চীনের উহান শহরে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থামছেই না। ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ হাজারেরও বেশি। চীনে মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪২৫। চীনের বাইরেও এই ভাইরাসের কারণে দুজনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই বলা যায়, চীনে এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাসকে করোনা ভাইরাস বলা হলেও এর দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাসের নাম বোঝায় না। করোনা ভাইরাস দিয়ে একগুচ্ছ ভাইরাসকে বোঝানো হয়, যাদের মাঝে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে করোনা বা মুকুটের মতো স্পাইক দেখা যায়। এজন্য এদের করোনা ভাইরাস বলা হয়।
করোনা ভাইরাস সাধারণত প্রাণীদেহে সংক্রমণ করে। কিন্তু সাত ধরনের করোনা ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমণ করে। এদের মাঝে আছে ২০০২ সালে চীনেই আক্রমণ করা সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরী সিনড্রম বা সার্স করোনা ভাইরাস, ২০১২ সালে সৌদি আরবে আক্রমণ করা মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরী সিনড্রম বা মার্স করোনা ভাইরাস এবং উহান শহর থেকে বিস্তার লাভ করা নতুন করোনা ভাইরাস।
নতুন করোনা ভাইরাসের সার্স বা মার্সের মতো কোনো নাম দেয়া হয়নি এখনো। ল্যানসেট এবং দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে এই ভাইরাসকে নভেল করোনা ভাইরাস ২০১৯ বা ‘2019-nCoV’ নামে পরিচয় করানো হয়েছে। নভেল দিয়ে নতুন করোনা ভাইরাস বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এই নাম আদর্শ কোনো নাম নয়। কারণ এটি সাধারণ মানুষের জন্য সহজে উচ্চারণযোগ্য নয়। তাছাড়া এটি সবসময় নতুন থাকবে না। কারণ, ভবিষ্যতে আরো করোনা ভাইরাস আবিষ্কৃত হতে পারে। আবার এর নামে ২০১৯ থাকলেও এর সংক্রমণের সংখ্যা ২০২০ সালেই ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে।
মূলধারার সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভাইরাসকে চাইনিজ ভাইরাস, উহান ফ্লু, উহান নিউমোনিয়া, করোনা ভাইরাস ইত্যাদি নামে ডাকা হচ্ছে। কিন্তু এসব নাম সংক্রামক ব্যধির নামকরণের আন্তর্জাতিক নীতিমালার পরিপন্থী। কারণ, একটি রোগের নামকরণ অনেক সরল ব্যাপার মনে হলেও এর প্রভাব ব্যাপক। অপরিকল্পিত নামকরণের কারণে একটি দেশ বা অঞ্চলের সংস্কৃতি, বাণিজ্য, সামাজিক ব্যবস্থা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সংক্রামক ব্যধির নামকরণের প্রভাব বা গুরুত্ব কতটুক তা হয়তো সিংহভাগ মানুষেরই অজানা।
রোগ নামকরণের ইতিহাস
ঐতিহাসিকভাবে রোগ বা রোগের জীবাণুর নামকরণ করা হতো আবিষ্কারক বিজ্ঞানীর নামানুসারে। ১৮৯৪ সালে প্লেগ রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া Yersinia pestis এর নামকরণ করা হয় এর আবিষ্কারক আলেক্সান্দ্রে ইয়েরসিনের নামে। ১৮৮৫ সালে থিওডোর ইশেরিখ নিজের নামে ইশেরিখিয়া কোলাই বা ই কোলাই ব্যাকটেরিয়ার নাম রাখেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে নিজের নামে রোগ বা জীবাণুর নাম রাখা বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল খুবই গর্বের বিষয়। এটি তাদের সাফল্য নির্দেশ করতো। কিন্তু এখন সংক্রামক ব্যধির নাম কোনো ব্যক্তির নামে রাখা নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় কোনো ব্যক্তি বা স্থানের নামে রোগজীবাণুর নাম দেয়া হলে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
নামকরণের কারণে সৃষ্ট যত জটিলতা
উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীতে রোগের নামকরণে ভৌগলিক অবস্থানের নাম নিয়মিতভাবেই ব্যবহার করা হতো। যেমন- স্পেনিশ ফ্লু বা ক্রিমিয়ান কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার। কিন্তু বর্তমানে তা করা হয় না। কারণ, এসব ভৌগলিক স্থানের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নির্দিষ্ট প্রাণীর নামে নামকরণ করা হলেও একই প্রতিক্রিয়া হয়। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটলে মিশরে সব শূকর নির্মূল করে ফেলা হয়। শূকর বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ এই ভাইরাস প্রকৃতপক্ষে শূকরের মাধ্যমে ছড়ায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পর্ক বোর্ডও এই নাম নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল।
সার্স ভাইরাসের নামকরণ নিয়েও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। হংকং এর প্রশাসনিক নাম স্পেশাল এডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিওন বা এসএআর। সার্স ভাইরাসের প্রথম তিন অক্ষরে এসএআর থাকায় সাধারণ মানুষ মনে করতে থাকে ভাইরাসটি হংকং থেকে এসেছে। এ কারণে হংকংকে চড়া মূল্য দিতে হয়।
২০১২ সালে উট থেকে সৌদি আরবে যখন মার্স ভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তখন এর নামকরণ নিয়ে রীতিমতো কলহের সৃষ্টি হয়েছিল। এই ভাইরাস প্রথমে শনাক্ত করা হয় নেদারল্যান্ডের রটারডামে ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনকার নতুন করোনা ভাইরাসের প্রথমে নাম দেয়া হয় হিউম্যান করোনা ভাইরাস ফ্রম দ্য কিংডম অব সৌদি আরব বা ‘HCoV-KSA1’।
সৌদি আরব এমনিতেই রাগান্বিত ছিল তাদের অনুমতি না নিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এক সৌদি রোগীর নমুনা ইরাসমাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার উপর নতুন ভাইরাসের নাম দেখে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। গবেষকদের পক্ষ থেকে ইরাসমাস মেডিকেল সেন্টারের নামানুসারে নতুন নাম প্রস্তাব দেয়া হয় ‘EMC1’। কিন্তু সৌদি আরব তাতেও সন্তুষ্ট ছিল না। তখন ইন্টারন্যাশনাল কমিটি, সৌদি আরব সরকার, ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন টেক্সনমি অব ভাইরাসেস বা আইসিটিভি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলোচনায় মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরী সিনড্রম ভাইরাস নাম রাখা হয়। কিন্তু এটি নিরপেক্ষ নাম হলেও একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তীতে সংক্রামক রোগের নামকরণের একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে।
নতুন করোনা ভাইরাসকে সাময়িকভাবে নিরপেক্ষ নাম ‘2019-nCoV’ দেয়া হলেও এই নাম জনসাধারণের কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু এর নামকরণ নিয়েও পূর্বের জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে নামকরণে সময় নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত কিছু নাম বাতিল করা হয়েছে। যেমন- সাউথ ইস্ট রেস্পিরেটরী সিনড্রম বা এসইআরএস এবং চাইনিজ একিউট রেস্পিরেটরী সিনড্রম বা সিএআরএস। কারণ, এসব নামকরণের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
নতুন সংক্রামক রোগ নামকরণের নীতিমালা
পূর্বে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সনমি অব ভাইরাসেস বা আইসিটিভি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে সংক্রামক রোগ বা এর জীবাণুর নামকরণ করতো। বর্তমানে তারা এটি করে থাকে ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত ‘বেস্ট প্র্যাক্টিস’ নীতিমালা অনুসরণ করে। এই নীতিমালা অনুসারে যেকোনো নতুন সংক্রামক রোগের নামের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে-
- যেকোনো নামের ক্ষেত্রে জেনেরিক টার্ম যোগ করা যেতে পারে। যেমন- রেস্পিরেটরী সিনড্রম, হেপাটাইটিস, নিউরোলজিক সিনড্রম ইত্যাদি। এটি সবচেয়ে উপযোগী যখন কোনো রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা না থাকে। এতে ওই রোগের নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হলেও মৌলিক জিনিস অপরিবর্তনীয় হওয়ায় জটিলতা কম হয়।
- যখন রোগ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা থাকে তখন নির্দিষ্ট বর্ণনামূলক টার্ম যোগ করা উচিত। যেমন- শিশুদের ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট রোগ দেখা গেলে এর সাথে জুভেনাইল যোগ করা, শীতকালীন সময়ে রোগ হলে উইনটার যোগ করা, রোগের তীব্রতা বেশি হলে সিভিয়ার যোগ করা।
- যদি রোগের নির্দিষ্ট জীবাণুর নাম জানা থাকে তাহলে রোগের নামের সাথে যোগ করতে হবে। যেমন- নভেল করোনা ভাইরাস রেস্পিরেটরী সিনড্রম।
- নাম হবে সংক্ষিপ্ত এবং সহজে উচ্চারণযোগ্য। যেমন- ম্যালেরিয়া, পোলিও।
- দীর্ঘ নামের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত রূপ বা অ্যাক্রোনিম ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- এইডস।
রোগ নামকরণে যেসব পন্থা অবলম্বন করা যাবে না-
- কোনো ভৌগলিক অবস্থানের নামে রোগের নাম দেয়া যাবে না। অর্থাৎ, কোনো রাষ্ট্র, শহর, অঞ্চল বা মহাদেশের নামে রোগের নাম রাখা যাবে না। যেমন- স্প্যানিশ ফ্লু, মার্স ভাইরাস।
- কোনো ব্যক্তির নামে রোগের নাম রাখা যাবে না।
- নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর প্রাণী বা খাবারের নামে রোগের নাম রাখা যাবে না।
- কোনো জনসংখ্যা, সংস্কৃতি, শিল্প বা পেশাকে নির্দেশ করে এমন নাম দেয়া যাবে না।
- আতঙ্কের সৃষ্টি করে এমন কোনো টার্ম যোগ করা যাবে না। যেমন- ডেথ বা মৃত্যু, ফ্যাটাল বা প্রাণনাশক, এপিডেমিক বা মহামারী ইত্যাদি।
এসব নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে যেন রোগের নামকরণের কারণে বাণিজ্য, ভ্রমণ, পর্যটন খাত, প্রাণী কল্যাণ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। এছাড়া এর মাধ্যমে কোনো সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আঞ্চলিক, পেশাগত গোষ্ঠীর কোনো অপমান যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হয়।
শেষকথা
বিশেষজ্ঞরা ভালো উদ্দেশ্যের জন্য সময় নিচ্ছেন। কিন্তু একইসাথে বিভিন্ন দেশের মিডিয়া একে বিভিন্ন নামে ডেকে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে। তাই দ্রুত একটি সঠিক ও নিরপেক্ষ নাম বেছে নেয়া জরুরি। ধারণা করা হচ্ছে, মে মাসে আইসিটিভির পরবর্তী সভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সাথে নিয়ে এর নামকরণ করা হবে।