মানব ইতিহাসে এক ম্যালেরিয়া যত মানুষকে মেরেছে, যুদ্ধ আর প্লেগ মিলেও তত মানুষ মারতে পারেনি। এমনকি গ্রিস ও রোমের পতনের পেছনেও অনেক ইতিহাসবিদ ম্যালেরিয়ার হাত খুঁজে পান। আফ্রিকাকে ‘সাদা মানুষের গোরস্তান’ বানিয়েছিল এই রোগটিই।
সতেরো শতাব্দীতে, পেরুর স্থানীয়দের উপর রাজত্ব করেছিল স্পেনিয়ার্ডরা। এই স্থানীয়রা ছিল ইনকাদের বংশধর। কোনো দিক থেকেই দুই জাতির মিল ছিল না বলা চলে। কিন্তু এই শাসক ও শাসিতদের মাঝে একটি বিষয়ে মিল ছিল- ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো উভয়েই।
১৬৩০ সালের দিকে দারুণ সব খবর নিয়ে স্পেনে ফিরে আসে জেসুইট মিশনারিরা। আন্দিজে যে সিনকোনা (Cinchona) গাছ পাওয়া যায়, তার ছাল থেকে বানানো ওষুধ নাকি ম্যালেরিয়াকে দমিয়ে রাখতে পারে! আরো আগে থেকেই অবশ্য রেড ইন্ডিয়ানরা এই ছাল ব্যবহার করত ওষুধ হিসেবে। সেই ইতিহাসও বেশ মজার। কথিত আছে, জাগুয়াররা জ্বরে আক্রান্ত হলে চাবাতো এই ছাল। ওদেরকে দেখেই ওষুধ হিসেবে একে ব্যবহার করার কথা মাথায় আসে রেড ইণ্ডিয়ানদের।
আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রথম যে ইউরোপিয়ান লোক এই প্রতিষেধক খুঁজে পায়, তিনি ছিলেন স্পেনের এক যোদ্ধা। পেরুর বুনো জঙ্গলে ঘুরতে ঘরতে আচমকা আক্রান্ত হয়ে বসেন ম্যালেরিয়ায়। সে যুগে সম্ভবত ভাতৃত্ববোধ তেমন বেশি ছিল না। তার সঙ্গীরা মরার জন্য তাকে ফেলে যায় সেখানে। এরপর কোনোএকভাবে তেতো একটা জলাশয়ের কাছে গিয়ে পানি পান করেন। পরেরদিন সকালে দেখা যায় তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকে সঙ্গীদের কাছে ফিরে গেলে অবাক হয় তারাও। সবাই মিলে সেই ডোবার কাছে ফিরে এসে দেখে, পানিতে ভাসছে সিনকোনা গাছের ডাল।
অবশ্য এমন একটা গল্প চালু আছে রেড ইণ্ডিয়ানদের নিয়েও। এই গল্পে জ্বরে আক্রান্ত এক ইণ্ডিয়ান জঙ্গলে ঘোরার সময় আচ্ছন্ন অবস্থায় পান করে ফেলে তেতো পানি। ভয় পেয়ে যান তিনি, ভাবতে থাকেন, বিষমিশ্রিত পানি পান করে ফেলল কিনা। কিন্তু পরের দিন দেখা যায়, জ্বর পুরোপুরি সেরে গেছে তার। গ্রামবাসীদের কাছে এই গল্প শোনালে সবাই মিলে এসে দেখে সেই ডোবার চারপাশে সিনকোনা গাছ। তারপর থেকে সেই গাছের ছাল ব্যবহৃত হতে থাকে ওষুধ হিসেবে।
তবে ইন্ডিয়ানদের এই ওষুধ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে না চাইলেও, তাদের দেওয়া নাম কিন্তু ঠিক গ্রহণ করেছে ইউরোপীয়রা। গাছটাকে ইণ্ডিয়ানরা ডাকত কুইনা-কুইনা বলে, যার অর্থ- ছালের ছাল। সেখান থেকেই এসেছে ‘কুইনিন’।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই আবিষ্কারকে অনন্য বলা যেতেই পারে। কেননা এর আগে বিশেষ কোনো রোগের জন্য, নির্দিষ্টভাবে কোনো ওষুধ ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। বলতে গেলে, সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহারের পথ খুলে দেয় এই কুইনিন।
অবশ্য নামকরণের ইতিহাসেও দ্বিমত আছে। প্রখ্যাত সুইডিশ জীববিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস, গাছটির নামকরণ করেন সিনকোনা অঞ্চলের কাউন্টেসের নামে। তিনি ছিলেন পেরুতে পাঠানো স্প্যানিশ রাজার প্রতিনিধির স্ত্রী। তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন এই রোগে, সুস্থ হবার পর আর দ্বিধা করেননি। গরীবদের মাঝে এটি পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেন। একসময় নিয়ে এলেন ইউরোপে। তিনি কাপে করে এক পেরুভিয়ান অসুস্থ রোগীকে ওষুধ দিচ্ছেন, এমন ফ্রেসকোও আছে একটা।
তবে দ্বিতীয় গল্পের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। সিনকোনার প্রথম কাউন্টেস স্পেন ছাড়ার আগেই মারা যান, দ্বিতীয় জন কখনো ফিরে আসেননি।
সে যাই হোক, অসাধারণ এই আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি খুব একটা। তখন জেসুইট যাজক বাদে আর কেউ কুইনিন আনা নেওয়া করতেন না বলে মানুষ একে ‘জেসুইটের ছাল’ বা ‘জেসুইটের গুঁড়ো’ বলেও ডাকতে শুরু করে।
তবে চিকিৎসকদের অনেকেই এই ওষুধ ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানান। ১৬৪৯ সালে জেসুইট গবেষক, কার্ডিনাল জন ডি লুগো উঠেপড়ে লাগেন এই ওষুধকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্য। তিনি নিজেও ছিলেন ম্যালেরিয়ার রোগী। তার প্রচেষ্টায় লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে কুইনিনের অসাধারণত্বের গল্প।
এরপর ১৬৫২ সালে, অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক এই ছাল ব্যবহার করে নিজে সুস্থ হন। কিন্তু মাত্র একমাস পর আবার আক্রান্ত হলে, উল্টো ক্ষেপে যান। ডি লুগো বলতেন, বার বার খেতে হবে কুইনিন। কিন্তু আর্চডিউকের চিকিৎসক, জ্যাকব শিফলে, একাধিকবার কুইনিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেননি। ফলশ্রুতিতে মারা যান আর্চডিউক। তবে মৃত্যুর আগে কুইনিনের বিফলতার কথা সবাইকে জানাতে নির্দেশ দেন তিনি। শিফলের বই- ‘দ্য এক্সপোজার অব দ্য ফেব্রিফিউজ পাউডার ফ্রম দ্য আমেরিকান ওয়ার্ল্ড– কুইনিনের বিরুদ্ধাচরণকারী ডাক্তারদের মনকে আরো শক্ত করে তোলে।
১৬৫৪ সনে কুইনিন এসে পৌঁছে ইংল্যান্ড। সেই সময় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এত বেশি ছিল যে লন্ডনকে বড়সড় একটা হাসপাতাল বললে ভুল হবে না। এই সময় ফায়দা লোটেন রবার্ট ট্যালবর নামের এক ব্যক্তি। ওষুধ-প্রস্তুতকারীর ফরমায়েশ খাটার কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু জ্ঞান ছিল তার। সেই জ্ঞান এবং কুইনিনকে পুঁজি করে তিনি চলে যান এসেক্স-এ। সেখানে ম্যালেরিয়ার মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল চরম হারে। মূলধারার সব ডাক্তারের বিরুদ্ধাচরণ করে তিনি বনে যান বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বিকল্প ধারার চিকিৎসকে।
তার সফলতার কথা দ্রুতই চলে যায় রয়েল কলেজের চিকিৎসকদের কানে। “তা আবার হয় নাকি?” বলে হেসেই উড়িয়ে দেন তারা। যেখানে লন্ডনের সেরা ডাক্তাররা হার মানছেন, সেখানে এই হাতুড়ে আবার কী পারবে?
অচিরেই লণ্ডনের বুকে আস্তানা গাড়লেন ট্যালবর। রোগী হিসেবে পেয়ে গেলেন একগাদা সম্ভ্রান্ত পরিবারকে। কিন্তু কাউকে নিজের ওষুধের স্বরূপ জানাতে অস্বীকৃতি জানালেন। কেবল বললেন, “চারখানা গাছগাছালি ব্যবহার করে বানাই আমার ওষুধ। তার মধ্যে দুটো স্থানীয়, আর দুটো বিদেশি।” যখন রাজা দ্বিতীয় চার্লস আক্রান্ত হলেন ম্যালেরিয়ায়, তখন ডাক পড়ল ট্যালবরের। রোগের প্রতিকার করতে সক্ষম হলেন ভদ্রলোক, বিনিময়ে পেলেন নাইটহুড।
খোদ রাজা যখন পক্ষে, তখন কে আর কী করতে পারে? মূলধারার ডাক্তারদেরকে সাবধান করে দিলেন রাজা। জানিয়ে দিলেন, ট্যালবরকে বিরক্ত করা হলে তা তিনি সহ্য করবেন না। তবে প্রটেস্টান্টদের বদ্ধমূল ধারণা, জেসুইটরা তাদের রাজাকে বিষ প্রয়োগ করছে। তাই প্রায়শই লাগতে শুরু করল গোলমাল।
এরইমধ্যে ফ্রেঞ্চ রাজার উত্তরাধিকার, পরবর্তীতে যিনি চতুর্দশ লুই নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন, আক্রান্ত হলেন ম্যালেরিয়ায়। ডাক পড়ল ট্যালবরের। ফ্রেঞ্চ ডাক্তাররা বাগে পেয়েছি এমন ভাব করে তার কাছে জানতে চাইলেন, “জ্বর কী?”
“তা আমি জানি না। আপনারা হয়তো জ্বরের সংজ্ঞা জানেন, যা আমার জানা নেই। কিন্তু আমি জানি তার প্রতিকার, যা আপনাদের জানা নেই!”
ট্যালবরকে প্রস্তাব দেওয়া হলো, তার এই প্রাণদায়ী ওষুধের ফর্মুলা জানাতে। রাজি হলেন না ভদ্রলোক। রাজা চতুর্দশ লুই তখন জানালেন, ফর্মুলাটা লিখে দিলে সেই কাগজকে সীলবন্ধ খামে রাখা হবে। ট্যালবরের মৃত্যুর আগে তা খোলা হবে না।
এবার রাজি হলেন প্রখ্যাত ‘জ্বর-বিশেষজ্ঞ’। তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং আজীবন মাসহারা নিয়ে ফিরে এলেন ইংল্যাণ্ড। লিখে দিলেন তার ওষুধের ফর্মুলা। ট্যালবর মারা গেলে খোলা হলো সেই খাম। অবাক বিস্ময়ে সারা বিশ্ব দেখল তার উপকরণগুলো: গোলাপজল, লেবুর শরবত, …এবং জেসুইটের গুঁড়ো!
সতেরো শতকের শেষ দিকে দেখা গেল, নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে জাহাজের পর জাহাজ ভর্তি করে কুইনিন পাঠানো হচ্ছে ইউরোপে। বিকোচ্ছে সোনার দামে। ১৮২০ সালে এসে ফরাসী রসায়নবিদ পিয়েরে পেলটিয়ার এবং জোসেফ ক্যাভেনটু সিনকোনা গাছের ছাল থেকে বের করেন কুইনিন। সারা বিশ্ব যেন উপকার পায়, এই মানসে সেই পদ্ধতির পেটেন্ট নেননি তারা।
কিন্তু আফসোসের কথা হলো, কুইনিনকে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে তখনো পাইনি এখনো পাই না। কেন? কারণ আজও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষ। তার বিপরীতে সিনকোনা গাছের প্রাপ্তবয়স্ক হতে লাগে প্রায় দশ বছর। আরো একটি কারণ হলো, সিনকোনা গাছের ৪০টি প্রজাতির মাঝে মাত্র এক ডজনের মতো প্রজাতির আছে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকারী হবার ক্ষমতা।
যার ফলে বিজ্ঞানীদের মনোযোগ ধাবিত হয় কৃত্রিম কুইনিন কিংবা ম্যালেরিয়ার অন্য কোনো ওষুধ আবিষ্কারের দিকে। ১৯৪৪ সনে দুজন আমেরিকান বিজ্ঞানী অবশেষে সক্ষম হন কৃত্রিম কুইনিন তৈরিতে। কিন্তু সেগুলোর খরচ এত বেশি হয়ে যায় যে তা সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ম্যালেরিয়ার ওষুধ হচ্ছে আর্টেমিসিন। বিশেষ করে যে ম্যালেরিয়ার পরজীবী মারতে খোদ কুইনিনও ব্যর্থ, সেখানে দারুণ কাজ করে এই আর্টেমিসিন। দুশ্চিন্তা কথা হলো: বর্তমানে মায়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যাণ্ড, চিন এবং কম্বোডিয়ায় পাওয়া গিয়েছে আর্টেমিসিন কাজ করে না, এমন ম্যালেরিয়া পরজীবীর অস্তিত্ব!
আজও বিশ্বে প্রতিবছর ২১৯ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয় ম্যালেরিয়ায়, ঝরে যায় প্রায় সাড়ে চার লক্ষ প্রাণ। কে জানে, ম্যালেরিয়া নামের এই অভিশাপকে কোনদিন চিরতরে দূর করা সম্ভব হবে কিনা। তবুও চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়ে যায়। পরিবর্তন আসে অনেক কিছুর, সমাধান হয় অনেক সমস্যার।