‘Y’ সাহেবের বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে কিছুদিন অাগেই। নিতান্ত হাসিখুশি মানুষটি পেশায় চাকরিজীবী। তাই চাকরির খাতিরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। অাপাতদৃষ্টিতে শারীরিকভাবে সুস্থ মনে হলেও স্বাস্থ্য নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এর পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ সমস্যা। মাঝেমধ্যেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে অাসে, শরীর থেকে দরদর করে ঘাম বেরুতে থাকে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সেসময় তার কাছে মনে হয়, তিনি বোধহয় অার বাঁচবেন না, এখনই মারা যাবেন।
প্রথমে খুব একটা পাত্তা না দিলেও দিনে দিনে লক্ষণগুলোর মাত্রা বাড়তে লাগলো। অাতঙ্কিত ‘Y’ সাহেব সব ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। বিস্তর চেকঅাপ অার ডায়াগনোসিস হলো। কিন্তু সব চেকঅাপের ফলাফল এক, রেজাল্ট পজিটিভ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
কোনো কূল-কিনারা করতে না পেরে ‘Y’ সাহেব অফিসে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন। তার কথা, “যদি জীবনই না থাকে, তাহলে অফিস দিয়ে হবেটা কী!“। কোথাও খুব একটা বের হন না, হলেও দু-চারজনকে সাথে নিয়ে। মসজিদে গেলে দাঁড়ান পেছনের কাতারে। ভিড়-বাট্টা এড়িয়ে চলেন। যেখানে যেতে গণপরিবহনের দরকার পড়ে, সেদিকে ভুলেও ফিরে তাকান না।
এই যখন অবস্থা, তখন সাহায্যে এগিয়ে এলেন এক বিজ্ঞ অাত্মীয়। পরামর্শ দিলেন একজন মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে। শেষ চেষ্টা ভেবে তিনি একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে গেলেন। তিন-চার বৈঠকের পরে বোঝা গেলো, ‘Y’ সাহেব একটি বিশেষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, যার নাম প্যানিক ডিসঅর্ডার।
ইতিহাস
প্যানিক ডিসঅর্ডার এমন একটি মানসিক ব্যাধি, যাতে ব্যক্তি প্রচন্ড অাতঙ্কের শিকার হন। সাধারণত প্রতিটি প্যানিক অ্যাটাকের স্থায়ীত্বকাল দশ থেকে পনেরো মিনিটের মতো হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অাধঘন্টারও অধিক হতে পারে। সাধারণত পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ ব্যাধির বিস্তারের হার অধিক। যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে, তবে টিনএজে সর্বাধিক ঝুঁকি থাকে।
জ্যাকব মেনডিস দ্য কস্টা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর সৈন্যদের মাঝে একধরনের বুকের সমস্যা দেখতে পান, যেটাকে Irritable Heart Syndrome বলে অভিহিত করেন তিনি। এটাই Da Costa Syndrome হিসেবে পরিচিত হয়। পরবর্তী সময়ে এসে একে প্যানিক ডিসঅর্ডার হিসেবে নামকরণ করা হয়।
কারণ
প্যানিক ডিসঅর্ডারের পেছনে অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করলেও মূলত মস্তিষ্কে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ও হরমোনের ভারসাম্যহীনতা এর জন্য দায়ী।
পাশাপাশি বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক নিয়ামক, যেমন- বৈবাহিক কিংবা দাম্পত্য জীবনে জটিলতা, কোনো বিষাদময় ঘটনা, অার্থিক সমস্যা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বা গর্ভপাত, নেশাদ্রব্যের ক্রিয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন প্রকার ফোবিয়া থেকে প্যানিক ডিসঅর্ডারের সূচনা ঘটতে পারে। পরিবারে কারও এ রোগ থাকলে অন্যদের তুলনায় ৪-৮ গুণ বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোগ্লাইসিমিয়া, মাইট্রাল ভালভ প্রলাপস ইত্যাদি রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্যানিক ডিসঅর্ডার হতে পারে।
ক্রিয়াকৌশল
প্যানিক ডিসঅর্ডার মূলত তখনই বলা হয় যখন প্যানিক অ্যাটাকগুলো ঘন ঘন দেখা দিতে থাকে। অামরা জানি, অামাদের স্নায়ুতন্ত্র অটোনমিক সিস্টেমের দুটি অংশ অাছে। সিম্প্যাথেটিক ও প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম। অামরা যখন কোনো কারণে নিজেদের বিপদাপন্ন মনে করি, ভয় পাই বা নার্ভাস হয়ে পড়ি, তখন অামাদের শরীরের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। এটি অ্যাড্রেনালিন নামক একটি বিশেষ হরমোন ক্ষরণ করে, যা অামাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ও অঙ্গকে অাসন্ন বিপদ মোকাবেলায় প্রস্তুত করে তোলে।
অ্যাড্রেনালিন অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং পরিপাক প্রক্রিয়ায় রক্ত সংবহন কমিয়ে দিয়ে স্নায়ু, মাংসপেশি এবং মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। এটি হৃদস্পন্দন কমায়। এভাবে অামাদের দেহে অাক্রমণ বা পালানোর জন্য অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চিত হয়।
সারাক্ষণ সিম্পেথিটিক নার্ভাস সিস্টেম কার্যকরী থাকা দেহের জন্য ভালো নয়। যখন অামাদের মস্তিষ্ক অনুধাবন করতে পারে বিপদ কেটে গেছে, তখন শরীরের ‘শাট অফ’ প্রক্রিয়া চালু হয়।
এক্ষেত্রে স্নায়ুতন্ত্রের অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমের অংশ প্যারাসিম্পেথিটিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় হয়। ফলে এড্রিনালিন ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। দুটোর যথাযথ ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা চলি।। এটি ক্রিয়াকৌশল অ্যাড্রেনালিন এর বিপরীত। এটি হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার স্বাভাবিক করে। ফলে আমরা আরাম অনুভব করি।
উল্লেখ্য, সিম্প্যাথেটিক ও প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম পরস্পরের পরিপূরক। এরা একসঙ্গে কাজ করতে পারে না। একটি যদি সক্রিয় হয়, তবে অন্যটিকে অবশ্যই নিষ্ক্রিয় থাকতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী চাপের ফলে মস্তিষ্কের রিসেপ্টরের ক্ষতি হয়। ফলে শাট অফ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ প্যারাসিম্পেথিটিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় হয় না। ফলে অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ হলেও এটি নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি অার কাজ করে না। ফলে হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত অ্যাড্রেনালিনের ক্ষরণে প্যানিক ডিসঅর্ডারের লক্ষণ তৈরি হয়।
যখন আমরা দীর্ঘদিন মানসিক উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে যাই, তখন অামাদের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে অামরা তুচ্ছ বিষয়েরও অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা করে বিপজ্জনক হিসেবে ধরে নেই। ফলে একে বিপদ হিসেবে ধরে নিয়ে আমাদের দেহ সেভাবেই প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। কিন্তু আমাদের ভুল ব্যাখ্যার কারণে সৃষ্ট তথাকথিত বিপদ আর সহসা কাটে না (কারণ আসলে তো কোনো বিপদই নেই!)। তবে দেহ এটিকে বিপদ হিসেবে ধরে নেয়। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সিম্পেথিটিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় থাকে এবং আমরা উৎকন্ঠাবোধ করি।
উপসর্গ
- বুক ধড়ফড় করা, হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা
- তীব্র অাতঙ্ক
- বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- অবশ বা অজ্ঞান হবার অনুভূতি সৃষ্টি
- দেহে কাঁপুনির উদ্রেক এবং প্রচুর ঘাম হওয়া
- দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া, হাত-পায়ে ঝিনঝিন করা
- বিবমিষা এবং পেটে গন্ডগোল
- বিভিন্ন ধরনের ভয়ের চিন্তা মাথায় অাসা, যেমন: এখনই মারা যাবো, কেউ বাঁচাতে পারবে না ইত্যাদি।
প্যানিক ডিসঅর্ডারে অাক্রান্তরা সবসময় উৎকন্ঠায় থাকেন। অসুখ বাড়লো কিনা, তা খতিয়ে দেখতে সার্বক্ষণিক শরীরের ওপর কড়া নজরদারি চালিয়ে যান। কেউ কেউ মিনিটে কতবার শ্বাস নিচ্ছেন সেটা পরিমাপ করতেও বাদ রাখেন না। কিন্তু এই খুঁতখুঁতে স্বভাব তাদের রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ না করে জ্বালানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
প্যানিক ডিসঅর্ডার রোগীদের চিন্তাধারা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। যেমন-
- অামি শীঘ্রই মারা যাবো।
- অামি অার সুস্থ হবো না।
- অামার মারাত্মক অসুখ হয়েছে, ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেন না।
- বুকে ব্যথার অর্থ অামার এখনই হার্ট ফেইল কিংবা হার্ট অ্যাটাক হবে।
চিকিৎসা
এ রোগে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়ার সাথে কিছু মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাও করা হয়। যেমন-
১. রোগীর ভ্রান্ত ধারণা দূর করা হয় এবং তাকে বোঝাতে হয় যে এ রোগের জন্য মৃত্যু হবে না এবং এ সমস্যা কয়েক মিনিটের মধ্যে এমনিতেই চলে যাবে (Cognitive Behaviour Therapy)।
২. রোগীকে শেখাতে হয় যে প্যানিক এটাকের সময় কীভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা যায় (Relaxation Training)।
৩. রোগীকে কল্পনায় প্যানিক এটাক তৈরি করে কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা শেখানো হয় (Desensitization)।
৪. রোগীর পরিবারের সদস্যদেরকে এ রোগ সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা দেওয়া হয়, যাতে তারা রোগীকে সহযোগিতা প্রদান করতে পারেন (Family Therapy)।