ডিসলেক্সিয়া: পড়াশোনার জগতে এক বিভীষিকার নাম

প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চারা পড়াশোনায় খুব অমনোযোগী হয়। এজন্য স্কুল বা বাবামায়ের কাছ থেকে অভিযোগের শেষ নেই। বাচ্চা বলছে সে পড়তেই পারছে না। সবাই মনে করছে এ নিশ্চয়ই ফাঁকি দেবার অজুহাত? কিন্তু তা না-ও হতে পারে। এমন এক রোগ রয়েছে, যাতে কোনো লেখা পড়তে, বানান করতে সমস্যা হয়। এই নির্দিষ্ট শিক্ষণগত সমস্যাটিকে বলা হয় ডিসলেক্সিয়া। এক্ষেত্রে লেখা পড়তে সমস্যা হয় বলে কোনোকিছু পড়ার পর তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শিশু উত্তর দিতে পারে না। এটি জীবনব্যাপী একটি ভোগান্তির নাম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এতে আক্রান্ত ব্যক্তি কম বুদ্ধিসম্পন্ন বা সমবয়সী কারো চেয়ে কম মেধা রাখে। বহু বিখ্যাত এবং সফল ব্যক্তিও ডিসলেক্সিক ছিলেন। এটি ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে।

ডিসলেক্সিকদের মস্তিষ্ক শব্দের বিন্যাস ধরতে পারে না; Source: medium,com

কীভাবে বুঝবেন?

এক্ষেত্রে বাচ্চারা দেখা যায় পড়াশোনা এড়িয়ে চলছে। এছাড়াও এই সমস্যাটি থাকলে দেখা যায় যে বাচ্চারা সবকিছু দেরিতে শিখছে, যেমন কথা বলা, হামাগুড়ি দেওয়া, হাঁটা ইত্যাদি। বাম-ডান গুলিয়ে ফেলা, কোনো সংখ্যা বা অক্ষর উল্টো করে লেখা (যেমন ইংরেজি ‘b’কে ‘d’ লেখা বা ইংরেজি ‘6’কে ‘9’ লেখা) ইত্যাদি দিকভ্রান্তির ব্যাপারটিও দেখা যায়। বাক্য বা শব্দের ধ্বনিগত বিষয় তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। একটি শব্দে যদি দুটোর বেশি অংশ থাকে, তবে পুরো শব্দটি বলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ডিসলেক্সিয়ার ক্ষেত্রে লিখিত নির্দেশনার চেয়ে মৌখিক নির্দেশনা অধিক ফলপ্রসূ হয়। তবে বিভিন্ন সৃজনশীল ক্ষেত্রে ডিসলেক্সদের দক্ষতা দেখা যায়।

দিকভ্রান্তি ঘটে ডিসলেক্সিয়ায়; Source: wikihow.com

কোনোকিছুত মনোযোগ ধরে রাখা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে, কারণ কিছু সময় দিক ও বিন্যাসের মতো সাধারণ ব্যাপারে যুঝবার পর আর মনোযোগ ধরে রাখবার মতো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। বয়স্ক ডিসলেক্সিকদের ব্যাপারেও এটি প্রযোজ্য। ডিসলেক্সিকরা যখন কোনো ধারণা বা মতামত প্রকাশ করতে যায়, তখন অনেক বেশি অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। কোনো বিষয়ের কোন অংশটি আগে বলতে হবে বা কোনটি পরে, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই এই অযৌক্তিকতা ও ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি। ডিসলেক্সিয়া একটি সম্পূর্ণ স্নায়বিক অবস্থা হলেও এর সাথে অন্যান্য শারীরিক অবস্থাও সম্পর্কযুক্ত। দেখা গেছে, ডিসলেক্সিকদের জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সহ অন্যান্য অ্যালার্জিজনিত রোগ জলদি সারতে চায় না। অর্থাৎ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।

এ থেকে জন্ম নিতে পারে হতাশা; Source: myspecialchildonline.com

কারণ            

বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা এর আসল কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, বংশপরম্পরায় এ সমস্যা হতে পারে। পরিবারে আগের কারো এ সমস্যা থাকলে এটি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইয়েল স্কুল অব মেডিসিনের একটি দল খুঁজে বের করেছেন যে, DCDC2 নামে একটি জিনগত অবস্থার কারণে পড়তে সমস্যা হয়। তবে এটি পুরোপুরি জিনগত উদ্ভব নয়, অর্জিত ডিসলেক্সিয়াও রয়েছে। মস্তিষ্কে চিত্র বা প্রতীক বোঝার প্রক্রিয়ায় সমস্যার কারণে ডিসলেক্সিয়ার উদ্ভব। তাই মস্তিষ্কে কোনোপ্রকার আঘাত বা স্ট্রোক হলে বা গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো দুর্ঘটনার দরুন মস্তিষ্কে আঘাত পেলে এই সমস্যাটির জন্ম হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান হেলথ সিস্টেমের মতে, যেসব ছাত্রের পড়তে অসুবিধা হয়, তাদের মধ্যে ৮০% এর ডিসলেক্সিয়া রয়েছে এবং পড়াশোনার সাথে সম্পর্কিত সবচেয়ে সাধারণ অক্ষমতা এটি। যুক্তরাজ্যের প্রতি ১০ থেকে ২০ জন ব্যক্তির একজনের এই সমস্যাটি রয়েছে।

বয়সভেদে ডিসলেক্সিয়া      

ডিসলেক্সিয়া প্রায় সব বয়সের মানুষেরই থাকতে পারে, তবে বয়সভেদে এর রয়েছে বিভিন্নতা। যেমন স্কুলের যাবার আগে ডিসলেক্সিয়ার ধরন স্কুলে যাবার পরের ধরন থেকে ভিন্ন এবং এর লক্ষণগুলোও এক নয়।

স্কুল পূর্ববর্তী লক্ষণ

  • শিশুর কথা বলা শিখতে দেরি হওয়া
  • শব্দ গঠন ও শিক্ষায় সমস্যা
  • একইরকম শুনতে এমন শব্দ গুলিয়ে ফেলা
  • রং বা দিক চিনতে ভুল করা

শব্দ বা সংখ্যার জগত যেন ভয়ংকর রূপ নিয়ে আছে; Source: kritinis.com

স্কুলে ভর্তি হবার পর

  • যেকোনো প্রকার তথ্য বুঝতে সমস্যা
  • সমবয়সীদের চাইতে পিছিয়ে পড়া
  • কোনো তথ্য মনে রাখতে না পারা
  • কিছু পড়তে বা লিখতে দিলে অস্বাভাবিক বেশি সময় নেওয়া
  • পড়াশোনা সম্পর্কিত বিষয় এড়িয়ে চলা
  • পড়ার সময় শব্দ বা অক্ষরেরা নেচে বেড়াচ্ছে, এমন অভিযোগ আসা
  • হাতের লেখা খারাপ হওয়া
  • নতুন কোনো সমন্বিত শব্দ শুনে তাকে চেনা শব্দের সাথে মেলাতে না পারা। ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি নতুন হলেও সাধারণত শিশুরা সেটিকে ভেঙে ‘বিশ্ব’ ও ‘বিদ্যালয়’ এ পরিণত করে সেগুলোর সাথে অর্থ মেলাতে চাইবে। কিন্তু ডিসলেক্সিকরা তা করে না।

ডিসলেক্সিক শিশুরা সমবয়সীদের চাইতে পিছিয়ে পড়ে; Source: readingrockets.org

কৈশোর ও তার পরবর্তী সময়

  • জোরে জোরে পড়তে সমস্যা
  • পড়তে বা লিখতে অনেক সময় ও চেষ্টা প্রয়োজন হয়। ক্লাসে সময়মতো নোট নিতে না পারা বা দেখে দেখে লিখতে সমস্যা হওয়া।
  • উচ্চারণে ভুল হওয়া
  • বানান ভুল করা
  • কৌতুক বা প্রবাদ-প্রবচন বুঝতে না পারা বা বা বুঝতে অনেক সময় নেওয়া
  • কোনো গল্পের মূলকথা বুঝতে সমস্যা হওয়া
  • অংকে ভয় পাওয়া (তবে অংকের জন্য আলাদা একটি টার্ম আছে, ডিসক্যালকুলিয়া)
  • বিদেশি ভাষা শিক্ষায় অনীহা
  • কোনো বিষয়ে ভালো জ্ঞান থাকার পরও তা লিখে ভালো করে প্রকাশ করতে না পারা
  • সময়মতো কোনো কাজ শেষ করতে না পারা, বারবার ডেডলাইন মিস করা।

ডিসলেক্সিয়ার প্রকারভেদ

এর কোনো অনুমোদিত প্রকারভেদ নেই, তবে একে বেশ কিছু উপ-শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন,

  • অডিটরি ডিসলেক্সিয়া: একে ধ্বনিগত ডিসলেক্সিয়াও বলা হয়। শব্দ বিশ্লেষণ করে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে সমস্যা হয় এরূপ ডিসলেক্সিয়ায়। লিখিত রূপের সাথে কথ্য রূপকে মেলানোটা অনেক বেশি দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে এক্ষেত্রে।
  • দর্শনগত ডিসলেক্সিয়া: কোনোকিছু দেখে চিনতে না পারা বা এর নাম মনে না আসা। কখনো কখনো একে সারফেইস ডিসলেক্সিয়াও বলা হয়ে থাকে।
  • নামগত ডিসলেক্সিয়া: কোনো বর্ণ বা শব্দ একনজরে দেখে বলতে না পারা, যদিও তা আগের চেনা।

‘তারে জামিন পার’ সিনেমার দৃশ্য; Source: truechristianity.com

মুক্তির উপায় কি নেই?

অবশ্যই আছে। তবে এজন্য ব্যক্তি ও ক্ষেত্রভেদে ভিন্ন সমাধান। সঠিক শিক্ষণপদ্ধতির মাধ্যমে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক- সবাইকেই ভালো করে পড়তে ও লিখতে শেখানো যাবে। বলিউডে আমির খান অভিনীত ‘তারে জামিন পার’ সিনেমাটিতে এই সমস্যার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। সেখানে বেশ ফলপ্রসূ কিছু সমাধানের কথা বাতলে দেওয়া হয়েছে। যেমন একইসাথে শ্রবণোদ্দীপনার মাধ্যমে পড়া, যাতে করে ডিসলেক্সিক ব্যক্তি কী পড়ছে, তা কানেও শুনতে পায় এবং এটি বারবার করার পর শব্দগুলো তার কাছে আর অপরিচিত লাগে না। এই অনুশীলন চালু রাখার মাধ্যমে সমস্যাটি থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসা সম্ভব।

এছাড়া প্রতিটি অক্ষর ও সংখ্যা বড় বড় করে একটি বর্গাকার ক্ষেত্রের মধ্যে বারবার লেখানো, যাতে করে তার কাছে এর আকৃতি ধরতে পারা সহজ হয়, অস্পষ্টতা কেটে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং বাবা-মায়ের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শিক্ষণ প্রক্রিয়া তাদের দ্বারাই মূলত পরিচালিত হয়। তারা ডিসলেক্সিয়া সম্পর্কে সকল প্রকার অনুসন্ধান করে এর লক্ষণ, কারণ সচেতন হয়ে উপযুক্ত শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগ করলে এই সমস্যা ধীরে ধীরে কেটে যাবে। আর প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং নিজের সবচেয়ে ভালো দক্ষতা বের করে আনতে হবে। এভাবেই ডিসলেক্সিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ফিচার ইমেজ: medicalleader.org

Related Articles

Exit mobile version