খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, মাত্র দুই শতাব্দী আগেও চিকিৎসকদের বিশ্বাস এখনকার চেয়ে অনেক ভিন্ন ছিল। তারা মনে করতেন, চারটি বস্তুর ওপর নির্ভর করে স্বাস্থ্যের ভারসাম্য। এরা হলো- হলুদ পিত্ত, কালো পিত্ত, শ্লেষ্মা আর রক্ত। বর্তমান গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক এগিয়ে এসেছে। মানবদেহ এবং রোগতত্ত্বের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান এখন আর সেই সময়কার ধোঁয়াশার মাঝে নেই।
এমতাবস্থায় আমরা কি বলতে পারি, সব কিছু আমাদের জানা আছে? সব রোগের কারণ, চিকিৎসা এবং উপসর্গ আমাদের নখ-দর্পণে আছে? আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্যই অনেক এগিয়েছে তবে সকল কিছু আমাদের হাতে চলে এসেছে এরকম দাবি করলে সেটা হবে নির্বুদ্ধিতা। আজও ‘মানবদেহ’ নামের জটিল এই যন্ত্রের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানের অনেক ঘাটতি আছে। আজও আমরা এর মতি-মর্জি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। তাই কোনো সমস্যাকে অবাস্তব বলে অগ্রাহ্য করা, অথবা হেসে উড়িয়ে দেওয়া আসলে বোকামী, তা সে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন। উদাহরণ? মরজেলনস ডিজিজ।
এই শতকেরই শুরুর দিকে ফিরে যাই। ২০০১ সাল। এক ভদ্রমহিলার গল্প শুরু এখান থেকে। নাম মেরি লেইটো। দুই বছর বয়সী ছোট্ট এক ছেলে সন্তানের মা তিনি। আচমকা বাচ্চার ঠোঁটের নিচে দেখা গেল ক্ষত। মনে হয়েছিল যে ওখানে হয়তো ‘পোকা’ জন্মেছে! সঙ্গে সঙ্গে ছেলের খেলনা মাইক্রোস্কোপ নিয়ে জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখেন। অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন- সেখানে লাল, নীল, কালো এবং সাদা কিছু তন্তু দেখা যাচ্ছে।
অবস্থা দেখে দেরি করেননি তিনি, তিনজন শিশু বিশেষজ্ঞ, তিনজন অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞ এবং দুজন চর্ম বিশেষজ্ঞকে দেখালেন। অথচ তারা কেউ তার সমস্যা ধরতে পারলেন না। রহস্যময় সব রোগের সমাধানকারী নামে খ্যাত, জন হপকিন্সের শিশু বিশেষজ্ঞ, ফ্রেড হেলড্রিকও ব্যর্থ হলেন। তবে আরেক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবার সময় কেস হিস্ট্রিতে যোগ করলেন, “লেইটোর মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করা এবং তাকে সেই অনুপাতে চিকিৎসা দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।”
বেচারি মা, ডাক্তারের কাছে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত। অনেক বাজে অভিজ্ঞতাও হলো তার। জন হপকিন্সের এক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, যার নাম উল্লেখ করা হয়নি কোথাও, তিনি ছেলেটার রেকর্ড দেখার পর তো দেখা করতেই অস্বীকৃতি জানালেন। বললেন, লেইটো নিজেই মানসিক রোগাক্রান্ত; মানচুসেন’স বাই প্রক্সিতে ভুগছে। এই মানসিক রোগে বাবা অথবা মা নিজের সন্তানকে অসুস্থ হিসেবে দেখান, যেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মনোযোগ কাড়তে পারেন। মায়ের মতে, আরো অনেক ডাক্তার ছিল তার মতো।
ধীরে ধীরে বেড়েই চলল ড্রু-এর দেহে ক্ষতের সংখ্যা। সেই সঙ্গে আরো বেশি পরিমাণে তৈরি হতে লাগল তন্তু। তার স্বামীও চিকিৎসক। এডওয়ার্ড লেইটো কাজ করেন পেনসিলভেনিয়ায়, দক্ষিণ অ্যালেগনি ইন্টারনাল মেডিসিনে। স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারলেন, তাদের সন্তান অজানা কোনো রোগে আক্রান্ত। অথচ বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা কোনো রোগের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চাচ্ছেন না।
বাধ্য হয়ে তাই নিজেই পথে নামলেন মেরি লেইটো। রোগের নাম দিলেন মরজেলনস ডিজিজ। নামকরণের পেছনেও আছে আরেকটি গল্প। স্যার থমাস ব্রাউন নাম্নী বিখ্যাত এক চিকিৎসক তার বন্ধুকে কিছু অদ্ভুত উপসর্গের কথা উল্লেখ করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ১৬৯০ সনে প্রকাশিত সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ল্যাঙ্গুডক-এর বাচ্চাদের মাঝে একটা রোগের প্রকোপ আছে। এটা কেবল সে অঞ্চলেই পাওয়া যায়। তার নাম মরজেলনস; এই রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের পিঠে রুক্ষ চুল দেখা যায়।’ তবে ব্রাউনের উল্লেখ করা এই উপসর্গের সঙ্গে যে এখানে আলোচিত রোগের কোনো সম্পর্ক আছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন মেরি লেইটো, এর শেষ দেখে ছাড়বেন। তাই ২০০২ সালে স্থাপন করলেন এম.আর.এফ. বা মরজেলনস রিসার্চ ফাউন্ডেশন। লেইটো জানান, নন-প্রফিট এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল রোগটি সম্পর্কে অজ্ঞানতা দূর করা। অবাক হয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, আরো অনেক মানুষ যোগাযোগ করছে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। তারাও নাকি এই রোগে আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত আমেরিকার ৫০টিরও বেশি অঙ্গরাজ্য এবং ১৫টি দেশে এই রোগে আক্রান্ত রোগী আবিষ্কার করেছে এম.আর.এফ.।
বিজ্ঞান অবশ্য হালকা কথায় কান দেয় না। তার চাই শক্ত প্রমাণ। আবার কোথাও কোনো ভুল হলে সেটাকে শুধরে নিতেও আপত্তি নেই বিজ্ঞানের। আর তাই শুরু হলো অনুসন্ধান। রোগটার উপসর্গকে আমলে নেওয়া হলো। যারা যারা নিজেদেরকে এই রোগে আক্রান্ত বলে মনে করেন, তারা উপসর্গগুলো জানালেন।
- ত্বকে ক্ষত হওয়া বা ফুসকুড়ি হওয়া, যা প্রচণ্ড চুলকানির সৃষ্টি করে;
- চামড়ার নিচে কিছু একটা নড়া-চড়া করার অনুভূতি;
- ত্বক কিংবা ত্বকের ক্ষত থেকে তন্তুর উঠে আসা;
- ক্লান্তি;
- মনোযোগে শ্রান্তি;
- স্মৃতিভ্রষ্টতা;
- বিষণ্ণতা
তবে প্রধান উপসর্গ হলো ত্বক কিংবা ত্বকের ক্ষত থেকে তন্তু তৈরি হওয়া।
২০০৬ সালে টনক নড়ল সি.ডি.সি. বা আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তাদের মুখপাত্র, ড্যান রুটজ যোগাযোগ করলেন লেইটোর সঙ্গে। জানালেন সি.ডি.সি. একটা দল গঠন করছে, মরজেলনস ডিজিজ বা এম.ডি.-র ব্যাপারে অনুসন্ধান করার জন্য। ছয় বছর পর পাওয়া গেল সেই অনুসন্ধানের রিপোর্ট, সি.ডি.সি. ঘোষণা করল যে এম.ডি. হচ্ছে এমন এক রোগ ‘যার উপসর্গগুলো অদ্ভুত কোনো রোগ নয়, বরঞ্চ ডিলিউশনাল ইনফেসটেশনের মতো সাধারণ রোগের সঙ্গে মিলে যায়।’ সর্বোচ্চ পর্যায়ের এহেন ঘোষণায় হতাশ হয়ে কিনা কে জানে, এম.আর.এফ. সে বছরই বন্ধ করে দিলেন লেইটো।
প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল জার্নাল ঘেঁটে দেখা যায়, সেই ১৯৪৬ সাল থেকে মরজেলনস ডিজিজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরা এই রোগের ব্যাপারে দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগের মতে, রোগটি আসলে মানসিক। অন্যভাগ দাবি করেন, এই রোগে আক্রান্ত সবাই ভুগছে গোপন এক সংক্রমণে, যার কারণ স্পাইরোচেটাল ইনফেকশন। এটি মূলত একধরনের ব্যাকটেরিয়া। তাই মানসিক রোগ বলে একে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। এই সংক্রমণের কারণে রঙিন তন্তুগুলোর আবির্ভাব দেখা যায়। আর পাশাপাশি থাকে লাইম ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর মতও নানা ধরনের সমস্যা।
নানা মুনির নানা মত, কথাটি প্রবাদ-প্রবচনে মানালেও, চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য তা ক্ষতিকর। তাই সাহায্য নেওয়া হলো আণুবীক্ষণিক পরীক্ষার। দেখা গেল- এই রোগে আক্রান্ত টিস্যুর মাঝে যে তন্তু পাওয়া যায়, তা কোনো টেক্সটাইল ফিলামেন্ট নয়। তা মূলত বায়োফিলামেন্ট। তন্তুর সঙ্গে লেগে থাকা কোষের নিউক্লিয়াস দেখে বোঝা গেল এগুলো মানুষের কোষ থেকেই তৈরি হয়েছে।
নানা রঙের হবার কারণটাও বোঝা গেল। ক্ষতে অনেক তন্তুই নীল থাকে, কারণ তাতে আছে নীল মেলানিন। টেক্সটাইল ফিলামেন্ট সাধারণত রঙের কারণে নীল হয়; তাই মেরি লেইটোর ব্যাপারে চিকিৎসকদের যে ধারণা ছিল, যে তিনি স্বেচ্ছায় কাপড়ের তন্তু তার সন্তানের ক্ষতে লাগিয়ে রাখেন, তা ভিত্তিহীন।
উঠে-পড়ে লাগলেন বিজ্ঞানীরা। অচিরেই পাওয়া গেল আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেভলি এবং স্ট্রাইকার জানালেন, তারা মোট ১২২ জন মরজেলনস ডিজিজে আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। দেখেছেন যে তাদের ৯৬.৮ শতাংশ রোগীর হয় লাইম ডিজিজ আছে, আর না হয় তারা লাইম ডিজিজের জীবাণু বহন করে চলছে।
রোগ থাকলেই যে তার চিকিৎসা থাকবে, এমন কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। অনেকেই বলেন, এই রোগের রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে। তবে এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে সেই দাবি করা যায় না। তাই এই রোগের সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা আজও আমাদের অজানা। তবে শুরুতেই চিকিৎসা করলে উপশম হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
মরজেলনস ডিজিজের ইতিহাস আমাদেরকে একটা শিক্ষা দেয় বেশ ভালভাবে। সব ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ সঠিকভাবে পর্যালোচনার পরই কেবল আমরা পারি কোনো রোগকে মানসিক রোগ বলে অভিহিত করতে। এর আগে নয়। আজও অনেক চিকিৎসক এই রোগকে ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার বলে উড়িয়ে দেন, অথচ এটা জানা যে এই রোগের সঙ্গে স্পাইরোচেটাল সংক্রমণের জোরালো সম্পর্ক আছে, যা নিঃসন্দেহে মানসিক রোগ নয়।
আশা করা যায়, ভবিষ্যতে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা হবে মরজেলনস ডিজিজ নিয়ে। জানা যাবে এর রোগতত্ত্ব ও চিকিৎসা-প্রণালী।