করোনাভাইরাস ডিজিজ বা কোভিড-১৯ নিয়ে আমাদের আলোচনাটা নতুন নয়। তবে প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলে ফেলার কারণে পৃথিবীর সবগুলো দেশে নিত্যনতুন খবরে উঠে আসছে করোনা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসটি মানবদেহের শ্বসনতন্ত্রকে আক্রমণ করে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই আক্রমণকে সামাল দেওয়াটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
সাধারণত ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর, গায়ে কাঁপুনি, কফ, নিশ্বাসে সমস্যা, মাথাব্যথা, স্বাদ ও গন্ধ কমে আসা, মাংসপেশীর ব্যথা ইত্যাদিকেই করোনার প্রাথমিক লক্ষণ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে চমকে দেওয়ার মতো ব্যাপার হলো, শুধু এই পরিচিত লক্ষণগুলোই নয়, পাকস্থলীর নানাবিধ সমস্যা, এই যেমন- ডায়রিয়া, ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব ইত্যাদিকেও করোনাভাইরাসের লক্ষণ বলা যায়।
কোভিড-১৯ এবং গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল লক্ষণসমূহ
আপনার শরীরে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হলেই যে আপনি বাকিদের মতো কাশি, জ্বর বা ঠাণ্ডায় ভুগবেন তা কিন্তু নয়। অন্যান্য লক্ষণের সাথে কিংবা অন্য কোনো লক্ষণ ছাড়াই করোনাভাইরাসের কারণে হওয়া পাকস্থলীর এই সমস্যা আপনার শরীরে দেখা দিতে পারে।
সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে করা এই গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মধ্যেই হালকা বা গুরুতর হজম সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়। বেইজিংয়ে পরিচালিত আরেকটি গবেষণাতেও এই তথ্যের সত্যতা মেলে। চলুন, কোভিড-১৯ এর কারণে আপনার গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ডায়রিয়া
জাপানে পরিচালিত এক গবেষণানুসারে, বয়স্ক ও শিশু- উভয়ের অন্ত্রেই কোভিড-১৯ প্রভাব বিস্তার করে এবং এতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। আমেরিকান জার্নাল অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মোট ২০৬ জনের উপরে গবেষণা চালায়। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৮ জনের শরীরে শুধু হজমের সমস্যা এবং ৬৯ জনের শরীরে হজম ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা দেখা যায়। এর মধ্যে মোট ১৯.৪ শতাংশ মানুষের দেহে প্রকাশ পাওয়া প্রাথমিক লক্ষণ ছিল ডায়রিয়া।
বমিভাব
সম্প্রতি বেইজিংয়ে পরিচালিত গবেষণানুসারে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পাওয়া লক্ষণটি হচ্ছে বমিভাব। ডিসেম্বর, ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত প্রকাশিত কোভিড-১৯ আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে পর্যাযলোচনা করে গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে আসেন। এক্ষেত্রে শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে থেকে ৩.৬-১৫.৯ শতাংশ ব্যক্তি নন, শিশুদের মধ্যেও ৬.৫-৬৬.৭ শতাংশের ক্ষেত্রে বমিভাব দেখা গিয়েছে।
ক্ষুধামান্দ্য
করোনাভাইরাসের কারণে স্বাদ ও গন্ধের ক্ষমতা মানুষের ভেতরে কমে আসে। তবে একইসাথে হজম সংক্রান্ত কারণেও এসময় একজন মানুষ ক্ষুধামান্দ্যে ভুগে থাকেন।
অন্যান্য সমস্যা
ডায়রিয়া, বমিভাব বা ক্ষুধামান্দ্য ছাড়াও কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের শরীরে পেটব্যথা এবং রক্তক্ষরণের মতো সমস্যাগুলোও দেখা গিয়েছে। তবে এই পরিমাণ এখনও অনেকটাই কম।
কোভিড-১৯ এর কারণে কেন পাকস্থলীর সমস্যা হয়?
শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকারক ভাইরাস সাধারণত এনজাইম টু বা ACE2 এর মাধ্যমে অন্ত্রে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে। ফুসফুস এবং জিআই সিস্টেমেও এর অবস্থান দেখা যায়। প্রোটিনকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে এমনটা এই রিসেপ্টর করতে পারে বলে মনে করেন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট সুপ্রিয়া রাও। এছাড়া উহান স্টাডির লেখক ডক্টর ওয়েনবিন লির মতেও ACE2-কে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের ফুসফুস ও পাকস্থলীতে দেখা গিয়েছে যেটি এই লক্ষণের উৎস হতে পারে।
দরকারি কিছু প্রশ্নের উত্তর
১) কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে জ্বর ছাড়াও কি ডায়রিয়া হতে পারে?
হ্যাঁ, হতে পারে। এখন পর্যন্ত অনেকের শরীরেই কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক এবং একমাত্র লক্ষণ হিসেবে ডায়রিয়া প্রকাশ পেয়েছে।
২) আমি ইতিমধ্যেই হজম সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছি। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ থেকে দূরে থাকতে আমি কী করতে পারি?
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পাকস্থলীর সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের খুব সহজেই ভাইরাস আক্রমণ করতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করুন, হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখুন, ঠান্ডা-কাশি আছে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থাকুন এবং যতটা সম্ভব ঘরেই অবস্থান করুন।
৩) আমার মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে কী করবো?
সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। প্রায় ৮০ শতাংশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিই নিজের শরীরে মাঝারি ধরনের লক্ষণ অনুভব করবেন, যার মধ্যে পাকস্থলীর সমস্যাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে বাসায় বসে যথাযথ বিশ্রাম ও সেবা গ্রহণ করাটাই তুলনামূলকভাবে ভালো।
আর যদি আপনার ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ এর কারণে গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল লক্ষণসমূহ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে বাসায় অবস্থান করুন। নিজেকে ও পরিবারের বাকি সদস্যদের সুস্থ রাখতে-
- কিছুটা সময়ের জন্য পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
- বেশি বেশি পানি পান করুন। ডায়রিয়া বা বমি- দুটোতেই শরীরের অনেকটা পানি খরচ হয়ে। এর ফলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। সবচেয়ে ভালো ফলাফল পেতে সাধারণ পানির পাশাপাশি স্যালাইন বা চিনি ও লবণ মিশ্রিত পানি পান করুন।
- কলা, ভাত, টোস্ট, আলু ইত্যাদি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করুন। এতে করে আপনার শরীরে কার্বোহাইড্রেটের যথাযথ যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
- ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করুন। হাতের প্রতিটি স্থান কমপক্ষে ২০ সেকেন্ডের জন্য সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- প্রতিদিন ব্যবহার করতে হচ্ছে এমন স্থানগুলো, এই যেমন- কমোডের সিট, মোবাইল, চশমা ইত্যাদি জিনিস জীবাণুমুক্ত করুন।
আর এই পুরোটা সময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ওষুধ সেবন করুন। হাসপাতালে প্রয়োজন ব্যতীত যাওয়ার বদলে বাসায় থেকেই যথেষ্ট বিশ্রাম গ্রহণ করুন। এতে করে আপনার সুস্থতার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।