বাচ্চাদের ডায়াবেটিস: বড়দের রোগ যখন ছোট্ট শরীরে

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের নাম শুনলেই দৃষ্টিপটে ভেসে ওঠে অতি মাত্রায় চিনি বা মিষ্টি খাওয়ার ফলে ব্লাড সুগার বেড়ে যাওয়া কোনো ব্যক্তির ছবি। কিন্তু একটি নবজাতক বা একটু বড় একটি বাচ্চা যে কিনা মিষ্টি খাওয়া শুরুই করেনি এখনো, তার ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের কথা হয়তো কারো মাথায়ই আসবে না! নবজাতক বা ছোট বাচ্চা, এমনকি মায়ের গর্ভে থাকা শিশুটিও হতে পারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত! এই ধরনের ডায়াবেটিসকে বলা হয় টাইপ-১ ডায়াবেটিস।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস কী?

এটি একধরনের অনাক্রম্য ব্যাধি বলা চলে, যা রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রাকে বিনষ্ট করে। যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস থাকে, তাদের দেহ পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। এই ইনসুলিনের কাজ হলো রক্তপ্রবাহ থেকে গ্লুকোজকে সকল দেহকোষে পৌঁছানো। যেহেতু টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের দেহে পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না, তাই গ্লুকোজও দেহকোষে পৌঁছাতে পারে না এবং পর্যাপ্ত দৈহিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। কর্মশক্তিও হ্রাস পায়। এই ধরনের ডায়াবেটিসকে অনিরাময়যোগ্য বলা হয়। তবে খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারণের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে গেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়; Source: t1international.com

স্বাভাবিকভাবে একটি বাচ্চার দেহের ইমিউন সিস্টেম তাকে জীবাণু এবং ক্ষতিকারক কোষ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু যখন একটি বাচ্চা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, তখন পিত্তথলির ইনসুলিন সৃষ্টিকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে। এই কোষগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে শরীরে খুবই কম বা একেবারেই ইনসুলিন উৎপন্ন হবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঐ বাচ্চাটির রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়।

কেন হয়?

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের সঠিক কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞগণ বলেন, জিনগত এবং পরিবেশগত কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। গবেষকগণ বেশ কিছু জিনও শনাক্ত করতে পেরেছেন, যেগুলো থাকলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হতে পারে। তবে এমন অনেক বাচ্চাই রয়েছে যাদের ঐসকল জিন থাকা সত্ত্বেও টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়নি। এছাড়াও দেখা যায়, টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক বাচ্চারই পরিবারের কারও এ রোগ কখনোই ছিল না। তাই বলা যায়, টাইপ-১ ডায়াবেটিসের কারণ এখনো অজানাই রয়ে গিয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে।

ডায়াবেটিস মিটার; Source: elitemensguide.com

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো:

  • পরিবারের রোগ ইতিহাস
  • নির্দিষ্ট জিন
  • বয়স (৪-৭ বছর এবং ১০-১৪ বছর)

রোগের উপসর্গসমূহ

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো অনেকটা হঠাৎ করেই আসে। এই লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে

  • তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া
  • বারবার প্রস্রাব হওয়া
  • টয়লেট ট্রেনিং সম্পন্ন যে বাচ্চা আগে কখনো রাতে প্রস্রাব করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতো না, সে বারবার বিছানা ভিজিয়ে ফেলা
  • অনেক বেশি এবং বারবার ক্ষুধা লাগা
  • উল্লেখযোগ্য কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন হ্রাস পাওয়া
  • বিরক্তি কাজ করা এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তন
  • ক্লান্ত এবং দুর্বল অনুভব করা
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা
  • খামখেয়ালিপনা

পাঁচটি লক্ষণ; Source: diabetes.ie

এছাড়া আরও কিছু উপসর্গ রয়েছে যেগুলো দেখামাত্রই বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সৃষ্টি হতে পারে সংকটজনক অবস্থা। যেমন-

  • শ্বাস নেবার সময় ফলমূল বা মিষ্টিজাতীয় কোনো বস্তুর ঘ্রাণ পাওয়া
  • বমিবমি ভাব
  • বমি হওয়া
  • পেটে ব্যথা
  • চেতনা হ্রাস পাওয়া

ডায়াবেটিস থেকে জটিলতা

টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেহের প্রধান অঙ্গগুলোর উপর প্রভাব ফেলে, যেমন- হৃদপিণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু, চোখ এবং কিডনি। তবে ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তবে জটিলতাগুলোও অনেক কমে যায়।

টাইপ-১ ডায়বেটসে জটিলতা; Source: medicentres.ae

হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালির রোগ

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের আক্রান্ত হলে করোনারি আর্টারি হৃদরোগ, বুকে ব্যথা (অ্যাঞ্জিনা), হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ধমনী সরু হয়ে যাওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্নায়ু ক্ষয়

রক্তে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ কৈশিক নালিকার দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি করে যেগুলো স্নায়ুর দেখাশোনা করে, বিশেষ করে পায়ের স্নায়ুগুলোর। এর ফলে অসাড়তা, জ্বলুনি বা ব্যথা অনুভূত হয়। এই অনুভুতিগুলো শুরু হয় পায়ের পাতা থেকে এবং ধীরে ধীরে দেহের উপরের দিকে উঠতে থাকে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা যদি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে ধীরে ধীরে দেহের অনুভব ক্ষমতা হারিয়ে যাবে, অন্যভাবে বলতে গেলে, শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে।

চোখের সমস্যা

ডায়াবেটিস চোখের রেটিনার রক্তনালিগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। ফলে অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। এছাড়াও চোখে ছানি পড়তে পারে।

চিকিৎসা

টাইপ-১ ডায়াবেটিসে প্রতিদিন মনিটরিং এবং সেবা খুব প্রয়োজন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট প্ল্যান অনুসরণ করার পাশাপাশি বাচ্চাকেও তার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

পর্যবেক্ষণ

ডায়াবেটিস পরীক্ষার ছোট ডিভাইসটির সম্পর্কে অনেকেই জেনে থাকবেন। সেটি দিয়ে নিয়মিত বাচ্চার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা খেয়াল রাখা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি। আর কয়েক মাস পর পর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ঐ ল্যাব টেস্ট করানো লাগতে পারে।

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট প্ল্যান অনুসরণ করতে হবে; Source: Huffington Post

ইনসুলিন ইনজেকশন

যেহেতু ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না দেখেই ডায়াবেটিস হচ্ছে, তাই দেহে পরিমিত মাত্রায় ইনসুলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন হতে পারে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।

খাদ্যাভ্যাস

ডাক্তার এবং পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী বাচ্চার জন্য সঠিক খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে। তবে এটি পরিবর্তন করতে হবে নির্দিষ্ট সময় পরপর, কেননা বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আনা আবশ্যক।

ব্যায়াম

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বাচ্চাদের সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এক ঘণ্টা করে শারীরিক ব্যায়াম করানো উচিত। তবে হ্যাঁ, সেটিও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।

মানসিক স্বাস্থ্য

ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতা, ইটিং ডিসঅর্ডার এবং শেখায় দুর্বলতা টাইপ-১ ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টদায়ক করে তোলে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস হলে শুধু বাচ্চাটিই নয়, বরং তার পুরো পরিবারই মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

শনাক্তকরণ

উপরে বর্ণিত উপসর্গগুলো যদি বাচ্চার মধ্যে দেখা যায় তখনই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তার যদি সন্দেহ করেন বাচ্চার ডায়াবেটিস হতে পারে, তাহলে তিনি রক্ত পরীক্ষা করতে দেবেন। রক্ত পরীক্ষার পর আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ল্যাব টেস্ট করানো হয়। ল্যাবে রক্তের নমুনা পাঠালে তা থেকে বিগত কয়েক মাসে রক্তে চিনির মাত্রা সম্পর্কে জানা যাবে।

বাচ্চার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব; Source: ansa.it

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

আজকাল এমন কিছু অ্যাপের দেখা যাবে যেগুলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়, যেমন-MySugr, Glucose Buddy ইত্যাদি ব্যবহার করে গ্লুকোজের মাত্রা, ইনসুলিন, ওষুধ গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করা যায়। এসব অ্যাপ ব্যবহার করে দৈনিক মনিটরিং চার্টও তৈরি করে ডাক্তারকে দেখানো যেতে পারে।

২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ মন্ত্রণালয় ‘Artficial Pancreas’ নামের একটি যন্ত্রের অনুমোদন দেয় যেটি প্রতি মিনিটে মিনিটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখে এবং সে অনুযায়ী ইনসুলিনকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। গবেষকগণ এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এর চেয়েও সহজতর এবং অধিক কার্যকরী প্রযুক্তি আবিষ্কারের জন্য।

আপনার শিশুর প্রতি নজর রাখুন; Source: Steph Dawson-Cosser

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো উপায় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। গবেষকগণ কাজ করে চলেছেন এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার কোনো উপায় আছে কিনা তা নিয়ে। হয়তো সেই দিনটি খুব বেশি দূরে নয়। আপনার বাচ্চার প্রতি খেয়াল রাখুন, তার মাঝে কোনো রকম উপসর্গ দেখা গেলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। সঠিক সময়ে চিকিৎসাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান।

ফিচার ইমেজ: amaven.co.uk

Related Articles

Exit mobile version