যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে আপনি ঠিক কী কী করে থাকেন? কিংবা যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কাউকে বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত অবস্থায় দেখলে তখন আপনার ভূমিকা কী হয়? আপনি হয়তো তখন এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আপনার সাধ্যমতো এবং আন্তরিকভাবে কিছু একটা করেন। কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও নিজের অজান্তেই ছোটখাটো কোনো ভুল করে বসছেন না তো, যা হয়তো সমস্যাকে প্রশমিত করার বদলে আরো দীর্ঘস্থায়ী করে তুলবে?
প্রকৃতপক্ষে, বিষণ্ণতা মোকবেলায় সকলেরই কমবেশি প্রস্তুতি থাকা উচিত। বর্তমান যুগে মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন কাঠামো থেকে শুরু করে সকল ধরনের সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান, যেগুলো কোনো না কোনোভাবে মানুষের জীবনযাপনের সাথে জড়িত, সেগুলোর সাথে মানুষের আন্তঃক্রিয়া ও লেনদেনের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যান্ত্রিক সভ্যতার আধুনিক এ যুগ আমাদের কাজে এনেছে অবিরাম গতি। কিন্তু এ কৃত্রিমতার সাথে আমাদের প্রাকৃতিক ও সহজাত যেসব প্রবৃত্তিগুলো রয়েছে, সেগুলো এখনও পুরোপুরি খাপ খাইয়ে উঠতে পারেনি। তাই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ সফলতা অর্জন করেও একজন মানুষ তীব্র বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন।
বিষণ্ণতা আসলে কী
বিষণ্ণতাকে অনেকেই দুঃখ, রাগ, ক্রোধ বা আর দশটা সাধারণ মানবীয় অনুভূতির মতোই একটি বিশেষ অনুভূতি হিসেবে গণ্য করে থাকেন। তবে এটি বড় একটি ভুল; প্রকৃতপক্ষে বিষণ্ণতাকে একপ্রকার মানসিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করাটা যুক্তিসঙ্গত। আপনার বন্ধুদের মাঝে খুঁজলে হয়তো এমন কাউকে পাওয়া যাবে, যে কি না অল্পতেই মন খারাপ করে বসে বা রেগে যায়। আপনারা হয়তো এটা নিয়ে মজাও করে থাকেন। অথচ ভেবেও দেখেন না যে, এটা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়, এটি হয়তো বিষণ্ণতারই একটি লক্ষণ।
আবার একটি শিশু যদি কোনো কারণে বিষণ্নতায় ভোগে বা ভুগছে বলে মনে হয়, তাহলে দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে উপযুক্ত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে। কেননা, বিষণ্নতা শিশুদের মানসিক বিকাশকে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্থ করে।
আবার ঠিক তার উল্টো চিত্রও পরিলক্ষিত হয়। সাময়িক দুঃখ বা দুশ্চিন্তাকেও কেউ কেউ বিষণ্নতা বলে চালিয়ে দেন, যদিও এতে তেমন দোষের কিছু নেই। আপনি প্রায়ই পরীক্ষার আগে আপনার কোনো না কোনো বন্ধুকে বলতে শুনবেন, “প্রচন্ড ডিপ্রেশনে আছি।” যদিও এটা মোটেই ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা নয়; সে বিষণ্নতার অর্থ সঠিকভাবে জানে না বলেই হয়তো এটা বলছে। আবার পরীক্ষাটা যদি তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বা চাকরির ইন্টারভিউ হয়ে থাকে, সেটির উপর তার চাকরি পাওয়া-না পাওয়া নির্ভর করে, সেই সাথে তার চাকরির উপর তার পরিবার নির্ভর করে এবং কোনো কারণে সেই চাকরিটা তার না পাওয়ার আশংকা থাকে, তাহলে সে সত্যিই বিষণ্নতায় ভুগতে পারে। সেক্ষেত্রে এটাকে সহজ করে দেখা যাবে না।
তাহলে ঠিক কখন ও কীভাবে বুঝবেন যে, আপনি বা আপনার পরিচিত একজন মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে? এ বিষয়ে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো, বিষণ্নতা দুঃখ বা দুশ্চিন্তার মতো সাময়িক নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। এ সমস্যাটি সাধারণত অচিরেই গড়ে ওঠে না, আবার খুব দ্রুতই এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বিষণ্নতা একজন মানুষকে গ্রাস করলে এর স্পষ্ট কিছু লক্ষণ তার কাজকর্মে ফুটে ওঠে। সেগুলো দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, সে মানুষটি বিষণ্নতায় ভুগছে। বিষণ্নতার কিছু মারাত্মক লক্ষণ নিয়ে রোর বাংলার এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা চার ভাগের চেয়ে বেশি। তবে সংখ্যাটা অবশ্যই আরও বেশি হতে পারে। খেয়াল করুন, এটি কিন্তু দুঃখী মানুষের সংখ্যার হিসাব নয়; যারা অনবরত বিষণ্নতায় ভুগছেন এবং বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে লড়াই করে যাচ্ছেন, তাদের হিসাব। অর্থাৎ, আপনার আশেপাশের প্রতি পঁচিশজন মানুষের মধ্যে অন্তত একজনকে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যে কি না বিষণ্নতায় ভুগছে। এখন একটু গুণে দেখুন তো, আপনার পরিচিত মানুষের সংখ্যা কতজন হতে পারে? এবং তাদের মধ্যে কতজনকেই আপনার কাছে বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন বলে মনে হয়?
কী করবেন বিষণ্নতায় ভুগলে
নানাবিধ কারণে একজন মানুষ বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন। যখনই বুঝতে পারবেন আপনি বিষণ্নতায় ভুগছেন, দেরি না করে তা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হোন। জেনে নিন বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে আপনার কী কী করা উচিত, আর কী কী করা উচিত নয়।
যা যা করবেন
১. বিষণ্নতার কারণ শনাক্ত করুন: এ কাজটাই আপনার সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিষণ্নতায় ভোগা মানুষগুলোর মধ্যে অধিকাংশই জানেন না যে, ঠিক কী কারণে তারা বিষণ্নতায় ভুগছেন কিংবা বিষণ্নতার যথাযথ কারণ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। আপনি যদি এর সঠিক কারণই বের করতে না পারেন, তাহলে এর সমাধান কিছুতেই মিলবে না। ওষুধ দেওয়ার আগে জানতে হয়, সমস্যাটা ঠিক কোথায়। বিষণ্নতার কারণ বের করতে পারলে খুব সম্ভবত চিকিৎসকের সহায়তা ছাড়া আপনি নিজেই এর থেকে মুক্তির উপায় বের করে ফেলতে পারবেন।
২. দ্বন্দ্ব নিরসন: যদি মনে আপনার সাথে কারো কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব রয়েছে কিংবা যদি মনে হয় আপনি কারো সাথে কোনোরূপ খারাপ আচরণ করেছেন, এবং সেটার কারণেই আপনার মধ্যে বিষণ্নতা ভর করেছে, তাহলে আর বসে না থেকে সেটির সমাধান করুন। কারো সাথে দ্বন্দ্ব থাকলে তা মিটমাট করে ফেলুন। সম্ভব হলে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সম্পর্ককে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন, আর সম্ভব না হলে সেই সম্পর্ক থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসুন; দীর্ঘমেয়াদে আপনার জন্য তা ভালো হবে। আর কারো সাথে ভুল কিছু করে থাকলে দুঃখ প্রকাশ করুন বা ক্ষমা চান। এমনকি সেই ব্যক্তি আপনাকে ক্ষমা না করলেও আপনি মানসিক প্রশান্তি লাভ করবেন। কেননা, আপনি ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন, ফলে অনুশোচনার কিছু বাকি নেই।
৩. যেকোনো মূল্যে শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখুন: একজন বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন মানুষকে খেয়াল করলে দেখবেন, তার চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ বেশ স্পষ্টভাবেই পড়ে যায়। কেননা, এ অবস্থায় সাধারণত মানুষ তার শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি একদমই যত্নহীন হয়ে পড়ে। অথচ, এ স্বাস্থ্য ঠিক রাখাই তার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তা না হলে কিছুতেই বিষণ্নতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।
এ অবস্থায় বিশেষ করে ঘুম, খাওয়া ও শারীরিক ব্যায়ামের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। বেশি রাতজাগার অভ্যাস সাধারণত বিষণ্নতা বাড়িয়ে তোলে। তাই চেষ্টা করতে হবে বেশি রাত না জাগার এবং অন্তত ৬-৯ ঘন্টা ঘুমানোর। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে, তা নিয়মিত গ্রহণ করলে সেটি বিষণ্নতা কমাতে সহায়ক হতে পারে। আর প্রতিদিন অন্তত ২০-৩০ মিনিটের ব্যায়াম তাৎক্ষণিকভাবে বিষণ্নতাকে দূরে ঠেলে দেয়। এ কাজটি নিয়মিত কয়েক সপ্তাহ করে গেলে বিষণ্নতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসার কথা। আপনি জোরে হাঁটতে বা দৌঁড়াতে পারেন, কিংবা সাঁতার কাটতে পারেন, অথবা সাইকেল চালাতে পারেন। শারীরিক পরিশ্রমের পর মানুষের দেহে ‘এন্ডোরফিন’ নামক হরমোনের প্রভাব বেড়ে যায়, যা মানুষের ভালো লাগাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৪. নতুন কিছু করুন: আপনাকে যে জোর করে আপনার মনের বিরুদ্ধে নতুন কিছু করতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। মনে করে দেখুন, অতীতে এমন কোনো কিছুর কথা ভেবেছিলেন কি না, যা করা হয়ে ওঠেনি। যদি এমন কিছু থাকে, তাহলে সেটি হাতে নিন। আপনি নতুন কোনো কাজ শিখতে পারেন, কিংবা নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে বেরিয়ে পড়তে পারেন।
আপনার আগ্রহ থাকলে কম্পিউটার বা ভাষা শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো কোর্স করে নিতে পারেন। অথবা আপনি নিজে নিজেই ছবি আঁকা শিখতে পারেন। কিংবা আপনি কোনো গ্রামে ছুটে গিয়ে খুব কাছ থেকে গ্রামের বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবন-যাপন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। প্রত্যেকটা নতুন অভিজ্ঞতাই মানুষকে নতুন আঙ্গিকে ভাবতে শেখায়। মাঝেমধ্যে এসব ভাবনা থেকে ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা মানুষ পেয়ে থাকে, যা নিশ্চিতভাবেই বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
৫. রুটিন তৈরি করুন: রুটিনটা এমন হবে, যেন আপনি সেটা নিয়মিত অনুসরণ করতে পারেন। হোক সেটা সবচেয়ে সহজ কোনো রুটিন। প্রতিদিনই কয়েকটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার টার্গেট নিন এবং সেগুলো পূর্ণ করুন। প্রয়োজনে লক্ষ্য হিসেবে কম সংখ্যক এবং সহজ কাজগুলোকে নির্ধারণ করুন। দিনশেষে যখন দেখবেন আপনার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, তখন আপনি এমনিতেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন এবং বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পেতে থাকবেন।
৬. আধ্যাত্মিকতার সন্ধান: মেডিটেশন বা ধ্যান করতে পারেন। এতে নিজের মনের উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী উপাসনা বা প্রার্থনা করতে পারেন। এতে মানসিক স্থিতিশীলতা আসবে এবং বিষণ্নতা কাটাতে তা বড় ভূমিকা পালন করবে।
৭. দায়িত্বশীলতা: একজন মানুষ হিসেবে আপনার অনেকগুলো পরিচয় আছে। আপনি কারো সন্তান, কারো ভাই অথবা বোন কিংবা কারো বন্ধু। এরকম অসংখ্য পরিচয় আছে আপনার। আর প্রত্যেকটি পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে আছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেগুলোর বিষয়ে সচেতন থাকুন এবং সেগুলো পালন করতে সচেষ্ট হোন। বিষণ্নতা মোকাবেলায় এ বিষয়টি অনেক কাজে দেবে। আবার অন্যদেরকে যদি সহায়তা করেন কোনো কাজে, তা-ও আপনাকে আনন্দের অনুভূতি এনে দেবে, যা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন একজন মানুষের কাছে খুবই মূল্যবান।
৮. আনন্দের উৎস খুঁজুন: আপনি হয়তো সাপ্তাহিক ছুটির দিনটায় কোথাও বেড়াতে যান বা নতুন কোনো জায়গায় ভ্রমণ করে থাকেন। কিন্তু বিষণ্নতার কারণে এ কাজটা ইদানীং করা হয়ে ওঠে না। আপনি হয়তো ভাবেন, “এমনিতেই মন ভালো নেই। তাই কোথাও গিয়ে ভালো লাগবে না” এ ভাবনাটা পুরোপুরি ভুল। মানুষের আনন্দ লাভের যতগুলো উপায় আছে, তার মধ্যে একটা হলো ‘ভ্রমণ’। প্রায় যেকোনো পরিস্থিতিতে ভ্রমণ মানুষের মনকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে।
৯. ঘরের বাইরে সময় কাটান: খেয়াল করে দেখুন, আপনি ঘরে থাকা অবস্থায় যতটা বিষণ্ন থাকেন, ঘরের বাইরেও কি ততটা থাকেন? অবশ্যই না! ঘরের বাইরে থাকা অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় হরেকরকম ঘটনায় মনোনিবেশ করে থাকে। ফলে বিষণ্নতার মাত্রা কমে যায়। তাছাড়া দিনের বেলায় বাইরে থাকলে শরীরে সে সূর্যালোক পড়ে, তাতে দেহে ভাইটামিন ‘ডি’ উৎপন্ন হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় বিষণ্নতা হ্রাসে এই ভাইটামিন ‘ডি’ এর কার্যকরী ভূমিকার কথা জানা গেছে।
১০. বন্ধুদেরকে সময় দিন: শুধুমাত্র সেসব বন্ধুদের সাহচর্যেই থাকুন, যারা ইতিবাচক মনমানসিকতার এবং আপনার প্রতি যত্নশীল ও আন্তরিক। নেতিবাচক চিন্তাভাবনার বন্ধুদেরকে পরিহার করুন বেশ কিছুদিনের জন্য, কেননা, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা ও আচার-আচরণ সংক্রামক ব্যাধির মতো।
১১. ডায়েরি লিখুন: প্রতিদিন আপনার সাথে ভালো-খারাপ কী কী ঘটলো, তা সম্ভব হলে একটা ডায়েরিতে লিখে রাখুন। পরবর্তীতে ডায়েরির সেই পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেবেন কি না, সেটা নিতান্ত আপনার ইচ্ছা, তবে ডায়েরি লিখুন। যেকোনো কিছু লিখতে গেলে মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশটুকু কর্মোদ্দীপ্ত হয়ে উঠে। এটি বিষণ্নতা কাটাতে সহায়তা করবে।
১২. তিক্ত অনুভূতিগুলোকে মোকাবেলা করুন: যেসব তিক্ত অনুভূতি আপনার মন খারাপ করে দেয়, সেগুলোকে এড়িয়ে না গিয়ে মোকাবেলা করুন। এতে আপনার মানসিক বল বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। আপনি তিক্ত অনুভূতিগুলোকে যতোই এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবেন, সেগুলো ততই আপনাকে পেয়ে বসবে এবং আরো বেশি বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেবে। এরচেয়ে বরং সেগুলোকে মোকাবেলা করে সেগুলোর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ভালো।
১৩. চিকিৎসকের কাছে যান: আপনার মানসিক অবস্থা আপনার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? যদি তীব্র প্রয়োজন বোধ করেন, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। বিশেষ করে ঘন ঘন আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসলে ধরে নেবেন, দেরি না করে এখনই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর সময় হয়েছে!
১৪. ওষুধ নিয়মিত গ্রহণ করুন: চিকিৎসক আপনাকে ওষুধ দিলে অবশ্যই তা নিয়ম মেনে গ্রহণ করবেন। এমনকি কয়েকদিন ওষুধ সেবন করার পর পুরোপুরি সুস্থ অনুভব করলেও ওষুধ সেবন করা বন্ধ করবেন না। প্রয়োজনে পুনরায় চিকিৎসকের সাথে দেখা করে আপনার অবস্থার উন্নতির কথা বলুন এবং তার পরামর্শকেই প্রাধান্য দিন।
যা যা করবেন না
১. নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা: বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা মানুষগুলো সাধারণত এমনিতেই দুর্বল মনের অধিকারী হয়ে থাকেন। তার উপর এরা যখন অন্য কোনো ব্যক্তির (বিশেষ করে সফল ব্যক্তি) সাথে নিজের তুলনা করতে যান, তখন তিনি আরও ভেঙে পড়েন। খেয়াল করে দেখবেন, একজন মানুষ সবদিক থেকে পরিপূর্ণ হতে পারে না। যে ‘সফল’ বা ‘সুখী’ ব্যক্তির সাথে নিজেকে তুলনা করতে চাচ্ছেন, তিনি হয়তো কিছু দিক থেকে সত্যিই আপনার তুলনার সফল বা সুখী। কিন্তু তারও যে অনেক দুর্বলতা বা নেতিবাচক দিক রয়েছে, তা হয়তো আপনার চোখে পড়ছে না, কিংবা কখনো পড়বেও না। তাই অন্যের সাথে নিজের তুলনা করতে যাবেন না এবং কোনো অবস্থাতেই নিজেকে তাচ্ছিল্য করবেন না।
২. নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না: বিষণ্নতায় নিমজ্জিত একজন ব্যক্তি বেশিরভাগ সময় নিজের অস্তিত্ববোধ নিয়ে একপ্রকার দ্বিধার মধ্যে থাকেন। এ ভাবনাটি তাকে অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করতে পারে। আবার এ সময়ে একটা প্রবণতা দেখা যায়, শুধু নিজের দোষ খুঁজে বের করার; “আমি এমন না”, “আমি তেমন”, “আমি এটার যোগ্য না”, “আমি কিছুই পারি না”, “আমার দ্বারা কিছুই হবে না” ইত্যাদি। এভাবে চিন্তা না করে বরং ভাবুন, কেন আপনার দ্বারা কিছু হবে না? কিছ করার জন্য সত্যি সত্যিই কি আপনি কোনো চেষ্টা করেছেন? নাকি চেষ্টা না করেই বলছেন যে, আপনার দ্বারা কিছুই হবে না?
এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসুন।
৩. নিজেকে গুটিয়ে নেবেন না: বিষণ্নতায় আক্রান্ত একজন মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এটা বড় একটা ভুল। হয়তো আপনার কোনো আত্মীয়ের বিয়ে এবং আপনি ভাবছেন আপনার গিয়ে কোনো লাভ নেই, বরং গেলে খারাপ লাগবে। কিন্তু সেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যদের ছবি দেখবেন, তখন তাদের আনন্দ দেখে আপনার বিষণ্নতা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কেননা, তখন নিজের অজান্তেই আপনি আবারও তাদের সাথে নিজের তুলনা করতে যাবেন এবং ভাববেন, “ওরা আমার তুলনায় কত সুখে আছে…।” তাই এভাবে নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে সামাজিক হোন এবং বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে নিজের অংশগ্রহণ বাড়ান। দেখবেন সেটা ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
৪. সবাইকে বলে বেড়াবেন না: আপনার মানসিক অবস্থার কথা সবাইকে বলে বেড়াবেন না। বিশেষ করে অল্প-পরিচিত বা কিছুদিনের পরিচিত ব্যক্তিদেরকে তো অবশ্যই না। শুধুমাত্র আপনার হাতেগোনা যে কয়জন বন্ধু বা পরিবারের সদস্য আপনাকে খুব ভালো করে বোঝে এবং বিপদে আপদে সবসময় আপনার পাশে থাকে, তাদেরকেই মন খুলে সব বলুন।
৫. মাদককে তীব্রভাবে না বলুন: এ পরামর্শটা শুনতে শুনতে হয়তো আপনি বিরক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু সত্যি সত্যিই মাদক দীর্ঘমেয়াদে আপনাকে বিষণ্নতার জন্য জ্বালানী যোগায়! যেকোনো মাদক কিছুক্ষণের জন্য আপনার স্নায়ুকে শিথিল করে কিংবা হরমোনকে প্রভাবিত করে আপনার খারাপ লাগাকে একটু প্রশমিত করলেও এটি আপনার স্নায়ুকে এমনভাবে পরিবর্তিত করে যে, পরবর্তী অল্প সমস্যাতেই আপনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যান। ফলে আবার আপনি মাদকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এভাবে আপনি নতুন একটা জীবনে প্রবেশ করেন, নতুন মানুষদের সাথে আপনার চলাচল শুরু হয়, তাদের দ্বারা আপনি প্রভাবিত হন এবং সে অনুসারে আপনার লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আসে; সে জীবন থেকে বের হয়ে আসাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সে জীবন আপনার শেষ সম্ভাবনাটুকুকেও নষ্ট করে দিতে পারে। তাই প্রথম থেকেই মাদক হতে দূরে থাকুন।
৬. দোদুল্যমান অবস্থায় থাকবেন না: বিশেষ করে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক ভেঙে গেলে মানুষ বিষণ্নতায় বেশি ভুগে থাকে। বর্তমান যুগে এ সমস্যাটি অহরহ ঘটছে। এক্ষেত্রে ভালো করে ভেবে দেখতে হবে, সম্পর্ক পুনরায় ঠিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। প্রয়োজনে অপরপক্ষের সাথে পরিষ্কারভাবে এবং বিস্তারিত কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে। যদি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা ও পারস্পরিক ইচ্ছা থাকে, তাহলে দ্রুতই তা ঠিক করে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তা হলে সেটি হতে একদম সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে আসতে হবে।
অনেকেই এ সময়টাতে যে ভুল করেন, তা হলো- সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরও গোপনে তিনি তার প্রাক্তন সঙ্গীর খোঁজখবর রাখেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত তার প্রোফাইল চেক করতে থাকেন এবং অন্যের কাছে তার কথা জানতে চান। এ বিষয়টা পরিহার না করলে বিষন্নতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।”
৭. গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন না: যখন আপনি বিষণ্নতায় ভুগছেন, তখন আপনি নিজের অজান্তেই কিছুটা একগুঁয়ে আচরণ করে থাকেন। এ অবস্থায় আপনি মূলত আবেগ দ্বারা চালিত হন, যুক্তির দ্বারা নয়। তাই এ অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার মস্তিষ্ক আদৌ গভীরভাবে ভেবে দেখার অবকাশ পায় না যে, সে সিদ্ধান্তটি কতটা যুক্তিযুক্ত বা বাস্তবসম্মত। এবং একটা সিদ্ধান্ত আপনার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত একেবারেই নেবেন না। তবে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়লে নির্ভরযোগ্য কয়েকজন ব্যক্তির সাথে সেই সিদ্ধান্তের বিষয়ে কথা বলে, তাদের মতামতকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে কোনো একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। আবার এ সময়টাতে কাউকে কোনো বিষয়ে কথা দেবেন না বা কারো সাথে কোনোকিছুর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন না।
৮. চিকিৎসা ছাড়া ওষুধ নয়: তীব্র পর্যায়ের বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেক সময় চিকিৎসক এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ বা ওষুধ দিয়ে থাকেন। তবে চিকিৎসক অবশ্যই আপনার সামগ্রিক অবস্থা বুঝে এবং আপনার অন্য কোনো রোগ আছে কি না বা অন্য ওষুধ সেবন করেন কি না- তা জেনেই আপনাকে নির্দিষ্ট ধরনের ওষুধ দেবেন। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজ থেকে কখনোই কোনো ওষুধ ছুঁতেও যাবেন না।
৯. কান্না আটকাবেন না: চক্ষুলজ্জার কারণে প্রাপ্তবয়স্করা সাধারণত কান্না করতে লজ্জা বোধ করেন। বিশেষ করে পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বেশি সংকোচ বোধ করে থাকেন। তবে কান্না মানসিক চাপ কমাতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কান্নার উপক্রম হলে সেটা আটকাবেন না। প্রয়োজনে নিরিবিলি কোথাও গিয়ে খানিকটা চোখের জল গড়াতে দিন। এতে করে অনেকটা চাপমুক্ত হবেন।
শেষকথা
শক্ত মনের একজন মানুষও কখনো কখনো বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন। আপনার পরিচিত কোনো মানুষ যদি বিষণ্নতায় ভোগেন, তবে আপনারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আপনি অবশ্যই তার পাশে দাঁড়াবেন এবং তার প্রতি আন্তরিক হবেন। তবে তার মনস্তত্ত্বও আপনাকে বুঝতে হবে; এমন কিছু বলবেন না, যাতে করে তার মনে হয় যে আপনি তার সমস্যাটিকে ছোট করে দেখছেন। “এত চিন্তা করো না”, “আমি তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি”, “সব ঠিক হয়ে যাবে” – এমন ধরনের কথা তাকে বলা উচিত হবে না। কেননা, পরোক্ষভাবে এসব কথার মাধ্যমে তার সমস্যাটাকে ছোট করেই দেখা হয়। বরং আপনি তাকে কথা বলানোর চেষ্টা করুন। আপনি তার বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষ হয়ে থাকলে তার সমস্যাগুলো সে যেন আপনাকে খুলে বলে, সে বিষয়ে তাকে উৎসাহিত করুন, তবে চাপাচাপি করবেন না।
আপনি শুধুমাত্র তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেই সে অনেক উপকৃত হবে। আপনাকে খুব বেশি কিছু বলতে হবে না, শুধু শুনে যান। আর হ্যাঁ, অবশ্যই আপনার খুব কাছের বন্ধুটি কখনো চুপচাপ বা মন খারাপ করে থাকলে, সবাই মিলে সেটা নিয়ে মজা করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন, সে বিষণ্নতায় ভুগছে না তো?