লোকমুখ আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে চলমান কোনো সংবাদই আমাদের কাছে আর অবিদিত নয়। বেশি জানা দোষের কিছু না, কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় তখনই যখন সঠিক ও ভুলের পার্থক্য আমরা আর করতে না পারি।
চলমান এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সকলেই আজ আমরা নিরুপায়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে শতভাগ সাফল্যমণ্ডিত কোনো সমাধান নেই এর। অতীতেও এমন দুঃসময় এসেছে বহুবার; কিছুর উত্তর মিলেছে, আবার কিছু রয়ে গেছে প্রশ্নাতীত আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহচার্যে প্রতিরক্ষা করতে না পেরে প্রতিরোধের আশায় আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি গৃহবন্দীত্ব। এই সংকট নিরসনে চিকিৎসাবিজ্ঞান চায় সময়, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা, সফল চিকিৎসাব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষাপ্রণালী প্রস্তুত করবার জন্য পর্যাপ্ত সময়।
এরই মাঝে সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমগুলোয় ভেসে বেড়াচ্ছে ‘প্লাজমা থেরাপি’ নামক এক চিকিৎসাব্যবস্থা। ‘প্লাজমা থেরাপি’ বা ‘কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিরসনে নতুন আবিষ্কৃত কোনো ব্যবস্থা নয়। বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই পদ্ধতিটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে জড়িত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রথম যে নোবেল পুরষ্কারটি প্রদান করা হয় ১৯০১ সালে, তা এই ‘কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’কে কেন্দ্র করেই। জার্মান শারীরতত্ত্ববিদ এমিল ভন বেরিং ও জাপানীজ শারীরতত্ত্ববিদ কিতাসাতো শিবাসাবুরো ১৮৯০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া একটি আবিষ্কার প্রকাশ করেন। তারা গবেষণায় দেখতে পান, ডিপথেরিয়া কিংবা ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত কোনো প্রাণীর রক্তে এক অজানা বস্তু তৈরি হচ্ছে, যার ফলে প্রাণীটি দ্রুত সেরে উঠছে। সেসময়ে অদৃশ্য এই বস্তুটির ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অজানা বস্তুটির নাম বেরিং উল্লেখ করেন ‘অ্যান্টিটক্সিন’ (যা প্রাণীর রক্তে থাকা ডিপথেরিয়া কিংবা ধনুষ্টংকারের টক্সিনকে অকেজো করে দিতে সক্ষম)। প্রাণীদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘অ্যান্টিবডি’ হিসেবে আরো বহু বছর পরে গিয়ে আমরা এর আসল পরিচয় পাই।
বেরিং তার গবেষণায় আরো দেখতে পান, ডিপথেরিয়া থেকে সুস্থ হয়ে উঠা প্রাণীটির অ্যান্টিটক্সিন সম্বলিত রক্ত যদি অন্য কোনো আক্রান্ত প্রাণীতে দেয়া হয়, তাহলে আক্রান্ত প্রাণীটি আরো দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে। আবিষ্কারটি খুব দ্রুতই চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাড়া ফেলে, বহুগ বেষণায় এর সাফল্য নিয়েও আর কোনো সন্দেহ থাকে না। এসবেরই ধারাবাহিকতায় তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রথম নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন।
‘কনভালেসেন্ট’; যার ভাবার্থ দাঁড়ায়, কোনো রোগ থেকে সদ্য আরোগ্য হয়ে ওঠা ব্যক্তি। কোনো সংক্রামক রোগ হতে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির রক্তে তৈরি হয় বেরিংয়ের সেই অ্যান্টিবডি। এটিই আসলে রোগটি সারিয়ে তুলেছে। এই অ্যান্টিবডি সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষটির দেহ থেকে একই রোগের অন্য কোনো রোগীর দেহে প্রবেশ করানোর যে ধারণা, সেটাই হলো আমাদের বহুল আলোচিত ‘প্লাজমা থেরাপি’।
ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধরাশায়ী এ পরিস্থিতিতে ‘প্লাজমা থেরাপি’র সামান্য সাফল্যকে পুঁজি করেই আশার আলো দেখছে মানবজাতি। প্লাজমা থেরাপি-র মাঝেও রয়েছে অনেকগুলো ‘কিন্তু’। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের আগপর্যন্ত বেরিংয়ের এই প্লাজমা থেরাপিই ছিলো আস্থার মূর্তমান প্রতীক, এমনকি স্প্যানিশ ফ্লুতেও এর ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। অ্যান্টিবায়োটিক বাজারজাত হবার পর প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার কমে এলেও পরবর্তীতে অজানা কোনো অণুজীব পোলিও, মারবার্গ, ইবোলা ভাইরাসের সৃষ্ট মহামারীগুলোর কবল থেকে মুক্তির আশায় প্রতিবারই চিকিৎসাবিজ্ঞানকে দ্বারস্থ হতে হয় প্লাজমা থেরাপির কাছে।
আসলে সবক্ষেত্রে যদি এই প্লাজমা থেরাপিই সমাধান হতো তাহলে আমাদের আর চিন্তা করতে হতো না। বর্তমান সংকট নিরসনে প্লাজমা থেরাপি সাফল্যের আলো দেখালেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেনি।
মানবদেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাটি বেশ শক্তিশালী ও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। একজন মানুষ যখন নির্দিষ্ট কোনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাটি সঙ্গে সঙ্গে তার কাজ শুরু করে দেয়। জীবাণুটির বিরুদ্ধে রক্তে তৈরি হয় অসংখ্য অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিবডিগুলো উক্ত জীবাণুর বিরুদ্ধে শুরু করে ধ্বংসযজ্ঞ। একবার হাম কিংবা জলবসন্ত হলে সারাজীবনে আর কখনো আক্রান্ত হয় না; এমন কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, জীবাণু আপনার দেহে প্রবেশ করে ঠিকই, কিন্তু রক্তে থাকা বিশেষ স্মৃতি কোষ আগেরবার আক্রান্ত হবার স্মৃতিধারণ করে রেখে দেয়। দ্বিতীয়বারের মতো সেই জীবাণু প্রবেশ করামাত্রই অ্যান্টিবডি হাজির হয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
সবার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সমান শক্তিশালী নয়, তাই কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত সবার শরীরেও সমান সময়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। এখন যদি বেরিংয়ের আবিষ্কার অনুযায়ী, সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষটির অ্যান্টিবডি অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রদান করা যায়, তাহলে অসুস্থ মানুষটিকে আর নতুন করে অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে পুরো রক্ত নিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই তেমন, অ্যান্টিবডি অবস্থান করে রক্তের জলীয় অংশ রক্তরস বা প্লাজমায়। তাই সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষটির প্লাজমা অসুস্থ মানুষটির দেহে প্রবেশ করালেই অ্যান্টিবডি স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই প্লাজমা থেরাপিতেও রয়েছে অনেকগুলো ‘কিন্তু’। কোভিড-১৯ ভাইরাস সংকট নিরসনে প্লাজমা থেরাপি হলো ভাসমান খড়কুটোর মতো। রক্তরসে উপস্থিত অ্যান্টিবডি মাত্রেই যে ধ্বংসযজ্ঞে সিদ্ধহস্ত তা নয়। জীবাণু অনুযায়ী মানবদেহে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিও ভিন্ন ভিন্ন। তাছাড়া রোগমুক্তি মানেই কিন্তু অ্যান্টিবডির কারসাজি নয়, অ্যান্টিবডি ছাড়াও আরো একটি প্রতিরক্ষা উপাদান রয়েছে: T-Cell। এইচআইভি ভাইরাস এই T-Cell-কেই আক্রমণ করে বসে। এর কোনো টিকা নেই, প্রতিরোধই ভরসা আমাদের।
অ্যান্টিবডির গল্পেই ফিরে আসা যাক। সদ্যোজাত অ্যান্টিবডি অক্ষমও হতে পারে, যদি রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তবেই কেবল একটি রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব। একটি ছোট উদাহরণ দেয়া যাক।
হেপাটাইটিস-বি টিকা নিশ্চয়ই অনেকেই গ্রহণ করেছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় একজন নবজাতককে বর্তমানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই এই টিকা প্রদান করা হয়। এই টিকা দেয়া হলে রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করবে। ভবিষ্যতে যদি কখনো হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আপনার দেহে প্রবেশ করে, অ্যান্টিবডিগুলো কাঙ্ক্ষিত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে। কিন্তু আরেকটি নীরব ঘাতক হলো হেপাটাইটিস-সি। এর কোনো টিকা নেই, এই ভাইরাসের বিপরীতে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি কোনো কাজেই আসে না। এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির সাবটাইপ পাওয়া গিয়েছে ৫০টির মতো, কাকে রেখে কার বিরুদ্ধে কাজ করবে অ্যান্টিবডি! এখানেও টিকাবিহীন অবস্থায় প্রতিরক্ষার পরিবর্তে প্রতিরোধকেই বেছে নিতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে গিয়ে আমরা সবাই এখন গৃহবন্দী, যেটুকু সাবধানতা অবলম্বন করবার কথা ছিলো, তা-ও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না সর্বত্র।
দিশাহীন চিকিৎসাবিজ্ঞান যে প্লাজমা থেরাপিতে আশার আলো খুঁজে পেয়েছে, তাও কি-ন্তু পুরোপুরি চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। একজন মানুষের দেহ থেকে অপর দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে এমনিতেই কিছু ঝুঁকি থেকে যায়। সেগুলো নিরসন করা গেলেও নভেল করোনাভাইরাসের প্রতি আমাদের অজ্ঞতা রয়েছে অনেকখানি। কনভালেসেন্ট প্লাজমায় যদি অকার্যকরী অ্যান্টিবডি থেকে যায়! এই অ্যান্টিবডিগুলো যদি আগুনে কেরোসিন ঢালার মতো কাজ করে বসে! এসবের উত্তর চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে নেই। এসবের উত্তর জানতে প্রয়োজন প্রচুর গবেষণা, গবেষণা করতে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির প্লাজমা। কেউ যদি স্বেচ্ছায় প্লাজমা দানে আগ্রহী না হন, গবেষণা কিংবা চিকিৎসার স্বার্থে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর ল্যাবে প্লাজমা তৈরি করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই প্লাজমার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
আর এই মুহূর্তে গবেষণার থেকেও আমাদের অধিক প্রয়োজন মানুষের জীবন বাঁচানো। প্লাজমা থেরাপিতে ঝুঁকি রয়েছে, কিন্তু উপকৃত মানুষের সংখ্যাটাও নেহায়েৎ মন্দ নয়। ঝুঁকির তুলনায় উপকারের পরিমাণটা বেশি হওয়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞান এতে আশাবাদী হয়ে উঠছে। নির্দিষ্ট শর্ত মোতাবেক সুস্থ হয়ে ওঠা যে কেউ স্বেচ্ছায় প্লাজমাদানের মাধ্যমে মুমুর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম।
এর মানে এই নয় যে, প্লাজমা থেরাপি শতভাগ সফল এবং এর উপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক ও সংবাদ মাধ্যমগুলো প্লাজমা থেরাপিকে যেভাবে রাতারাতি সুপারহিরো/সেলিব্রেটিতে পরিণত করেছে, তা কল্যাণকর নয়। একটা সময় গিয়ে আমাদের মনে এমনও আফসোস উত্থিত হতে পারে, “ইশ্, প্রয়োজনীয় প্লাজমার অভাবেই বোধহয় আমার প্রিয়জন মারা গেলো!” কিংবা হতাশার স্বর, “আহারে, প্লাজমা থেরাপি দিয়েও অমুককে বাঁচানো গেলো না!” প্লাজমা থেরাপি একজন মুমুর্ষু করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কিছু পরিমাণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম মাত্র। অধিকাংশ মানুষ যেহেতু প্রাথমিক লক্ষণজনিত চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে উঠছে, তাই প্লাজমা থেরাপি কেবলমাত্র মুমুর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে।
মুমুর্ষু রোগীর প্রয়োজনে সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা কোভিড-১৯ জয়ীদের প্রতি পর্যাপ্ত নির্দেশনার সাথে প্লাজমা দানের আহবান জানানো হয়েছে। রক্তদানের থেকেও অনেকখানি নিরাপদ এই প্লাজমাদান। আপনি প্রতি চার মাসে একবার রক্তদান করতে পারবেন, তা-ও ৪৫০ মি.লি.। কিন্তু এক সপ্তাহ পর পর আপনি ৪০০-৬০০ মি.লি. প্লাজমা দান করতে পারবেন। রক্তের দুটি অংশ; একটি হলো রক্তের বিভিন্ন কোষ ও রক্তের তরল অংশ। রক্তের এই তরল অংশটিই হলো রক্তরস বা প্লাজমা, যার ৯০ শতাংশই পানি। প্লাজমা দান করে চব্বিশ ঘন্টার মাঝে অধিক পানি পানে আপনার ক্ষয়পূরণ হয়ে উঠবে। আপনি যদি ৪০০-৬০০ মি.লি প্লাজমা প্রদান করেন, ২০০ মি.লি করে করে তিনজন মুমুর্ষু রোগীকে এ থেরাপি দেয়া সম্ভব।
একজন প্লাজমাদাতার দেহ থেকে অ্র্যাফেরেসিস মেশিনের সাহায্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়। এই মেশিনটির সাহায্যে রক্তের তরল জলীয় অংশটুকু আলাদা করে রেখে বাকিসব রক্তকণিকা (লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেতরক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা) দাতার দেহে ফিরে যায়। তবে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে অ্যাফেরেসিস মেশিনের ব্যবস্থা না থাকে সেক্ষেত্রে, দাতার দেহ হতে একব্যাগ সম্পূর্ণ রক্ত নিয়ে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের সাহায্যে প্লাজমা আলাদা করে নেয়া যাবে।
অ্যাফেরেসিস মেশিনে প্লাজমা দান করতে সময় প্রয়োজন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটের মতো, আর এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিংবা তদরূপ ক্ষতির আশংকাও নেই।
নিম্নোক্ত শর্তানুসারে একজন সদ্য সুস্থ হয়ে উঠা কোভিড-১৯ জয়ী ব্যক্তি প্লাজমা দান করতে পারবেন:
১. আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হবার পর (পজিটিভ আসার পর আর পরীক্ষা করাননি, ইতোমধ্যেই সব লক্ষণ দূরীভূত হয়ে গেছে) অবশ্যই ২৮ দিন অতিবাহিত হতে হবে। অথবা উপসর্গমুক্তির পর ন্যূনতম ২৪ ঘন্টা ব্যবধানে পরপর দুটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল যদি দুটোই ‘নেগেটিভ’ পাওয়া যায়, তবে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার ১৪ দিন অতিবাহিত হতে হবে।
২. যারা এক বা একাধিকবার গর্ভধারণ করেছেন, তারা প্লাজমাদানের জন্য উপযুক্ত নন। এছাড়াও উচ্চরক্তচাপ ও ডায়বেটিক রোগীরা প্লাজমাদান করতে পারবেন না।
৩. প্লাজমাদানে আগ্রহী ব্যক্তির রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টাইটার পরীক্ষার ফল ন্যূনতম ১:১৬০ হতে হবে। (এটি এফডিএ প্রকাশিত একটি নির্দেশনা মাত্র, সবখানে এই পরীক্ষাটি করার ব্যবস্থা না-ও থাকতে পারে, তাই এ নিয়ে অহেতুক মাথা না ঘামিয়ে ১ নং শর্তটি মেনে প্লাজমাদানই উপযুক্ত হবে)
৪. বয়স অবশ্যই ১৮ বা তদূর্ধ্ব এবং ওজন ৫০ কেজির অধিক হতে হবে।
প্রিয়জনের দেহে প্লাজমা প্রদানের পূর্বে অবশ্যই উপরের শর্তগুলো নিজেই একবার নিশ্চিত হয়ে নেবেন, বিশেষ করে প্রথম শর্তটি, অবশ্যই নিশ্চিত হোন দুটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে কি না।
প্লাজমা থেরাপি নিয়ে বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমে বিরূপ সংবাদও ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে। প্লাজমা থেরাপি কোনো গবেষণায় প্রমাণিত শতভাগ সাফল্যমণ্ডিত চিকিৎসাব্যবস্থা নয়। রোগীর জীবন মরণাপন্ন হয়ে উঠলে রোগী অথবা রোগীর অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে সব ধরনের শর্ত মেনে প্লাজমা থেরাপির জন্য পরীক্ষামূলক নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।
একজন প্লাজমাদাতা হিসেবে প্লাজমা দিতে গিয়ে আপনার অনেকগুলো রক্তপরীক্ষাও বিনামূল্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে। রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে গ্রুপিং, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইডস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিসের মতো পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। কোনো হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেখানে আপনাকে এসব পরীক্ষা করাতে অর্থ গুণতে হতো, প্লাজমা দান করতে গিয়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই পরীক্ষাগুলো করে নেয়া যাবে। আপনার কিছু উপকারও হলো, আবার আপনি মানবজাতির জন্য অবদানও রাখলেন মুমুর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানোর মাধ্যমে।
করোনা জয়ীদের প্লাজমাদানে উদ্বুদ্ধ করতে মেডিকেল কলেজ সংগঠন সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাবসহ বিডিএফ, সোমা, এফডিএসআরের মতো অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্মই স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এগিয়ে এসেছে। রক্তরস বা প্লাজমার কোনো বিকল্প নেই, ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাবে তৈরি করে নেয়াও সম্ভব নয়। আপনি যদি সদ্য সুস্থ হয়ে ওঠা একজন কোভিড-১৯ জয়ী হয়ে থাকেন, স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসুন। নিজেরা প্লাজমাদান করুন, অপরকেও দানে উৎসাহিত করুন। অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে এখনই যদি আমরা সবাই দলবদ্ধ না হই, তাহলে কখনোই এর মোকাবেলা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।