একটি বহুজাতিক কোম্পানির পদস্থ চাকুরে সজীব মাহালী বহুদিন পরে গ্রামের বাড়ি এসেছেন। পড়াশোনা শেষ করে সেই যে বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলেন, তারপরে আর দেশেই আসা হয় না! যদি দেশে আসেনও কখনো, ঢাকায় তার ফ্লাটে ওঠেন! গ্রামের দিকে আর আসার সময় হয় না। কিন্তু এবার তিনি গ্রামে এসেছেন! নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী এপার্টমেন্টে টানা থাকতে থাকতে তার মনটা হাঁপিয়ে উঠেছিলো। তাই ছুটি পেয়ে সোজা বাড়ি!
ছোটবেলার বন্ধুরাও তাকে পেয়ে খুবই খুশি। ধুমসে আড্ডাবাজী চলছে। তাকে দেখলে কে বলবে, এই সজীব স্যুটেড-বুটেড হয়ে সকাল দুপুর অফিস করেন। শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে দুদিন ধরে। তার ছুটিও আবার শেষ হয়ে এলো। আবার ফিরে যেতে হবে কংক্রিটের জঙ্গলে। ফিরে যাওয়ার আগে বন্ধুরা আবদার ধরল, চল, নদীর তীরে ছোটবেলার মতো বৃষ্টির ভেতরে ফুটবল খেলি।
সজীব মাহালী যেন ফিরে গেলেন ছোটবেলার দিনগুলোতে। কাদাজলে চলল ছেলেমানুষি। তারপর মনের সুখ মিটিলে পাগলামো করে বাড়ি ফিরলেন মনের মধ্যে পুষে রাখা কর্পোরেট কর্মকর্তা সজীব মাহালী।
পরেরদিন তার ঢাকায় যাওয়ার কথা। কিন্তু যাওয়া হল না। বিকেল হতে না হতেই প্রচণ্ড মাথা ধরল তার। রাত হতে কাঁপুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর! সেই সাথে শুকনো কাশি। সাথে বোনাস হিসেবে যুক্ত হল মাংসপেশিতে ব্যথা! দ্রুত ডাক্তার ডেকে আনা হল। অভিজ্ঞ ডাক্তারের বুঝতে অসুবিধা হল না কাহিনী। রোগীকে অভয় দিলেন। তেমন কিছু নয়, বৃষ্টিতে ভিজে সামান্য ব্যাকটেরিয়াজনিত জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছেন তিনি। ওষুধ চলল। দ্রুতই জ্বরের প্রকোপ থেকে মোটামুটি রেহাই পেলেন। কিন্তু পুরোপুরি সেরে উঠলেন না তিনি।
শরীর হঠাৎ করে বেশ দুর্বল হয়ে পড়লো। কয়েকদিন পরে শুরু হলো নতুন উৎপাত। পায়ে ঠিকমতো বল পাচ্ছেন না। সবাই বলল, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করলে ওসব ঠিক হয়ে যাবে! এই অবস্থাতেই তিনি গন্তব্যে রওনা হলেন। কিন্তু অসুস্থতা তার পিছু ছাড়ল না। এর মধ্যেই এক অদ্ভুত সমস্যা আরম্ভ হল। সারা দেহে এক অসহ্য যন্ত্রণা, যেন কেউ পিন দিয়ে অনবরত খোঁচাচ্ছে তাকে! বিশেষ করে হাত আর পায়ের আঙ্গুলে এমন অদ্ভুত অনুভূতি বেশি হয়। অন্যদিকে এতদিন ধরে পায়ে বল পাচ্ছিলেন না তিনি, আস্তে আস্তে ক্রমশ উপর দিকে বাড়তে লাগলো। হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়!
তিনি দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। ডাক্তার তার রোগ বিবরণী শুনে ত্বরিত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিলেন। পরীক্ষায় ধরা পড়লো তিনি গুলেন-বেরি সিনড্রোমে আক্রান্ত!
সজীব মাহালী গুলেন-বেরি সিন্ড্রোম নামে যে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন, সেটি আসলে একটি অটোইমিউনো নিউরোডিজেনারেটিভ অসুখ। এই রোগে নিজের দেহের স্নায়ুকোষের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হয়, যা স্নায়ুকোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর পেছনের মূল রহস্য এখনো জানা যায়নি।
স্নায়ুতন্ত্র অসংখ্য স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত। স্নায়ুকোষকে বলা হয় নিউরন। এই নিউরনের দুটি অংশ- একটি কোষ দেহ এবং অপরটি অ্যাক্সন বা প্রলম্বিত অংশ। এই অ্যাক্সনই স্নায়ুতন্তু গঠন করে। স্নায়ুতন্তুর চারপাশে সুরক্ষা এবং স্নায়ু সংকেত যাতে দ্রুত ও নিখুঁতভাবে এক কোষ থেকে অন্য কোষে পৌঁছাতে পারে, তার জন্য মায়েলিন নামক লিপিড বা স্নেহজাতীয় পদার্থের একটি আবরণ থাকে।
গুলেন-বেরি সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমের কাজে কিছুটা ওলটপালট ঘটে যায়। ফলে এরা এই মায়েলিন আবরণীকেই শত্রু ভাবা শুরু করে। আর তাকে ঠেকানোর জন্য এন্টিবডি তৈরি করে। এই এন্টিবডি মায়েলিন আবরণীকে আক্রান্ত করে তাকে বিনষ্ট করে দেয়।
সাধারণত কিছু সংক্রামক অসুখে বা কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার কিংবা ভ্যাকসিন গ্রহণের পর শরীর এমন অদ্ভুত আচরণ করতে পারে। তবে দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গুলেন-বেরি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আগে রোগী কোনো না কোনো সংক্রামক রোগে ভুগেছে। এদের মধ্যে পেটের সমস্যা আর শ্বাসনালীর সমস্যা হরহামেশাই ঘটে! আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রায় ৩০ ক্ষেত্রে শরীরের ইমিউনিটির এই উলটোপালটা আচরণে একটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়া, যার নাম Campylobacter jejuni, কর্তৃক সৃষ্টি হয়।
সাইটোমেগালো ভাইরাস এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও কম দায়ী নয়। এছাড়া আরো কিছু বিষয় জড়িত রয়েছে-
• এপস্টেইন বার ভাইরাস (Epstein–Barr virus)
• ভ্যারিসেলা জোস্টার ভাইরাস (Varicella Zoster Virus)
• মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি ব্যাকটেরিয়া (Mycoplasma pneumonia)
• প্লাজমোডিয়াম জীবাণু (Plasmodium)
• জিকা ভাইরাস (Zika virus)
• হেপাটাইটিস ই ভাইরাস (Hepatitis E Virus)
• হাম (Measles Virus)
• এইডস (AIDS)
• হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (Herpes simplex virus)
• সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথ্রোম্যাটোসাস (Systemic Lupas Erythromatosus)
• হজকিন্স লিম্ফোমা (Hodgkins Lymphoma) প্রভৃতি।
গুলেন-বেরি সিনড্রোমকে সর্বপ্রথম মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন জ্যা ব্যাপটিস্ট অক্টেভ ল্যান্ড্রি, সালটি ছিল ১৮৫৯। এরপরে ফ্রেঞ্চ নিউরোলজিস্ট জর্জেস গুলেন, জ্যা আলেকজান্দ্রে বেরি এবং আন্দ্রে স্ট্রোহল দুজন সৈন্যের দেহে এই রোগ শনাক্ত করেন এবং এর প্যাথলজি বা রোগতত্ত্ব বর্ণনা করেন।
গুলেন-বেরি সিনড্রোমে হঠাৎ করেই দ্রুত শুরু হয়। পেশির দুর্বলতা চূড়ান্ত পরিণতিতে প্যারালাইসিসে রূপ নিতে পারে। এটি পা থেকে আরম্ভ হয়ে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। বুকের মাংসপেশিকেও এটি আক্রান্ত করতে পারে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা যায়। এ রোগে সাধারণত নিম্নলিখিত উপসর্গ পাওয়া যায়-
• পায়ের পাতায় ও পায়ে দুর্বলতা, যা আস্তে আস্তে হাতে এবং করোটিক স্নায়ুতে বিস্তার লাভ করে। কখনো কখনো দুর্বলতা হাত থেকে শুরু হয়ে নিচের দিকে অগ্রসর হতে পারে। আবার কখনো হাতে পায়ে একই সাথে আরম্ভ হয়। সেখানেই আরম্ভ হোক না কেন, ২৪-৭২ ঘন্টার ভেতরে জটিলতা অনেক বেড়ে যেতে পারে। আস্তে আস্তে পেশির উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায়, যা থেকে প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে। মুখের মাংসপেশি নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়।
• যেহেতু দেহের বাইরের দিকের স্নায়ুতন্ত্র গুলেন-বেরি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়, তাই স্পর্শজনিত অনুভূতিগুলোতে পরিবর্তন আসে। শরীরের কোথাও কেউ ধরলে ব্যথা লাগে। হাত পায়ে ঝিনঝিন অনুভূতি হয়। আবার কখনো বা অনুভূতি শক্তি কমে যায়, ক্রমশ অসাড় হয়ে আসে হাত পায়ের পাতা।
• দৃষ্টিশক্তিতেও পরিবর্তন আসে গুলেন-বেরি সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষদের। এর ফলে কোনো জিনিস স্পষ্টভাবে দেখতে সমস্যা হয়।
• প্রস্রাব করতে গেলে অসুবিধার সম্মুখীন হয় রোগীরা। Urinary Incompetence দেখা যায় এদের। ফলে প্রস্রাব ধরে রাখতে পারে না। অনেক সময় বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে রোগী।
• এছাড়া খেতে গেলে অসুবিধা হয়। গুলেন-বেরি সিন্ড্রোম যেহেতু বুকের মাংসপেশিকে আক্রান্ত করে, তাই এ রোগে আক্রান্তদের শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হয়। এমনকি সাময়িকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এর ফলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।
রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে একজন ডাক্তার সর্বপ্রথম যেটি করেন, তা হল রোগীর কাছ থেকে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করা, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘মেডিকেল হিস্টোরি অব পেশেন্ট।’ এই হিস্টোরিতে কোনো রোগী যদি পেশির দুর্বলতা বা প্যারালাইসিস নিয়ে আসেন এবং পূর্ববর্তী জ্বরে ভোগার কথা উল্লেখ করেন, সেক্ষেত্রে ডাক্তার এটি গুলেন-বেরি সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে মনে করেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য স্নায়ুতন্ত্রীয় গতিবেগ (Nerve Conducton velocity), সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বিশ্লেষণ (Cerebrospinal Fluid analysis), ইএমজি (Electromyography Electrocardiogram) প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
গুলেন-বেরি সিনড্রোম সাধারণত আপনাআপনি সেরে ওঠে। তবে এই রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে যে উপসর্গগুলো দেখা যায়, সেগুলো বেশ তীব্র হয়ে থাকে। তাই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে চিকিৎসা করানো সবচেয়ে ভালো উপায়। এখানে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটলে তাৎক্ষণিক অক্সিজেন দেওয়ার সুযোগ থাকে। এছাড়া স্বাভাবিক মূত্রত্যাগে অসুবিধার জন্য ক্যাথেটারের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত থাকে হাসপাতালে, যা রোগীর সম্ভাব্য মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
রোগীকে ব্যথার জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে প্লাজমাফেরেসিস ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী সেরে ওঠে। গুলেন-বেরি সিনড্রোমে রোগী বেঁচে থাকার হার ৯৫ ভাগ। শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী সম্পূর্ণ সেরে ওঠে। তবে গুলেন-বেরি সিনড্রোম থেকে সেরে উঠতে বেশ সময় লাগে। রোগীর অবস্থাভেদে সাধারণত সেরে উঠতে ৬-১২ মাস সময় লাগে।
তাই তাড়াহুড়ো করে কিংবা আতঙ্কিত হয়ে পড়ার চেয়ে ধীরে-সুস্থে চিকিৎসা গ্রহণ করাই গুলেন-বেরি সিনড্রোমের হাত থেকে মুক্তির উপায়।
ফিচার ইমেজ: myvaccinelawyer