কোনো সংক্রামক রোগ যখন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পড়ে তখন বলা চলে সেই রোগটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য মহামারীর ঘটনা ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। এসব মহামারীতে প্লেগ আর ফ্লুর নামই বেশি শোনা যায়। নানা কারণে একটি ছোট অঞ্চলে প্রাদুর্ভাব ঘটা রোগ ছড়িয়ে যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ইতিহাসে এরূপ অর্ধশতাধিক মহামারীর লিখিত তথ্য আমরা পাই। সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে বিধ্বংসী ৯টি মহামারী নিয়ে আমাদের আজকের লেখা।
দ্য ব্ল্যাক ডেথ
পৃথিবীর ইতিহাসে কিংবা একটু ছোট পরিসরে বললে ইউরোপের ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথের মতো আলোচিত মহামারী আর নেই। এরকম ভয়ানক, সর্বগ্রাসী রোগের প্রাদুর্ভাব সম্ভবত পৃথিবী সেই একবারই দেখেছিল ১৪ শতকে। কৃষ্ণ সাগরের (ব্ল্যাক সি) উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল বিধায় একে ব্ল্যাক ডেথ বলা হয়। সেসময় ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্য হতো এই কৃষ্ণ সাগর দিয়েই। আর এখান থেকে খাদ্যদ্রব্যের জাহাজগুলোতে চড়ে বসতো অসংখ্য ইঁদুর, যেগুলো কি না রোগের প্রধান জীবাণুবাহী।
ব্ল্যাক ডেথের সময় মানুষ কোন রোগটিতে মানুষ অধিক হারে মৃত্যুবরণ করেছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদগণ দ্বিধাবিভক্ত। এক অংশের মতে, রোগটি ছিল একপ্রকার গ্রন্থিপ্রদাহজনিত প্লেগ। অন্য অংশের দাবি এই ভয়ানক মহামারী ঘটেছিল ইবোলা ভাইরাসের কারণে।
১৩৪৭-৫১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালই ছিল ব্ল্যাক ডেথের সবচেয়ে বিধ্বংসী সময়। এ সময় ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণবায়ু কেড়ে নেয় এই মহামারী। তবে এই অভিশপ্ত মহামারীর প্রভাব টিকে ছিল অন্তত ২০০ বছর। ইতিহাসবিদগণের মতে, এ ২০০ বছরে অন্তত ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন! এটি এমনই এক মহামারী ছিল যে, এর কারণে সমগ্র ইউরোপের অর্থনৈতিক সার্বিক জীবন কাঠামোই বদলে যায়, প্রভাবিত হয় শিল্প সাহিত্যও। ব্ল্যাক ডেথের রেখে যাওয়া গভীর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় পরবর্তী বেশ কয়েক প্রজন্মের।
দ্য প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী সম্রাট জাস্টিনিয়ান রোমান সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব অভিযান চালিয়েছিলেন, সেগুলোর জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু সেসব অভিযান ছাপিয়ে তার নাম অধিকবার উচ্চারিত হয় তার শাসনামলে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ মহামারীর কারণে। ৫৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিশরে এক ভয়ানক প্লেগের উৎপত্তি ঘটে।
আর এবারো এই রোগ বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে ইঁদুর। তৎকালীন পৃথিবীতে মিশরই ছিল সমগ্র ভূমধ্যসাগরী অঞ্চলের খাদ্য শস্যের যোগান। ফলে এখানে সৃষ্ট রোগ সহজেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে যায়। রোগের প্রথম আক্রমণটা ছিল বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল)। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, মহামারীর চূড়ান্ত পর্যায়ে সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার মানুষ মারা যেত!
প্রায় ৫০ বছর যাবত টিকে থাকা এই মহামারী আড়াই কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। তবে কিছু কিছু উৎসে সংখ্যাটা ১০ কোটিতেও ঠেকেছে। প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক এই মহামারীই ইউরোপে ‘ডার্ক এজ’ এর সূচনা করেছিল।
দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক
নানা কারণে আলোচিত বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ছিল আক্ষরিক অর্থে হত্যা আর প্রাণহানীতে পূর্ণ। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে, রক্তস্রোত দেখতে দেখতে ক্লান্ত বিশ্ববাসী যখন পরিত্রাণের আশায় মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে, তখন তাদের নীরবে শুরু হয়ে গিয়েছিল আরেক মৃত্যুর মিছিল। এ মিছিলটি ‘দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক’ নামে পরিচিত। বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তেই এর সূচনা হলেও মহামারী আকারে বিস্তার ঘটে ১৯১৯ সালেই। অল্প সময়ের মাঝেই সমগ্র বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে ইনফ্লুয়েঞ্জায়, মৃত্যুর মিছিলে যোগ হতে থাকে নতুন নতুন নাম।
৪ বছরের অধিক কাল বিস্তৃত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেখানে ২ কোটির মতো মানুষ প্রাণ হারায়, সেখানে মাত্র এক বছরেই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক কেড়ে নেয় ১ কোটির বেশি মানুষের প্রাণ! দেশে দেশে সরকার সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরিধানের জন্য আইন পাস করে, দীর্ঘদিনের জন্য বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়, খাদ্যদ্রব্যের বাজারগুলোতে লোক সমাগম নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোরভাবে। ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের শবদেহ কাটাছেঁড়া করে ডাক্তাররাও বিচলিত হয়ে উঠতেন। দেখা যেতো, তাদের ফুসফুস নীল এবং স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকতো। মনে হতো যেন তারা পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন।
দ্য থার্ড প্লেগ প্যানডেমিক
ইতিহাসে বিস্তৃত আকারে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে ৩ বার। তৃতীয়টির উৎপত্তি ১৯ শতকে চীনে, যখন বিশ্ববাণিজ্যে ভালোরকম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে দেশটি। ইউয়ান নামক একটি ছোট্ট গ্রামে প্রথম এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ক্রমে তা বিস্তার লাভ করতে করতে হংকং আর গুয়াংঝু প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যে শহরগুলোর সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ফলে প্লেগ ছড়িয়ে যায় ভারত, আফ্রিকা, ইকুয়েডর, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। প্রায় দুই দশক স্থায়ী এ মহামারীতে প্রাণ হারায় ১ কোটির অধিক মানুষ।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদের বর্ণনায় সংখ্যাটা ছাড়িয়েছে দেড় কোটির কোটা! ভাগ্যিস, সেসময় চিকিৎসাবিজ্ঞানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছিল বেশ ভালোভাবেই। পূর্বের অনেক মরণঘাতি রোগই তখন প্রতিনিয়ত ডাক্তারদের নিরাময় করার সক্ষমতার মধ্যে চলে আসতে শুরু করে। আর এ কারণেই মূলত চতুর্থবার আর প্লেগ মহামারী ঘটেনি। সেবারই বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক সমাজ এর প্রতিকার প্রতিবিধান করে।
দ্য পোলিও এপিডেমিক
১৯১৬ সালে পোলিও রোগ প্রথম মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সেবছর নিউইয়র্কে ৯ হাজার মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ৬ হাজার মানুষই মৃত্যুবরণ করে! চিকিৎসাবিজ্ঞান তখন যথেষ্টই উন্নত হলেও চিন্তার বিষয় ছিল যে, এই মহামারীতে মৃত্যুর হার আগের যেকোনো মহামারীর চেয়ে বেশি ছিল! নিউইয়র্ক শহর থেকে ক্রমে পোলিওর প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিবছর বিশ্বে কত শত মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার কোনো সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। অবশেষে ১৯৫০ সালে জোনাস সাল্ক পোলিও টিকা আবিষ্কার করলে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ কমে যায়।
দ্য প্লেগ অব এথেন্স
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দের কথা। স্পার্টানদের সাথে গ্রিকদের তখন যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে এমনিতেই খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না গ্রিকরা। তার উপর মরার উপর খরার ঘা হয়ে আসে ‘দ্য প্লেগ অব এথেন্স’ নামে পরিচিত পৃথিবীর প্রথম প্লেগ মহামারী। এই মহামারীতে হাজার হাজার গ্রিক সৈন্য মারা যায় কয়েক দিনের ব্যবধানে। টাইফয়েড, টাইফাস জ্বর, গুটিবসন্ত কিংবা অ্যানথ্রাক্স, ইতিহাসবিদগণের মাঝে এই প্লেগের ধরন নিয়ে আছে বিস্তর মতপার্থক্য।
অন্যদিকে এথেন্সের প্লেগ মহামারী নিয়ে খুব বেশি তথ্যও যে আমরা পেয়েছি এমনও না। তাই এর প্রকৃত ধরন আমরা হয়তো কোনোদিন জানতে পারবো না। আবার এই মহামারীতে ঠিক কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল তা-ও জানা সম্ভব নয়। আক্ষরিক অর্থে, এথেন্সের প্রাচীন মহামারী সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানি সবই গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডসের রচনাংশ ‘হিস্ট্রি অব দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়্যার’ থেকে পাওয়া।
অবশ্য থুসিডাইডসের তথ্য নিয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই কোনো ইতিহাসবিদের মনেই। কারণ থুসিডাইডস এই কুখ্যাত প্লেগ নিজ চোখেই দেখেছেন, যা গ্রামের পর গ্রাম জনমানবহীন করে দিয়েছিল। এ ব্যাপারে থুসিডাইডসের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়।
এ মহামারী এতটা ভয়ংকর যে ইতিহাসের আর কোনো মহামারী কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথেও এর তুলনা করা চলে না!
স্মলপক্স এপিডেমিক অব ইন্ডিয়া
গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল কখন? জানেন কি? ২০ শতকে না, ১৯ শতকেও না, ১৮ শতকের শেষভাগে (১৭৯৬ সালে) এডওয়ার্ড জেনার এই টিকা আবিষ্কার করেন। এটিই ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম সফল টিকা। অথচ টিকা আবিষ্কারের প্রায় ২০০ বছর পরও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে!
হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছিল ভারতে। ১৯৭০ সালে হঠাৎ মহামারী আকারে ছড়িয়ে যায় গুটি বসন্ত। ১ লক্ষাধিক মানুষ রাতারাতি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এক বছরেই মৃত্যুবরণ করে ২০ হাজারের অধিক মানুষ। যদিও এ তালিকার অন্যান্য মহামারীর তুলনায় এ মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশ কম, তথাপি চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিক সময়ে, যখন বিশ্ব প্রায় গুটি বসন্ত মুক্ত হয়ে গেছে, তখন ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এরূপ মহামারী ছিল বেশ হতাশাজনক। পরবর্তী কয়েকবছরে ভারত সরকার এবং জাতিসংঘের সহায়তায় গঠিত একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালেই ভারতকে গুটি বসন্ত মুক্ত ঘোষণা করা সম্ভব হয়।
সার্স
‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম’ তথা সার্স (SARS) নামটা এ তালিকায় সবচেয়ে নতুন এবং আমাদের নিকট সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত। মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বইয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যায়ে এ রোগের লক্ষণ এবং ধরনের সাথে পরিচিত হয়েছেন অনেকেই। হাঁচি কাশির মাধ্যমে বায়ুবাহিত এ রোগের জীবাণু সহজেই ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম বলে জনমনে সংক্রমণের আশঙ্কাটা ছিল বেশি।
সার্সের জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, জ্বর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে শুষ্ক কাশি শুরু হয়, যা একসময় নিউমোনিয়ায় পরিণত হয়। সার্সের কোনো নিজস্ব চিকিৎসা নেই। তাই ডাক্তাররা এর প্রতিকার থেকে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেন, যে কারণে ২০০৩ সালে সার্সের প্রাদুর্ভাবের সময় সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ সার্স দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান দ্রুত কাজ শুরু করলে মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারেনি। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সার্স নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এসময় এ রোগে মৃত্যু হয় ৭৩৭ জনের।