করোনাভাইরাসের দুশ্চিন্তায় গত কিছুদিন ধরেই ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে না। রাতে শোবার পরেও বার বার এপাশ-ওপাশ করছি। সকালে ঘুম ভাঙছেও সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশ দেরিতে। শুরুর দিকে ভেবেছিলাম, এটা হয়তো কেবল আমারই সমস্যা। পরে কয়েকজনের সাথে আলাপ করে বুঝলাম, আরও অনেকেই এমন সমস্যায় ভুগছেন।
অন্যদের সমস্যার মাঝে জানতে পেরেছি ক্রমাগত একটা ভয়ের অনুভূতি ঘিরে থাকা, ঠিকমতো খেতে না পারা, কোনো কাজে ঠিকমতো মন বসাতে না পারা, মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকা, সামনে কী হবে সেটা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা ইত্যাদির কথা। ওদিকে আগে থেকেই যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল তারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার দরুন। আবার যারা ধূমপান, মদ্যপানসহ নানা রকম নেশাজাত দ্রব্যের প্রতি আসক্ত, তারাও এসবের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
এতক্ষণ ধরে যা যা বললাম, সেসবের পেছনে রয়েছে এই নভেল করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তা। এই মানসিক সমস্যাগুলো কাটাতে কী করা যায় সেটাই আলাপ করা হবে এই লেখায়, যাতে করে আপনি-আমি-আমরা সবাই এই সময়টায় মানসিকভাবে যথাসম্ভব সুস্থ থেকে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারি।
১) যারা আগে থেকেই বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন এবং সেসবের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তাদের সেসবের চিকিৎসা কোনোভাবেই বন্ধ রাখা যাবে না। বরং নতুন কোনো উপসর্গ দেখা দিলে সেসবের ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে।
২) যদি মনে হয় টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নানা খবর আপনাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে, তাহলে সেসব থেকে যথাসম্ভব দূরে সরে আসুন।
৩) চারদিকে এখন গুজবের কোনো কমতি নেই। কিছুদিন আগেই আমাদের দেশে “থানকুনি পাতায় করোনাভাইরাস ধরবে না” এমন গুজবে মানুষজন গভীর রাতে দলে দলে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছিল থানকুনি পাতা খেতে। পরদিন সকালেই যা ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। তাই কোনো চমকে দেয়া খবর জেনে সাথে সাথেই সেটা যেমন বিশ্বাস করতে যাবেন না, তেমনই অন্যদের মাঝেও সেটা ছড়াতে যাবেন না। বরং স্রষ্টাপ্রদত্ত বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে সেসব খবরের সত্যাসত্য যাচাই করে এরপরেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
৪) মানুষজনের সাথে যোগাযোগের তেমন একটা সুযোগ স্বাভাবিক সময়ে পাওয়া যায় না। তখন পড়ালেখা আর কাজকর্মের পেছনেই চলে যায় সময়গুলো। এখন তাই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সাথে দরকারে ফোন কিংবা অনলাইনে আড্ডাও হয়ে যেতে পারে (অবশ্যই সশরীরে না!)। এই আড্ডার মুহূর্তগুলো আপনাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখবে। তাই আগামী বেশ কিছুদিন কোনদিন, কখন, কার সাথে আড্ডা দেবেন তার একটা তালিকা তৈরি করে সেটা শুরু করে দিতে পারেন।
৫) চাকরিজীবী বা শিক্ষার্থীরা এতদিন ধরে বেশ রুটিনমাফিক একটা জীবন চালিয়েছেন; সেটা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে যেভাবেই হোক না কেন। কিন্তু হুট করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং অনেক কোম্পানিই তার কর্মীদের সুরক্ষার্থে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নীতিতে চলে যাওয়ায় বদলে গিয়েছে সেই রুটিন। এজন্য এখন প্রত্যেকেরই উচিত হবে ব্যক্তিগত একেকটা রুটিন তৈরি করা। সেখানে এমন সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ও থাকতে পারে যার কথা হয়তো সাধারণভাবে মাথায় আসে না। কিন্তু তারপরও নিজেকে, নিজের মনকে ব্যস্ত রাখতে এখন এসব করতে হবে।
৬) এই রুটিন করতে গিয়ে পুরো দিনটাকেই কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ফেলতে হবে। এবং সেই একেক ভাগে একেক রকমের কাজ করতে হবে। দিনটাকে কয়েক ভাগে ভাগ করা ও সেই অনুযায়ী কাজ করার বিষয়টি পুরো সময়কে আরও সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করতে সাহায্য করবে।
৭) দৈনন্দিন রুটিনে বাধা জীবনযাপন করতে গিয়ে অনেকেরই শরীরের প্রতি তেমনে একটা যত্ন নেয়া হয়ে ওঠে না। এখন যদি আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সুবিধার কারণে বাসায় থাকার সুযোগ মেলে, তাহলে সেই সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন। সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করা, এবং অবশ্যই ঘরেই বিভিন্ন রকম শরীরচর্চার চেষ্টা করুন। সুস্থ দেহ আপনাকে সুস্থ মনের দিকে ধাবিত করবে।
৮) কেবলমাত্র শুয়ে-বসে ঘরে সময়টা না কাটিয়ে বিভিন্ন রকম সৃজনশীল কাজকর্মের মাধ্যমে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করুন। সেটা বই পড়া থেকে শুরু করে আপনার পছন্দের যেকোনো কিছুই হতে পারে। এ ধরনের সৃজনশীল কাজগুলো আপনাকে মানসিকভাবে সতেজ ও ফুরফুরে রাখবে নিশ্চিতভাবেই।
৯) শিক্ষার্থীরা এই সময়টায় শুধু সিনেমা-সিরিয়াল না দেখে বা গল্প-উপন্যাসের বই না পড়ে চাইলে বিভিন্ন রকম স্কিল ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর দিতে পারে। অনলাইনে আজকাল দেশী-বিদেশী অনেক প্লাটফর্মেই সফট স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে ঘরে বসেই বিশ্বমানের শিক্ষকদের সংস্পর্শে বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা সম্ভব। এই কাজটা করতে পারেন বিভিন্ন পেশাজীবীও। যেহেতু দৈনন্দিন যাতায়াতের সময়টা বেঁচে যাচ্ছে, তাই সে সময়টাই তারা এখানে কাজে লাগাতে পারেন। এ ধরনের ‘সেলফ ইনভেস্টমেন্ট’ শিক্ষার্থী-পেশাজীবী উভয় শ্রেণীর জন্যই বেশ কাজের জিনিস।
১০) আপনি হয়তো অনেক কিছুর পরিকল্পনাই করতে পারেন। কিন্তু সেগুলো আবার খুব দ্রুত সেরে ফেলতে যাবেন না যেন। যেহেতু এই সময়ে ঘর থেকে বাইরে না বেরোতেই পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, তাই ঘরে বসে কাজগুলো দ্রুত সেরে ফেললে পরবর্তী দিনগুলোতে অলস সময় কাটাতে কাটাতে বিরক্তি এসে যাওয়া অস্বাভাবিক না। তাই এদিকেও নজর দিতে হবে যেন দ্রুত বার্নআউট না হয়ে যায়।
১১) সবার শেষে, চারদিকে নেতিবাচক খবরের ভিড়ে খুঁজে বের করতে ইতিবাচক বিষয়গুলোকে। খুঁজে দেখতে চেষ্টা করুন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মানুষের আত্মত্যাগকে যারা এত খারাপ পরিস্থিতির ভেতরেও নিজেদের জীবন বাজি রেখে নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছেন। এই ভাল খবরগুলো আপনাকে আশার বাণী শোনাবে, জানাবে নতুন সূর্যের আগমনী বার্তার কথা।
মনে রাখবেন, আমরা এখন এমন এক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে এতদিন ধরে দেখে আসা স্বাভাবিক অনেক কিছুই আর স্বাভাবিক না; যেমন- পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে আগে আমরা হাত বাড়াতাম হ্যান্ডশেকের জন্য, বেশি আন্তরিক হলে তাকে জড়িয়েও ধরতাম। অথচ এখন আমাদের সেটাই করতে মানা করা হচ্ছে। আগে হয়তো আমরা হাত ধুলেও সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতাম না, অথচ এখন এটা নিয়েই আমাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আগে কেউ হাঁচি-কাশি দিলেও কেউ তেমন একটা গা করতো না, অথচ এখন কেউ হাঁচি-কাশি দিলেই সবাই চোখ বাঁকা করে তাকাচ্ছে, দ্রুত সেখান থেকে সরে যাচ্ছে। বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতিতে আমাদের মানসিক অবস্থারও যত্ন নিতে হবে আমাদেরই। তাই নিজে মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন, অন্যদেরও করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার উপায় জানিয়ে দিন।