রিডক সিন্ড্রোম: অদ্ভুত এক অন্ধতার গল্প

জানলা দিয়ে সকালের ঝলমলে রোদ আছড়ে পড়ছে বারান্দায়। মিসেস মিলেনা ক্যানিং তার প্রিয় চেয়ারটায় বসে কফি খেতে খেতে দেখলেন সামনের মেঝেতে একটা চকচকে মুদ্রা পড়ে আছে। তিনি উঠে সেটি তুলে আনতে গেলেন, কিন্তু ফিরে আসলেন খালি হাতে! কারণ, সেখানো কোনো মুদ্রাই ছিল না। তিনি এক ফালি রোদকে চকচকে মুদ্রা ভেবে ভুল করেছিলেন।

গরম কফির ধোয়া দেখতে পেলেও কাপটি দেখতে পান না তিনি; Image Source: Pinterest

আমাদের স্বাভাবিক জীবনে হয়তো এই ঘটনাটি অস্বাভাবিক লাগবে, কিন্তু মিসেস ক্যানিংয়ের অন্ধকার হয়ে যাওয়া জগতে এটা স্বাভাবিক একটি ঘটনা। কারণ, মিসেস ক্যানিং এমন একটি বিরল অন্ধতায় আক্রান্ত যা অন্য সব অন্ধত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার এই অন্ধতার বৈশিষ্ট্য হলো তিনি নড়াচড়া করছে এমন কিছু ছাড়া অন্য আর কোনো কিছুই দেখতে পান না! গরম কফি কাপ থেকে উঠা ধোয়া তিনি দেখতে পান, কিন্তু স্থির কফির কাপটি তিনি দেখতে পান না। কিংবা, যখন তার মেয়ে তার সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তিনি তার মেয়ের দুলতে থাকা সুন্দর চুলের বেনী দেখতে পান, কিন্তু তার মেয়ের চেহারা তিনি দেখতে পান না। তিনি তার মেয়ের সম্পর্কে বলেন,

“সে আমার পাশে বসে থাকলে আমি তাকে তার চোখের পলক ফেলতে বলি। সে তা করা শুরু করলেই আমি তার চোখ দেখতে পাই। সে কথা বললে আমি তার ঠোট নড়তে দেখতে পাই। আমি জানি তার থুতনি কিংবা নাক কোথায়, কিন্তু আমি সেগুলো দেখতে পাই না। আমি তার পুরো চেহারাটা দেখতে পাইনা।”

মিসেস ক্যানিং অদ্ভুত এক অন্ধতায় আক্রান্ত, যার নাম হলো ‘রিডক সিন্ড্রোম‘। এই অন্ধতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নড়াচড়া করছে এমন কিছু ছাড়া আর কোনো কিছুই দেখতে পান না। তাই যখন মিসেস ক্যানিংয়ের স্বামী তার সাথে একই রুমে বসে থাকেন, তিনি তাকে তার হাত নাড়াতে বলেন। তার স্বামী হাত নাড়লে তিনি তার স্বামীর হাতটি দেখতে পান, কিন্তু চেয়ারে বসে থাকা তার স্বামীকে তিনি দেখতে পান না।

মিসেস ক্যানিং ও তার মস্তিষ্কের ছবি; Image Source: irishnews.com

৪৮ বছর বয়সী মিলেনা ক্যানিং থাকেন স্কটল্যান্ডে। জন্মগতভাবে তিনি অন্ধ নন। প্রায় ১৮ বছর আগে ১৯৯৯ সালে তার শ্বাসযন্ত্রে একটি ইনফেকশন হয়। এটি এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করে যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এ সময় ৮ মাসের এক দীর্ঘ কোমায় চলে যান তিনি। ৮ মাসের এই দীর্ঘ সময়কালে কয়েকবার স্ট্রোক হয় তার। এরপর কোমা থেকে জেগে উঠে তিনি বুঝতে পারেন তিনি তার দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।

“জেগে ওঠার সাথে সাথেই আমি প্রথমে চিৎকার করে আমার মাকে এবং এরপর আমার স্বামীকে ডেকেছিলাম। আমি তাদের বলছিলাম আমি দেখতে পাচ্ছি না।”

মিসেস ক্যানিংয়ের জন্য এটি ছিল ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু কয়েক মাস পরে তিনি বাসায় ফিরে এসে একধরনের পরিবর্তন লক্ষ করেন। তার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে কেউ তার জন্য চকচকে মোড়কে মোড়ানো একটা উপহার নিয়ে এসেছিলেন। উপহারটি নিচে রাখতে গেলেই ক্যানিং উপহারের চকচকে মোড়কটির দেখতে পান। উপস্থিত সবাই এটাকে তার কল্পনা মনে করলেও তিনি ঠিকই বুঝতে পারেন কিছু একটা ঘটেছে।

অন্যকিছু দেখতে না পেলেও চকমকে মোড়কের উপহারটি দেখতে পেয়েছিলেন তিনি; Image Source: spriteofsharing.com 

এরপর তিনি তার পরিচিত চোখের ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার তার চোখ পরীক্ষা করে জানান, তার চোখ স্বাভাবিক রয়েছে। তার চোখে কোনো সমস্যা নেই। ক্যানিং তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বললেও ডাক্তার ক্যানিংয়ের কথা বিশ্বাস করেননি।

অবশেষে তিনি চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ গর্ডন ডাটনের কাছে আসেন। গর্ডন এমন কিছু অন্ধ মানুষের কথা শুনেছিলেন যারা কেবলমাত্র গতিশীল বস্তু দেখতে পায়। কিন্তু কী কারণে এমনটা হচ্ছে সেটি ডাক্তার ডটনের কাছে তখনো রহস্যময় ছিল। ফলে তিনি লন্ডনের ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মস্তিষ্ক ও মনোরোগ বিভাগে যাওয়ার পরামর্শ দেন ক্যানিংকে।

নিউরোসাইকোলজিস্ট জডি কুলহাম; Image Source: eurekalart.org

সেখানে নিউরোসাইকোলজিস্ট জডি কুলহাম ও এক দল গবেষক ক্যানিংয়ের মস্তিষ্কের অনেকগুলো পরীক্ষা ও একটি সম্পূর্ণ fMRI স্ক্যান করেন। এসব পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে গবেষকরা Neuropsychologia নামের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তারা জানান, ক্যানিং রিডক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। এটি Statokinetic dissociation নামেও পরিচিত, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি গতিশীল বস্তু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।

মস্তিষ্কের যে অংশটি আমাদের দর্শনকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশে অর্থাৎ অপটিক্যাল লোবে ক্ষতের ফলেই এমন ঘটনা ঘটে। ‘অ্যাকিন্টপসিয়া’ নামে এর ঠিক বিপরীত একটি অবস্থা রয়েছে যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি শুধু স্থির বস্তু দেখতে পায়, কোনো গতিশীল বস্তু দেখতে পায় না। 

মস্তিষ্কের অপটিক লোব; Image Source: medicalnewstoday.com

নিউরোসাইকোলজিস্ট জডি কুলহাম জানান,

“ফাংশনাল MRI এর মাধম্যে আমরা ক্যানিংয়ের মস্তিষ্কের যে অংশটি তার দৃষ্টিশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে যেখানে বিশাল কিছু ছিদ্র দেখতে পেয়েছি। তার একটি তো আবার টেনিস বলের সমান বড়! তবে এসবের পরেও সেখানে কিছু পেশী রয়ে গেছে যেগুলো গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে সাড়া দেয়।”

মূলত, কয়েকটি স্ট্রোকের ফলে ক্যানিংয়ের ব্রেনের যে অংশটি কোনো কিছু দেখতে সাহায্য করে সেটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেখানে এখনো কিছু অক্ষত অংশ রয়ে গেছে যা গতিশীল কোনো কিছু শনাক্ত করতে পারে। ফলে সময়ের সাথে সাথে তার মস্তিষ্ক সেই অক্ষত অংশগুলো দিয়েই কিছুটা দেখতে শিখে গেছে। কুলহাম বলেন,

“ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রে দর্শনের তথ্য মস্তিকে পৌঁছে দেয়ার বড় রাস্তাগুলোই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে কিছু ছোট রাস্তা রয়ে গেছে এবং এগুলো আগের থেকে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।” তাই এখনো কোনো একটি রুমে যাওয়া কিংবা কোনো কিছু ধরার মতো ক্ষমতা ক্যানিংয়ের রয়েছে।

উপরে ডাক্টার জডি ও নিচে মিলেনা ক্যানিংয়ের মস্তিষ্কের ছবি; Image Source: nationalpostcom.com

ডাক্তার কুলহামের মতে, মস্তিষ্কের এমন ঘটনা আসলে বিরল। খুব কম মানুষের এমন রিডক সিন্ড্রোম রয়েছে এবং তাদের নিয়ে এত বিশদভাবে গবেষণাও এর আগে কখনো করা সম্ভব হয়নি। তাই ক্যানিংয়ের এই ঘটনাটির মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে দৃষ্টি সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে ও কোনো আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার সাথে কিভাবে মানিয়ে নেয় তা সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেলো। কুলহাম বলেন,

“এই গবেষণটিই হয়তো এখনো পর্যন্ত একজন একক রোগীর দর্শন ইন্দ্রিয়ের উপর করা সবচেয়ে তথ্যবহুল কাজ। তিনি তার গতি শনাক্তকরণ ক্ষমতার মাধ্যমে খুব চমৎকারভাবে তার দৃষ্টিশক্তির উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। কত কী যে ঘটা সম্ভব মিলেনার মতো রোগীরা আমাদের সেটা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এর মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিশক্তি ও কোনো কিছু শেখার ক্ষমতা কিভাবে একত্রে কাজ করে তা বোঝা গেলো”

ক্যানিংয়ের এই দৃষ্টিক্ষমতা দিন দিন আরো উন্নত হচ্ছে। এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান, ভালোভাবে তাকিয়ে থাকলে এখন তিনি তার কফি কাপ কিংবা টিভির রিমোট কন্ট্রোলের আকৃতি দেখতে পান।

তিনি আশা করছেন, ভবিষ্যতে তার দৃষ্টিশক্তির আরো উন্নতি ঘটবে। তবে আর যা-ই হোক, তিনি তার এই চোখের সমস্যার কারণ জানতে পারে খুব খুশি। এজন্য তিনি কানাডার সেই গবেষকদের ধন্যবাদ জানান যাদের জন্য তিনি তার প্রকৃত সমস্যাটি জানতে পেরেছেন।

ফিচার ইমেজ – Youtube

Related Articles

Exit mobile version