প্রত্যেক নারীর জীবনে পরম আরাধ্য এক স্বপ্ন হলো মাতৃত্বের স্বাদ লাভ করা। সন্তান জন্মদানের মতো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও বিপজ্জনক একটি ব্যাপার থেকে তারা পিছপা হন না শুধুমাত্র সন্তানের মুখে মা ডাক শোনার ব্যাকুল আশায়। মাতৃত্বকালে একজন নারীর মনোদৈহিক জগতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। অনাগত সন্তানের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিতকরণই এই পরিবর্তনের প্রধানতম উদ্দেশ্য। গর্ভাবস্থায় একজন নারীর দেহে বিপাকীয় কার্যাদিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তা নিয়েই আমাদের আজকের লেখা।
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর দেহে হরমোনের ভারসাম্যে বড় রকমের পরিবর্তন আসে। স্তনবৃন্ত (Nipple), যোনিদ্বারের (Vulva) বর্ণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রগাঢ় হওয়া, পেটের কেন্দ্রীয় অংশ এবং নাভির চারপাশ স্ফীত হয়ে যাওয়া (Umbilicus increases) ইত্যাদি সব মায়ের ক্ষেত্রেই কমবেশি ঘটে থাকে। গর্ভাবস্থায় স্বাদ ও তৈল গ্রন্থিও অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক অধিক কার্যকর হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি হলো মায়ের দেহে বিপাক হার বৃদ্ধি পাওয়া। গর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা শিশুটির পুষ্টি, সুরক্ষা, বৃদ্ধি এসব কিছুর জন্য মায়ের দেহে বিপাক হার বৃদ্ধি পাওয়াটা আবশ্যক। এই সময়ে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে থাকা চাই যথেষ্ট পরিমাণে শর্করা, আমিষ ও স্নেহ জাতীয় খাদ্য। অধিকাংশ নারীর ওজন বৃদ্ধি হয় প্রায় ২৫ পাউন্ড পর্যন্ত; প্রথম ৩ মাসে ৩ পাউন্ড এবং পরবর্তী ৬ মাসে (দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমিস্টার) ১০ থেকে ১২ পাউন্ড করে। ভ্রূণ, অমরা, অ্যামনিওটিক ফ্লুয়িড, অতিরিক্ত পরিমাণ রক্ত, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত স্তন ও জরায়ু টিস্যু এই অতিরিক্ত ওজনের ২০ শতাংশের জন্য দায়ী থাকে। বাকি অংশটুকু জুড়ে থাকে মেদ ও অন্যান্য ফ্লুইড।
গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় ক্যালরি
অ্যাকাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিক্সের মতে, গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন একজন নারীর ২,২০০-২,৯০০ ক্যালরি গ্রহণ করা আবশ্যক। গর্ভকালে শুরুতে যদি একজন মা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন, তাহলে প্রথম ট্রাইমিস্টারে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টির জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমিস্টারে প্রতিদিন যথাক্রমে অতিরিক্ত ৩৪০ ও ৪৫০ ক্যালরি গ্রহণের দরকার পড়ে। গর্ভবতী নারীর প্রাথমিক ওজন যা-ই হোক না কেন, সময়ের সাথে সাথে তার ওজন অবশ্যই বাড়বে। তবে ওজন বৃদ্ধির বিষয়টি তার বডি মাস ইনডেক্সের (BMI) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া দরকার।
শিশুর পুষ্টির জন্য অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলাফল হিসেবে ওজন বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। তবে এর অর্থ এই নয় যে, একজন মা প্রতিদিন বেশি করে পিজ্জা, বার্গার খাবেন। বরং এ সময় মায়ের জন্য প্রয়োজন সুষম খাদ্যের। স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি ফলমূল, দুধ, শাকসবজি ইত্যাদি সহযোগে একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা দরকার।
গর্ভাবস্থায় শর্করা বিপাক
গর্ভাবস্থায় ইনসুলিন সেনসিটিভিটি কমে যায়। ফেটোপ্লাসেন্টাল গ্রোথের সাথে সাথে প্যানক্রিয়াটিক বিটা কোষের সংবেদনশীলতা পরিবর্তিত হয় এবং একই সাথে হিউম্যান কোরিওনিক সোমাটোম্যামোট্রপিন, প্রোজেস্টেরন, কর্টিসল, প্রোল্যাকটিন ইত্যাদি হরমোনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আরোপিত হলে ভোজনোত্তর সময়ে বিপাকীয় বস্তুর ঘনমাত্রায় ব্যপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বিপাকের মোড় ঘুরিয়ে দেয় শিশুর মঙ্গলের জন্য। মা খাদ্য গ্রহণের পর গ্লুকোজ, নিম্ন ঘনমাত্রার লিপোপ্রোটিন, অ্যামিনো অ্যাসিড ইত্যাদির বিপাক মায়ের দেহের প্রয়োজনে না হয়ে বেড়ে ওঠা বাচ্চার শরীরের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
অধিক শর্করার ব্যবহার
গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অক্সিজেন নির্ভর বিপাকে শর্করার অংশগ্রহণও বেড়ে যায়। রেসপিরেশন ক্যালোরিমেট্রির মাধ্যমে নির্ণীত হিসেবানুসারে, ২৪ ঘণ্টায় একজন গর্ভবতী নারীর দেহের রেসপিরেটোরি কোশেন্ট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। প্রসবোত্তর সময়ের তুলনায় প্রসবকালীন সময়ে একজন নারীর দেহে অধিক পরিমাণ শর্করা বিপাক সংঘটিত হয়। অপ্রোটিন খাদ্য উৎসের কথা বিবেচনা করলে গর্ভবতী নারীর দেহে শর্করা বিপাকের হার থাকে ৬৬%, যেটি প্রসবের ৬ মাস পর কমে হয় ৫৮%। গর্ভকালীন সময়ে প্রতিদিন শর্করা দহনের পরিমাণ হলো ২৮২ গ্রাম, যেটি প্রসবোত্তর সময়ের চেয়ে (দিনে ২১০ গ্রাম) অনেক বেশি।
জেসটেশনাল ডায়াবেটিস ম্যালিটাস
গর্ভকালীন সময়ের এই বিশেষ ডায়াবেটিস একটি হেটারোজেনাস ডিজঅর্ডার। এই সাময়িক ডায়াবেটিসের তীব্রতা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীর বয়স, জিনগত ইতিহাস, স্থূলতা ইত্যাদিও ভূমিকা পালন করে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জেসটেশনাল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের পরবর্তী সময়ে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ভোগার উচ্চ ঝুঁকি থাকে। জেসটেশনাল ডায়াবেটিসের প্যাথোফিজিওলজি অর্থাৎ রোগতাত্ত্বিক দিকটি এখনও বিতর্কিত।
প্রতিষ্ঠিত একটি কারণ হলো, সুস্থ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের মাঝে ইনসুলিন ক্ষরণের পরিমাণের পার্থক্য। গর্ভবতী নারীর ফাস্টিং প্লাজমা গ্লুকোজ লেভেল (না খেয়ে থাকা অবস্থায়) 126 mg/dL বা 7.0 mmoL/L এর চেয়ে বেশি হলে ধরে নেওয়া হয় তিনি জেসটেশনাল ডায়াবেটিসে ভুগছেন। আবার ক্যাজুয়াল গ্লুকোজ লেভেল (স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের পর) 200 mg/dL (11.1 mmoL/L) এর চেয়ে বেশি হলে তিনিও ডায়াবেটিসের রোগী বলে বিবেচিত হবেন। কিছু কিছু শর্ত পূরণ করলে সেসব ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীদের ডায়াবেটিস টেস্ট না করালেও সমস্যা হয় না। যেমন-
- বয়স ২৫ বছরের কম হলে
- সন্তান ধারণের আগে স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী হলে
- প্রাকৃতিকভাবেই এই রোগের হার কম এমন জাতির অন্তর্ভুক্ত হলে
- অস্বাভাবিক গ্লুকোজ টলারেন্সের কোনো ইতিহাস না থাকলে
- পূর্বে অস্বাভাবিক বা জটিল প্রসূতি বিষয়ক কোনো সমস্যা না থাকলে
গর্ভাবস্থায় স্নেহ বিপাক
সুস্থ ও স্বাভাবিক গর্ভধারণে সম্পূর্ণ ট্রাইগ্লিসারাইডের ঘনমাত্রা প্রায় ২-৪ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। সব মিলিয়ে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেতে পারে ২৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। স্টেরয়েড তৈরির জন্য অমরা ব্যবহার করে থাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কোলেস্টেরল। গর্ভবতী নারীর দেহে খাওয়ার রুচি, থার্মোজেনেসিস এবং স্নেহ বিপাক অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে লেপটিনের মাধ্যমে।
লেপটিনের মূল ভূমিকা এখন পর্যন্ত যথেষ্টই ধোঁয়াশাপূর্ণ। নিউরোপেপটাইড ওয়াই এর ক্ষরণ বাধাগ্রস্ত হয় লেপটিনের মাধ্যমে। নিউরোপেপটাইড ওয়াই একটি দক্ষ রুচিবর্ধক হিসেবে কাজ করে। লেপটিনের ভূমিকায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই গর্ভবতী মায়ের ক্ষুধা কমে যাওয়ার কথা, যেটি বাস্তবের চিত্রকে সমর্থন করে না। এই বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ধরে নেওয়া হয় অধিক পরিমাণে লেপটিন উপস্থিত থাকলে পরিণতিতে সেটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
গর্ভাবস্থায় আমাদের দেশে নারীদের সঠিক যত্ন না নেওয়ার ফলাফল সবসময় হাতেনাতে পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ক্যালসিয়াম বিপাকের কথা। গর্ভের শিশুর হাড় মজবুত করার জন্য একটা পর্যায়ে মায়ের দেহের ক্যালসিয়াম সন্তানের দেহে চলে যায়। এই বিপুল পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের ঘাটতি পূরণের জন্য যে ধরনের সুষম খাদ্য দরকার তা বেশিরভাগ নারীই পান না। এর ফল পাওয়া যায় মোটামুটিভাবে বয়স যখন ৪০ পেরোয়।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে, রিকশায় উঠতে, হাঁটু ভেঙে কাজ করতে অথবা কোমরের ব্যথার কারণে এ সময় মায়েদের চলাফেরায় কতটা বেগ পেতে হয়। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজ থেকেই সচেতন হোন। নিজের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা সকলে যে বয়সেরই হোক না কেন, একটি সঠিক খাদ্যাভ্যাস যেন তাদেরকে সুস্থ সবল রাখতে পারে সেই বিষয়ে সচেষ্ট হয়ে উঠুন এখন থেকেই।
ফিচার ইমেজ: shutterstock.com