কথায় আছে, “ছোট বলে কোনোকিছুকে অবহেলা করতে নেই।” ক্ষুদ্র কিছুও ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। যাকে চোখে দেখা যায় না, মাইক্রোস্কোপে চোখ ছোট করে তাকিয়ে থেকে যার উপস্থিতি ও অস্তিত্ব সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে হয়, এমন পরজীবী মোটেও অবহেলা করার মতো নয়। বিশ্বের ট্রপিক্যাল এবং সাব-ট্রপিক্যাল অঞ্চলে এমন এক পরজীবীর বসবাস, যা মানুষখেকোর পরিচিতি পেয়েছে। ক্ষুদ্র এই পরজীবী কি তবে প্রকৃতপক্ষেই একজন মানুষকে তার শিকার বানিয়ে ফেলতে পারে? আসুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
প্রথমেই বলি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনাতে অবস্থিত প্রেসকটে বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত দমকলকর্মী মার্ক ওয়ার্ডের কথা। বেশ কিছুদিন যাবত তিনি তার পুরো শরীর জুড়ে বিন্দুর ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ দেখতে পান। নেহায়েত কোনো ক্ষুদ্র পতঙ্গের কামড় ভেবে তিনি বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেননি প্রথমে। দুর্ভাগ্যবশত কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই বিন্দুর ন্যায় দাগগুলো বড় ক্ষতে পরিণত হয় এবং তিনি খুব দ্রুত ওজন হারাতে থাকেন এবং সবসময় ক্লান্ত অনুভব করতে শুরু করেন। তার স্ত্রী জ্যানিনা তাকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য বারবার বললেও মার্ক বিষয়টাকে খুব একটি পাত্তা দেননি।
একদিন মার্ক তার গাড়ি মেরামতের জন্য কাজে হাত দিলে তিনি খুব আশ্চর্য হন যে তিনি কোনোভাবেই হাত বাঁকা করতে পারছিলেন না এবং কোনোকিছু ধরাটা তার জন্য বেশ যন্ত্রণাদায়ক। মার্কের ভাষায় তার অনুভূতিটা অনেকটা এরকম ছিল, “আমার মনে হচ্ছিল যে কিছু একটা আমাকে প্রতিনিয়ত কামড় দিচ্ছে এবং হাতের চামড়াগুলো খেয়ে ফেলছে।”
মার্ক এবং তার স্ত্রী আর দেরি না করে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং তাদের কাছে সমস্যাটি ব্যাখ্যা করলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা কোনো আশানুরূপ চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা অ্যারিজোনাতে জনৈক চিকিৎসকের কাছে গেলে সপ্তাহখানেক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর সুনিশ্চিত হতে পারেন যে এটি মোটেও কোনো চর্মরোগ জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি নয়। মার্ক একধরনের মাংসখেকো পরজীবীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, যার নাম লিসম্যানিয়া এবং সংক্রমণটির নাম কিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস। এ ধরনের সংক্রমণের ফলে পরজীবী মানুষের শরীরের চামড়া খেয়ে ফেলে এবং সেখানে বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি করে থাকে। খুব দ্রুত এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা নেয়া না হলে, তা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে মার্ক ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আরেকটি ঘটনার কথা বলা যাক। দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসরত অ্যাডাম স্পেনসার ঠিক একই পরজীবীর সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, তবে তার ক্ষতের জায়গাগুলো ছিল মুখমন্ডল ও ঘাড়ের পেছন দিকটা। ২৩ বছর বয়সী এই যুবক সদ্য তার প্রেয়সীকে তার জীবনসঙ্গিনী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নতুন জীবন শুরুর স্বপ্নে বিভোর থাকাকালীন একদিন তিনি লক্ষ্য করেন যে তার মুখমন্ডলে অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে। মার্কের মতো তিনিও ব্যাপারটিকে অতটা পাত্তা দেননি শুরুর দিকে। কিন্তু যতদিন যায়, তার ক্ষতের স্থান প্রসারিত হতে থাকে এবং তা থেকে পুঁজ নির্গত হতে শুরু করে। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন শুরু করেন এবং এর পাশাপাশি তিনি স্প্রিংফিল্ডের থার্সটন মেডিকেল ক্লিনিকে কর্মরত ড. স্টিফেন অ্যামিসের সাথেও এ বিষয়ে আলাপ করেন।
ড. স্টিফেন অ্যামিসের মতে, “অ্যাডাম যখন আমার কাছে আসে, তখন তার মুখমন্ডলের ডান দিকটায় বেশ ক্ষত ছিল এবং তা বাইরে থেকে শক্ত বলে মনে হলেও ভেতর থেকে নরম ও পুঁজে ভরা ছিল। আমি ভেবেছিলাম এটা স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার কোনো সংক্রমণ এবং তাকে আমি পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করি।” কিন্তু এই চিকিৎসায় তার অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটছিল না, বরং তা বিস্তৃতি লাভ করতে করতে প্রায় চোখের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, যা অ্যাডামের জন্য বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে চলেছিল।
চিকিৎসক পরিবর্তন করে অ্যাডাম করভালিসে অবস্থিত সামারিটান ইনফেকশাস ডিজিস ক্লিনিকের ড. উইলিয়াম মুথের সাথে দেখা করেন এবং বিস্তারিত জানান। এই কয়দিনের মাঝেই সংক্রমণ তার ঘাড় অবধি পৌঁছে গেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় তিনি আসলে লিসম্যানিয়া নামক একধরনের পরজীবীর সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। অ্যাডামের এ ধরনের সংক্রমণকে বলা হয়ে থাকে মিউকোকিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস। এ ধরনের সংক্রমণে মানুষের নাক, মুখমন্ডল ও গলায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে থাকে। ২১ দিনের একটি ধারাবাহিক চিকিৎসার পরে অ্যাডাম সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এবার আসুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক এই ভয়াবহ মানুষখেকো পরজীবী প্রাণী সম্পর্কে- কে এই পরজীবীর বাহক, কীভাবে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, আক্রান্ত হওয়ার ফলে কী কী ঘটতে পারে, আক্রমণের ভয়াবহতা এবং এর সম্ভাব্য চিকিৎসাব্যবস্থা কী হতে পারে।
লিসম্যানিয়া
প্রোটোজোয়া পর্বের এই পরজীবীর বাহক একধরনের মাছি, যা বেলেমাছি নামে পরিচিত। সংক্রমিত বেলেমাছির কামড়ে যে কেউ খুব সহজেই এই মানুষখেকো পরজীবীর আক্রমণের শিকার হতে পারে। আর এই সংক্রমণের নাম লিসম্যানিয়াসিস। গ্রীষ্মপ্রধান ও অপেক্ষাকৃত কম গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে এই বাহক মশা প্রায়শই দেখা যায়।
এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এই সংক্রমণের প্রকোপ বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই রোগগুলো অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী এবং অনুন্নত এলাকায় বেশি ঘটে। যার ফলে সঠিক চিকিৎসা বা সঠিকসময়ে ঔষধ হাতে না পৌঁছানোর ফলে অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তিই মারা যান।
লিসম্যানিয়াসিসের প্রকারভেদ
বলা হয়ে থাকে লিসম্যানিয়া পরজীবীর প্রায় ২০টি প্রজাতি এ ধরনের ক্ষত ও সংক্রমণের জন্য দায়ী এবং ক্ষতের ধরন অনুযায়ী লিসম্যানিয়াসিসকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
১. কিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস
শরীরের চামড়ায় একধরনের ক্ষত তৈরি হয়ে থাকে। কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর সেখানেই এই পরজীবী বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং কোষগুলোকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে।
একপর্যায়ে তা কোষের অভ্যন্তর থেকে শরীরের বহির্ভাগের চামড়াগুলোকেও খেয়ে ফেলে। ক্ষতের উপর নির্ভর করে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। ক্ষত খুব সামান্য হলে অনেকসময় চিকিৎসা ছাড়াই তা ভালো হয়ে যায়।
২. মিউকোকিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস
কিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস সেরে যাওয়ার বেশ কয়েক মাস পর অনেক সময় পুনরায় তা ক্ষতের সৃষ্টি করে থাকে, যদিও তার হার খুব কম।
এক্ষেত্রে নাক, গলা ও মুখমণ্ডল এই পরজীবীর সংক্রমণের শিকার হয়ে থাকে এবং উক্ত জায়গাগুলোতে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে মিউকাস মেমব্রেন নষ্ট হয়ে যায়। চিকিৎসা ছাড়া মিউকোকিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস ভালো হয় না কখনো।
৩. ভিসেরাল লিসম্যানিয়াসিস
আমরা অনেকে একে কালাজ্বর বলে থাকি। বেলেমাছির কামড়ের প্রায় ২-৮ মাস পর এর প্রকোপ দেখা দেয় এবং এই ধরনের সংক্রমণে মানুষের প্লীহা ও যকৃৎ নষ্ট হয়ে যায়।
অনেকসময় অস্থিমজ্জাতেও সংক্রমণ ঘটে থাকে। যদি সময়মতো চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
যেসব অঞ্চলে লিসম্যানিয়াসিসের প্রকোপ অপেক্ষাকৃত বেশি
অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব জায়গাতেই এই পরজীবী এবং পরজীবীর সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট রোগের উপস্থিতি রয়েছে। ২০১৫ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী শতকরা ৯০ ভাগ প্রকোপের উপস্থিতি রয়েছে নিম্নোক্ত অঞ্চলে-
- ব্রাজিল
- ইথিওপিয়া
- ভারত
- কেনিয়া
- সোমালিয়া
- দক্ষিণ সুদান
যদি আপনি কখনো এসব অঞ্চলে ভ্রমণে যান, তাহলে অনুরোধ থাকবে অনুগ্রহপূর্বক একটু বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করবেন, যাতে করে এই পরজীবী আপনার উপরও হামলা না করে বসে।
চিকিৎসা
সংক্রমণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে এ রোগে অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ঔষধ হিসেবে অ্যাম্ফোটারিসিন বি গ্রুপের ঔষধ বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
১. কিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস
এই রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে থাকে। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে দ্রুত ক্ষতপূরণ সম্ভব এবং অন্যান্য অঙ্গে সংক্রমণের আশংকা কমে যায়। যেসব জায়গায় ক্ষতের পরিমাণ কিছুটা বেশি, প্রয়োজনবোধে সেসব জায়গায় হয়ত প্লাস্টিক সার্জারি করতে হতে পারে।
২. মিউকোকিউটেনিয়াস লিসম্যানিয়াসিস
এই রোগ কখনোই আপনা আপনি ভালো হয়ে যায় না। চিকিৎসার জন্য লিপোসোমাল অ্যাম্ফোটারিসিন বি এবং প্যারোমোমাইসিন গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৩. ভিসেরাল লিসম্যানিয়াসিস
ভিসেরাল লিসম্যানিয়াসিস রোগ নিরাময়ের জন্য বেশ কিছু ঔষধ প্রদান করা হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে অ্যাম্ফোটারিসিন বি, প্যারোমোমাইসিন, স্টিবগ্লুকোনেট ও মিলটেফোসিন গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্রতিরোধ
লিসম্যানিয়ার বাহক বেলেমাছির কামড় থেকে সুরক্ষার জন্য আমরা কিছু কিছু পদক্ষেপ মেনে চলতে পারি। যেমন-
১. এমন কাপড় পরিধান করা, যা শরীরের বেশিরভাগ জায়গাকে আবৃত করে রাখবে।
২. কীটপতঙ্গের কামড় থেকে বাঁচার জন্য বাজারে বেশ কিছু লোশন বা অয়েনমেন্ট পাওয়া যায়, যা আমরা আমাদের শরীরের অনাবৃত স্থানে ব্যবহার করতে পারি।
৩. ঘুমাবার ঘরে বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ব্যবহার করা এবং মশারি ব্যবহার করা।
৪. খুব ভোরে এবং সন্ধ্যায় ঘরের বাইরে না যাওয়া, কারণ এই সময়গুলোতে বেলেমাছি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে।
ফিচার ইমেজ: rh.gatech.edu