মস্কুইরিক্স: ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে নতুন দিগন্তের সূচনা

মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম ম্যালেরিয়া। ক্রান্তীয় (tropical and subtropical countries) অঞ্চলের দেশগুলোতেই এই রোগের প্রকোপ বেশি লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব আছে। উন্নত দেশগুলোতে এই রোগ দুর্লভ। তবে আফ্রিকা, বিশেষ করে সাহারার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর জন্য ম্যালেরিয়া এক ভয়াবহ সমস্যা।  

মশাবাহিত অন্যতম একটি রোগ ম্যালেরিয়া; Image source: livescience.com

বিভিন্ন হিসেবে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় অর্ধ মিলিয়নের মতো মানুষ ম্যালেরিয়ার কারণে প্রাণ হারান। তাদের প্রায় সকলেই আফ্রিকার বাসিন্দা। মৃতদের অর্ধেকেরও বেশি পাঁচ বছর বা তার থেকে কম বয়সী শিশু।বিভিন্ন ওষুধ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরও মৃত্যুহারে খুব বেশি হেরফের হয়নি। এজন্য কার্যকরী একটি ভ্যাক্সিনের প্রয়োজনীয়তা অনেক আগে থেকেই অনুভূত হচ্ছিল।

ম্যালেরিয়া ভ্যাক্সিন

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ভ্যাক্সিন নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই কাজ করছিল। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে প্রায় একশ বছর ধরেই এই কাজ চলমান। ম্যালেরিয়ার ভ্যাক্সিন তৈরিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা যে এটি কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ নয়, এটি প্লাজমোডিয়াম নামে একরকমের পরজীবী (parasite) দ্বারা হয়ে থাকে। কোনো পরজীবীর বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন বানাবার নজির এখন অবধি ছিল না।

তবে বিজ্ঞানীরা বসে ছিলেন না। ম্যালেরিয়ার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে তারা নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এজন্য যে কাড়ি কাড়ি অর্থের প্রয়োজন তার যোগান দিচ্ছিল বিভিন্ন সংস্থা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদি।

ওষুধ প্রস্তুতকারকদের জগতে প্রতিষ্ঠিত নাম জিএসকে বা গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ম্যালেরিয়ার ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করছিল। তারা তৈরি করল মস্কুইরিক্স (Mosquirix), যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সক্ষমতা দেখায়। শুধু ম্যালেরিয়া নয়, যেকোনো পরজীবীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রথম ভ্যাক্সিন এই মস্কুইরিক্স।  

জিএসকে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করছে ম্যালেরিয়া ভ্যাক্সিন নিয়ে; Image source: europeanpharmaceuticalreview.com

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

জিএসকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখতে পায়- মারাত্মক রকমের ম্যালেরিয়া ঠেকাতে মস্কুইরিক্স প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কার্যকর। তবে এই কার্যকারিতা ভ্যাক্সিন প্রয়োগের প্রথম বছর বজায় থাকে। এরপর থেকে কমতে কমতে চতুর্থ বছরে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকে। এই ভ্যাক্সিন প্রয়োগে মৃত্যুহারের উপর কী প্রভাব পড়বে তা নিয়েও সরাসরি কোনো গবেষণা চালানো হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই অনেক বিশেষজ্ঞ জিএসকে-র ভ্যাক্সিন নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী ছিলেন না। তবে আর কোনো বিকল্প না থাকায় এটি নিয়েই তাদের কাজ করতে হয়। তাত্ত্বিক হিসেবে দেখা যায়, যদি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব আছে এমন দেশগুলোতে মস্কুইরিক্স ঢালাওভাবে শিশুদের দেয়া হয়, তাহলে বার্ষিক প্রায় ছয় মিলিয়ন রোগ এবং তেইশ হাজার মৃত্যু কমানো সম্ভব। এর উপর ভিত্তি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিয়া ভ্যাক্সিন বিষয়ক কার্যক্রমের কর্ণধার ড. মেরি হ্যামেল মন্তব্য করেছেন যে, মস্কুইরিক্স প্রয়োগের একই ইতিবাচক প্রভাব আমরা মৃত্যুহারে দেখতে পাব।  

ড মেরি হ্যামেল; Image source: youtube.com

মাঠপর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত

মস্কুইরিক্সের প্রাথমিক ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জিএসকের সাথে মিলিতভাবে কেনিয়া, মালাউই এবং ঘানাতে এই ভ্যাক্সিন প্রয়োগের ব্যবস্থা নেয়। এসব দেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় মস্কুইরিক্স। এ কাজে অর্থসাহায্য প্রদান করে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনেশনসহ আরও কয়েকটি দাতা সংস্থা।

মস্কুইরিক্স; Image source: crai.ub.edu

২০১৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ২৩ লাখ ডোজ মস্কুইরিক্স দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে টিকা পেয়েছে আট লাখের বেশি শিশু। মস্কুইরিক্সের চারটি ডোজ দেয়া হয়েছিল। প্রথম তিনটি পাঁচ থেকে সতের মাস বয়সের মধ্যে, শেষটি তৃতীয় ডোজের দেড় বছর পর।

এর বাইরে লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বিদ্যমান ম্যালেরিয়া ওষুধ ও ভ্যাক্সিন যৌথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুহার প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন

মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মস্কুইরিক্সকে ব্যাপক আকারে টিকাদান কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামের প্রধান ড পেদ্রো আলন্সো একে ঐতিহাসিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন ম্যালেরিয়া পরজীবীর বিরুদ্ধে বানানো এই অস্ত্র বিজ্ঞানকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ড টেদ্রোস আধানম ঘেব্রেসিয়াসও একে যুগান্তকারী বলে মনে করছেন। তার মতে ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ভ্যক্সিন ও অন্যান্য পদ্ধতির অনুসরণ বহু প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হবে, এবং এটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও সুলভ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মস্কুইরিক্স নিয়ে বেশ আশাবাদী; Image source: jamaicaobserver.com

সীমিত কার্যক্ষমতা থাকলেও বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন মস্কুইরিক্স দেখে অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখন ম্যালেরিয়া ভ্যাক্সিন তৈরিতে অধিক বিনিয়োগ খুঁজবে। গত ৫-৬ বছর ধরে ঝিমিয়ে পড়া এই প্রকল্পে সঞ্চারিত হবে নতুন গতি। লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক স্যার ব্রায়ান গ্রিনউডের মতে, যদিও মস্কুইরিক্স পরিপূর্ণ প্রতিরোধে সক্ষম নয়, তারপরেও ম্যালেরিয়া ঠেকাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এটি আলাদা গুরুত্বের দাবিদার।

পরবর্তী পদক্ষেপ

জিএসকে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে তারা ২০২৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন ডোজ মস্কুইরিক্স যোগান দিয়ে যাবে। দামও হবে বেশ কম, উৎপাদন খরচের থেকে মাত্র পাঁচ শতাংশ বেশি।

আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছেন। কীভাবে সুলভ মূল্যে মস্কুইরিক্স সব দেশে পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে।

অন্যান্য ভ্যাক্সিন

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৭৫ শতাংশ কার্যক্ষমতা প্রত্যাশা করে। যেহেতু মস্কুইরিক্স ব্যতিত আর কোনো ভ্যাক্সিন কোনো রকম সক্ষমতা দেখাতে পারেনি, তাই শিকে ছিড়েছে জিএসকের কপালে। তবে এই বছরের শুরুতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইন্সটিটিউটের গবেষকদল জানিয়েছেন, তারা এমন একটি টিকা বানাতে সক্ষম হয়েছেন যা আরো বেশি কার্যকর। বুরকিনা ফাসোতে এক বছর ধরে ৪৫০ জন শিশুর মধ্যে চালানো অক্সফোর্ডের গবেষণা দেখিয়েছে তাদের ভ্যাক্সিন প্রায় ৭৭ শতাংশের মতো কার্যকর। তারা এখন চারটি দেশে প্রায় পাঁচ হাজার শিশুর উপর গবেষণা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এর আগপর্যন্ত মস্কুইরিক্সই একমাত্র ম্যালেরিয়া ভ্যাক্সিন হিসেবে রয়ে যাবে।

Related Articles

Exit mobile version