পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম অথবা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিস, নামগুলো খুব খটমটে মনে হচ্ছে হয়তো। কিন্তু আমরা কি জানি, আমাদের আশেপাশে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন নারী এই রোগে আক্রান্ত? এমনকি অনেক আক্রান্ত নারী নিজেরাই জানেন না যে তারা এই সিনড্রোমে আক্রান্ত।
- অপ্রত্যাশিত ওজন বেড়ে যাচ্ছে, অথবা কিছুতেই ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?
- পিরিয়ড অনিয়মিত হচ্ছে কিংবা খুব ঘন ঘন হচ্ছে?
- মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে অথচ মুখে, বুকে, পিঠে অপ্রত্যাশিত লোম বেড়ে যাচ্ছে?
- উদ্বেগ, হতাশা মনকে গ্রাস করছে? ঘুমে সমস্যা হচ্ছে?
আপনি আন্দাজ করতে পারছেন না কেন এমন হচ্ছে, কিন্তু আপনি হয়তো নিজের অজান্তেই বহন করে চলেছেন পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS) অথবা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিস (PCOD) এর মতো হরমোন জনিত অসুখ। উপরোক্ত লক্ষণগুলো কিছুটা সাধারণ হলেও এই রোগের প্রধান লক্ষণ এবং ভীতিকর পরিণতি হলো বন্ধ্যাত্ব।
মূলত এই রোগটি জিনগত। পরিবারের অন্য সদস্যদের, যেমন- মা, বোন, দাদি-নানি, খালা-ফুফু, তাদের এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মও তা বহন করতে পারে। এছাড়াও গবেষকরা এই রোগের প্রধান কারণ হিসেবে এখনকার অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারাকেও দায়ী করছেন। প্যাকেট অথবা টিনজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি এবং চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, অপর্যাপ্ত অথবা অনিয়ন্ত্রিত ঘুম, শারীরিক অনুশীলনের অভাব, এমনকি মানসিক চাপও এই রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম নারীদের ওভারি বা ডিম্বাশয় এবং হরমোন উৎপাদন মাত্রার উপর প্রভাব ফেলে। হরমোনাল গ্রন্থিগুলো ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন, লিউটেনাইজিং হরমোন, টেস্টোস্টেরন, এস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন নামক মেয়েলি হরমোনের পাশাপাশি কিছুটা পুরুষালী হরমোন অ্যান্ড্রোজেন উৎপন্ন করে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রতিটি ওভারি একটি করে ডিম্ব উৎপন্ন করে ডিম্বস্ফুটনের জন্য, কিন্তু প্রস্ফুটিত না হলে সেটি পিরিয়ডের মাধ্যমে শরীর হতে বের হয়ে যায়। মেয়েলি হরমোনগুলো ডিম্ব তৈরি হওয়া থেকে পিরিয়ড সঠিক সময়ে হওয়া এবং গর্ভধারণ করতে সাহায্য করে। তবে যখন মেয়েলি হরমোন থেকে পুরুষালী হরমোনের উৎপাদন বেশি হয়ে যায়, তখন ডিম্বগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ব হয় না এবং সঠিক সময়ে পিরিয়ডের মাধ্যমে বের না হয়ে সিস্ট আকারে ওভারিতে জমা হয়। এমনভাবে অনেকগুলো সিস্ট জমা হয়ে ওভারির আকার বড় করে ফেলে এবং পলিসিস্টিক ওভারির সৃষ্টি করে (পলি মানে অনেক)। এরপর পিরিয়ড চক্র অনিয়মিত হয়ে যায়। এতে করে জরায়ুর ভেতরের পর্দাও মোটা হয়ে জমে যায়। কখনো কখনো গর্ভদানীর ভেতরে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি হয়ে থাকে।
লক্ষণ
PCOS এর লক্ষণগুলো বয়ঃসন্ধির কিছু পর থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর প্রকাশ প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ও হয়ে থাকে। অনেক রোগীই ছোট ছোট লক্ষণগুলোকে নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না, তবে যখন গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়, তখনই ডাক্তার এর শরণাপন্ন হন এবং এই রোগ সম্পর্কে অবগত হন।
- স্থুলতা: হঠাৎ করে অনেক মুটিয়ে যাওয়া এবং অনেক চেষ্টা করেও ওজন না কমা PCOS এর প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি। এই রোগে বিশেষত শরীরের উপরের অংশ ও পেটের ওজন বৃদ্ধি হয়ে থাকে।
- অনিয়মিত পিরিয়ড: সাধারণত পিরিয়ড মধ্যবর্তী সময় ২৮-৩৫ দিন। যদি এর বেশি সময় ধরে পিরিয়ড বন্ধ থাকে অথবা বছরে আটবারের কম পিরিয়ড হয়, তবে তাকে অনিয়মিত বলে গণ্য করা হয়। এটি PCOS এর মূল লক্ষণ, এই রোগীরা মাঝে মাঝে মনেই করতে পারেন না যে, শেষ কবে তাদের পিরিয়ড হয়েছিল। কারো কারো ক্ষেত্রে অবশ্য খুবই অল্প অথবা খুবই বেশি রক্ত নির্গত হয়ে থাকে।
- অবাঞ্ছিত লোম: পুরুষের মতো মুখে, বুকে, পিঠে অথবা অন্যান্য অপ্রত্যাশিত জায়গায় ঘন লোম দেখা যায়। পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন বেশি থাকার কারণে এমনটি হয়ে থাকে।
- তৈলাক্ত ত্বক এবং একনি: অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন ত্বকের তৈলগ্রন্থির নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় এবং একনি ব্রণের সংক্রমণ বেড়ে যায়। এছাড়াও ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়।
- মাথায় টাক: মাথার চুল ঝরে পড়ার হার বেড়ে যায় এবং পুরুষের মতো কপালের সামনে, মাথার তালুতে টাক পড়তে থাকে।
- মানসিক অবস্থান্তর: বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ ও ক্লান্তি রোগীকে ঘিরে রাখে। দেহে বিপাক শক্তি কমে যাওয়ায় অনেক নারী নিরুৎসাহিত ও অসহায় বোধ করেন, এমনকি নিজস্ব বিবেচনা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন।
কারণ
সাধারণত হরমোনের ভারসাম্যতা হারানোর ফলে এই রোগ হয়ে থাকে। একটি হরমোন অন্যটিকে প্রভাবিত করে, অন্যটি অপরটিকে; এমনভাবে চলতেই থাকে। পারিবারিকভাবে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে PCOS এর সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। কারণ, ডায়াবেটিস এবং PCOS এর মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি এই রোগীদের কোষগুলোর ইনসুলিনের গ্রহণযোগ্যতাও অনেক কম। তাই শরীরের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী প্যানক্রিয়াস গ্রন্থি আরও ইনসুলিন তৈরি করতে থাকে, আর অতিরিক্ত ইনসুলিন ওভারিতে পুরুষ হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, অন্ততপক্ষে ৭০ ভাগ PCOS আক্রান্ত নারীরই পূর্বে ডায়াবেটিস ছিল বা কোষে ইনসুলিনের গ্রহণযোগ্যতা কম ছিল।
নারীদের শারীরিক ওজন অনেক সময়ই এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত ওজন শরীরে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়, পরবর্তীতে ইনসুলিন অন্যান্য হরমোনের উৎপাদনকে বাধাগ্রস্থ করে দেয়। অলসতা বা শারীরিক কার্যকলাপ বিমুখ হলেও এই রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
ফাস্ট ফুড, চর্বিযুক্ত খাবার, খাবারে বেশি লবণ রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ এবং ওজন বাড়িয়ে দেয়। এটি PCOS এ আক্রান্ত হবার পথে একধাপ এগিয়ে দেয়।
প্রভাব
- গর্ভধারণ: হরমোনের মাত্রা অস্থিতিশীল এবং পিরিয়ড চক্র ঠিক না থাকায় সঠিক সময়ে ডিম্বস্ফুটন হয় না। তাই পরিকল্পিত গর্ভধারণ করাটা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি ডিম্ব পরিপূর্ণ রূপে পরিপক্ক হতে পারে না এবং রোগী গর্ভধারণ করার জন্যে সঠিক দিনের হিসাব বের করতে পারেন না।
- গর্ভপাত বা অপরিপক্ক শিশু জন্মদান: PCOS এর রোগীদের গর্ভধারণের পর গর্ভপাত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেকেরই বার বার গর্ভপাত হয়ে থাকে। কিছু কিছু রোগী গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপের সমস্যার সম্মুখীন হয়। অকালীন প্রসব বেদনা এবং শিশু জন্মদান এই রোগের রোগীদের জন্যে একটি সাধারণ সমস্যা।
- বন্ধ্যাত্ব: গর্ভধারণ করতে হলে সঠিক সময়ে ডিম্বস্ফুটন করাটা বাঞ্ছনীয়। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ডিম্বস্ফুটন হওয়া অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। PCOS কে নারীদের বন্ধ্যাত্বর জন্য মুখ্য কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
- জরায়ুর ক্যান্সার: প্রতিবার পিরিয়ডের সময় জরায়ুর ভেতরের এক পরত ঝিল্লি রক্তের সাথে মিশে বের হয়ে যায়; পিরিয়ড অনিয়মিত হলে সেটা ভেতরেই জমে থাকে এবং জরায়ুর দেয়ালকে পুরু করে ফেলে। পরবর্তীতে তা জরায়ুর দেয়ালে ক্যান্সারের সম্ভাবনা তৈরি করে।
- স্লিপ অ্যাপনিয়া: ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে কিছু সময়ের জন্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, একেই স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়। PCOS পীড়িত রোগীদের এই সমস্যা প্রায়ই হতে পারে।
- মেটাবলিক সিনড্রোম: অধিকাংশ রোগী অধিক ওজনের হয়ে থাকেন, যা কিনা রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই কারণগুলোকে একত্রে মেটাবলিক সিনড্রোম বলা হয়। এই সিনড্রোম পরবর্তীতে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের মতো ভীতিকর অসুখের সৃষ্টি করে।
প্রতিকার
সঠিক জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস এই রোগ থেকে দূরে থাকার প্রধান উপায়। প্রতিদিন কিছুটা শারীরিক ব্যায়াম, জগিং বা হাঁটা সারা শরীরের দহন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। মেটাবলিক হার ঠিক থাকলে হরমোনের মাত্রা ঠিক থাকে, রক্তে চিনি ও কোলেস্টেরলের পরিমাণও ঠিক থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, অন্ততপক্ষে ৭% ওজন কমাতে পারলেই PCOS সংক্রান্ত ঝুঁকি এবং প্রভাব অনেকাংশে কমে যায়।
উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার, কম কার্বোহাইড্রেট, স্বাস্থ্যকর আমিষ, অপরিশোধিত ময়দা ও চিনি, সবজি ও ফলমূল সমৃদ্ধ খাদ্য পরিকল্পনা এই রোগীদের জন্য সর্বাধিক কার্যকর। পরিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস নিয়মিত পিরিয়ড ঠিক রাখে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য মানসিক সুস্থতা অনেক জরুরী। দুশ্চিন্তা এবং অবসাদ থেকে দূরে থাকতে পারলে PCOS এর প্রতিকার করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
চিকিৎসা
PCOS এর যেকোনো একটি উপসর্গ প্রকাশ পেলে অবশ্যই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাফি, অন্যান্য প্রকাশিত উপসর্গ যাচাই করে এই রোগ নির্ণয় করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তাররা সাধারণত জন্মনিয়ন্ত্রণ ট্যাবলেট এবং হরমোন ট্যাবলেট নির্ধারণ করে থাকেন। ডায়েট চার্ট এবং ব্যায়ামেরও পরামর্শ দেন। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়, উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক চিকিৎসা করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদি এই রোগ মোকাবেলা করা সম্ভব।
ফিচার ইমেজ: sciencemag.org