভয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি করে হাসল ছেলেটি। তারপর ওর দিকে হাত তুলে বলল, ভয় পেও না। আমার নাম মিন্টু! আমি তোমাকে চিনি। তুমি জ্যোতি না? জ্যোতি এতই অবাক হল যে বলার মতো নয়। এই শহরে আসার পর ওর সাথে স্কুলে যারা একসাথে পড়ে, তারা ছাড়া আর কারো সাথে পরিচয় হয়নি। আর এই অপরিচিত ছেলেটা ওর নাম পর্যন্ত জানে?
ছোট্ট ছেলেটা ওর পাশে এসে বসে। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। ওকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বল তো আমার পকেটে কি আছে? বলতে পারলে তোমাকে দিয়ে দেব!’ জ্যোতি ততক্ষণে বুঝে গেছে মিন্টুর পকেটে কি আছে! ও বলে, ‘নিশ্চয়ই আম আছে।’ মিন্টু হেসে ওঠে! ‘বাহ, তোমার তো ভারী বুদ্ধি!’
তারপর পকেট থেকে বের করে আনে একটি লাল টুকটুকে আম। জ্যোতি যে কী খুশি হয়, বলার মতো নয়। আজ স্কুল থেকে ফেরার সময়, মোড়ের ধারে আম বিক্রি করতে দেখেছিলো সে। ভেবেছিলো বাড়ি এসে বাবাকে বলবে। কিন্তু বাড়ি আসতেই দেখে, ওর মা-বাবা এমন হুলস্থূল বাঁধিয়েছে! আম তো শিকেয় উঠলো, ও কয়েকটা নাকেমুখে খেয়ে নিয়ে এখানে চলে এসেছে! ওর বা-মা বোধহয় এখনো ঝগড়া করছে! তবে আজকে ওর মন ভালো হয়ে গিয়েছে। মিন্টুর মতো একজন বন্ধু পেয়েছে।
সেই সমস্ত বিকেল ধরে কত গল্পই না করেছে দুজনে। খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছে ওরা দুজনে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত ওরা গল্প করেছে। তারপর জ্যোতি ফিরে এসেছে। মিন্টুকে বলেছিল, ওর বাড়ি পর্যন্ত আসতে। কিন্তু মিন্টু রাজি হয়নি। কিন্তু সে কথা দিয়েছে, আগামীকাল আবার আসবে।
এখন জ্যোতির স্কুলে মন বসে না। সারাক্ষণ ভাবে, কখন ক্লাস শেষ হবে? আর কখন মিন্টুর সাথে দেখা হবে। ওদিকে ওর মা-বাবার মধ্যকার ঝামেলা দিন দিন আরো বাড়ছে। অবশ্য জ্যোতি এখন আর ওসব ভ্রুক্ষেপ করে না। সে এখন বন্ধুর সাথে মেতে থাকে। কিন্তু এমন সৌভাগ্য জ্যোতির কপালে বেশিদিন সইলো না। কয়েকদিনের মধ্যে তার বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেলো। ও কোথায় থাকবে সেটা নিয়ে কেস পর্যন্ত হল। শেষমেশ ও মায়ের সাথে থাকার রায় পেলো। যেদিন ওরা বাড়ি ছেড়ে যাবে, তার আগের দিন আবার নদীর ধারে এলো সে। গিয়ে দেখে মিন্টু আগে থেকেই বসে আছে। ও পাশে বসতেই মিন্টু মুখ খুলল, ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছ, না?’
‘তুমি কিভাবে জানলে?’ অবাক হল জ্যোতি।
‘আমি সবকিছুই জানি।’ রহস্যের হাসি হেসে জবাব দিলো মিন্টু।
‘তোমার মন খারাপ হচ্ছে না আমি চলে যাচ্ছি বলে?’
‘উহু, মন খারাপ হবে কেন? তুমি যেখানে যাবে, আমিও সেখানেই যাবো।’
জ্যোতি বুঝল মিন্টু ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলছে এসব কথা। কয়েকদিন পরে জ্যোতি ওর মায়ের সাথে খুলনা শহরে চলে এলো। সেখানে ওর মা এক অফিসে চাকরি নিলেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ। ও স্কুল থেকে ফিরে বাসায় এসে একা একা কী করবে ভেবে পায় না! অবশ্য বাড়ির কাজ করে দেওয়ার জন্য একজন বুয়া রেখে দেওয়া আছে। কিন্তু তার সাথে তো আর গল্প করা যায় না! ওর সারাক্ষণ মন খারাপ হয়ে থাকে। মিন্টুকে খুব মনে পড়ে তার। মিন্টু বলেছিল, ও যেখানে যাবে, সেখানেই সে হাজির হবে। মিথ্যুক একটা।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে মিন্টু! ও একই সাথে এত অবাক হল আর এত খুশি হল যে, কী করবে বুঝতে পারলো না। এই ফাকে মিন্টু ওর দিকে এগিয়ে এলো। ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল, ‘কি রে বলেছিলাম না, তুই যেখানে যাবি আমিও সেখানেই যাব! হুহ?’
জ্যোতি কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু তুই জানলি কিভাবে, আমি এখানে থাকি!’
মিন্টু তার সেই বিখ্যাত রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ‘আমি সব জানি।’
দুই বন্ধু মিলে আবার মজায় দিন কাটানো শুরু হল। স্কুল শেষ হলেই মিন্টু ওর সাথে ওদের বাড়ি আসে। তারপর সোজা ওর ঘরে চলে যায়। সেখানে যত রাজ্যের খেলনা আছে ওর! মা কিনে দিয়েছেন তাকে। সেগুলো নিয়ে দুই বন্ধু খেলে, হই-হুল্লোড় করে, মজা করে! তবে মিন্টু কিন্তু শুক্রবার কখনো আসে না। সেদিন অবশ্য ওর মা বাড়ি থাকে, তিনি সময় দেন জ্যোতিকে। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে মিন্টু ঠিকই হাজির হয়ে যায়।
ইদানীং কাজের বুয়া তার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। কেমন একটা ভয় পাওয়া দৃষ্টি। ও ছোট মানুষ, তবু বুঝতে পারে অনেক কিছু। একদিন কাজের বুয়া তাকে জিজ্ঞেস ও করেছিলো, ‘মা তুমি সারাক্ষণ কার সাথে কথা বল দরজা বন্ধ কইরা?’ ও অবাক হয়ে উত্তর করেছিলো, ‘কেন? আমার বন্ধুর সাথে!’
তারপর থেকে কাজের বুয়া ওর থেকে কেমন যেন দূরে দূরে থাকে। কয়েকদিন পরে কাজের বুয়া জ্যোতির মার কাছে নালিশ করলো, ‘আমি আর আপনার বাসায় থাকুম না।’ জ্যোতির মা নিলয় মিত্র অবাক হলেন, ‘কেন? বেতন কম হয়ে যাচ্ছে?’
‘না না! তা না। কিন্তু আপনার বাসায় ভূত আছে! জ্যোতি মা সারাক্ষণ কার সাথে জানি কথা বলে!’
নিলয় মিত্র হেসে উড়িয়ে দিলেন, ‘আরে ও তো ছোট মানুষ! তাই মনে হয় আপন মনে কথা বলে।’
কিন্তু বুয়া কিছুতেই সে কথা শুনবে না। শেষমেশ নিলয় মিত্র সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজে দেখবেন বিষয়টি কি? সেই কথা মতো একদিন অর্ধদিবস অফিস করে বাসায় চলে এলেন। তারপর জ্যোতির কক্ষের দিকে যেতেই একটা ধাক্কা মতো খেলেন। জ্যোতি কথা বলছে কারো সাথে! ফোনে যেভাবে কথা হয়, ঠিক সেভাবে! তবে খুব স্বাভাবিক গলায় সে কথা হচ্ছে। যেন মুখোমুখি বসে কারো সাথে কথা বলছে। মাঝে মাঝে হাসিতে ফেটে পড়ছে সে। নিলয় মিত্র ঘেমে উঠলেন, কী হচ্ছে এসব? তিনি দরজায় নক করলেন।
ভেতর থেকে জ্যোতি দরজা খুলে দিলো। মাকে দেখে স্পষ্টত অবাক হয়েছে সে। নিলয় মিত্র অজুহাত দিলেন, ‘ইয়ে মা, আজকে অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। চলো আজ আমরা ঘুরে আসি বাইরে থেকে।’
‘কিন্তু আমি যে এখন ব্যস্ত! দেখছ না, খেলা করছি মিন্টুর সাথে। ……ওহহো, তুমি তো মিন্টুকে চেনোই না। ওই হল মিন্টু-‘ বলে বিছানার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল জ্যোতি। নিলয় মিত্র আতংকিত হয়ে শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জ্যোতির কোন বন্ধুকেই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। কাজের বুয়াও কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না শূন্য বিছানার উপরে।
জ্যোতিকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের বা সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। নিলয় মিত্রকে চেম্বারের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে জ্যোতির সাথে একা একা কথা বললেন তিনি। তারপর নিলয় মিত্রের সাথে কথা বললেন তিনি। সবশেষে মন্তব্য করলেন, জ্যোতি এক ধরনের মনোবৈকল্যে ভুগছে। সে ইমাজিনারি ফ্রেন্ড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।
ইমাজিনারি ফ্রেন্ড ডিজঅর্ডার একটি একটি মনোজাগতিক ঘটনা, যেখানে একজন মানুষ এমন কারো সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে যার আসলে বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। তবে একথা শুধু মাত্র অন্যদের কাছে সত্য। যে এই ধরনের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, তার কাছে তার বন্ধু অতি বাস্তব একজন মানুষ। এই ধরনের কাল্পনিক বন্ধু সাধারণত বাচ্চাদের ভেতরে বেশি দেখায় যায়। এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে এটা ঘটতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে এমন ঘটনা বিরল হলেও একেবারে শূন্য নয়। কাল্পনিক বন্ধু মানে যে শুধু মানুষ হতে হবে তেমন কোন কথা নেই। অনেক সময় দিদিমার মুখে শোনা রূপকথার কোন দয়ালু দৈত্য কাল্পনিক বন্ধু হয়ে আসতে পারে।
আমরা যেমন আমাদের সবথেকে কাছের বন্ধুকে চোখের সামনে দেখি, তেমনি তারাও তাদের ‘কাল্পনিক বন্ধু’-কে, যে কিনা তাদের কাছে বাস্তব, ঠিক তেমনি ভাবে দেখতে পায়। কেউ কেউ অবশ্য শুধু তাদের অস্তিত্বটি অনুভব করতে পারে। এই কাল্পনিক বন্ধুরা যে মানব সমাজে কতদিন ধরে আছে, তার ঠিকঠাক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ১৮৯০ সালে এমন কিছু নথি পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া প্রাচীন বা মধ্যযুগে মানুষ যে আধ্যাত্মিক শক্তিকে অনুভব করতো কিংবা দেবদূতকে দেখতো, বিজ্ঞানী ক্লসেন এবং প্যাসম্যান এর মতে তারা ছিলো এই কাল্পনিক বন্ধুর নমুনা।
সাধারণত ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ভেতরে ‘কাল্পনিক বন্ধু’র উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিভিন্ন কারণে একজন মানুষ মনের অজান্তে একজন কাল্পনিক বন্ধু সৃজন করে নেয়। সাধারণত যারা একাকীত্বে ভোগে, বিষণ্ণতায় সময় কাটে- এমন শিশুরাই এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে। কাল্পনিক বন্ধু থাকা যে সবসময় খুব খারাপ কিছু, তা কিন্তু নয়।
গবেষকদের ধারণা, যাদের কাল্পনিক বন্ধু আছে, তাদের ভাষাগত দক্ষতা অন্যদের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে! তবে একই সাথে এটা তাদের মানসিক চাপ বা একাকীত্বের সাথেও সম্পর্কিত। পাশ্চাত্য একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, বিরক্তিকর এবং একাকীত্বের মুহূর্তে কাল্পনিক বন্ধুরা তাদের কাছে এক পশলা গ্রীষ্মের বৃষ্টির মত। এমন কী অনেক সময় তারা একাডেমিক পড়াশোনার সময়ে মেন্টর হিসেবে কাজ করে।
কাল্পনিক বন্ধুরা তাদের উৎসাহ প্রদান করে, আত্মবিশ্বাস প্রদান করেন। সাফল্য লাভ করলে বাহবা প্রদানও করে থাকে এই কাল্পনিক বন্ধুরা। আমরা যখন একাকী থাকি, আমরা নিজেরাও এক সময় ক্ষণিকের জন্য কল্পনার জগতে হারিয়ে যাই। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে।
অনেকের হয়তো বা কল্পনায় ফেলু মিত্তিরের সাথে বন্ধুত্ব আছে, অনেকে হয়তো মাসুদ রানার সাথে ঘুরতে গেছে দুঃসাহসী মিশনে কিংবা কেউ বা কিশোর পাশার সাথে রকি বিচে ছুটে বেড়িয়েছেন। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য এই যে, আমরা বুঝতে পারি এই জগতটি কাল্পনিক। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য। তাদের কাছে কল্পনার জগতটিও বাস্তব- আপনার আমার মতনই।
Feature Image: sicknotweak.com