‘ট্রেন টু বুসান’ সিনেমাটি দেখেছেন কি? ভয়ংকর একটি ভাইরাস আক্রমন করে মানুষের ব্রেইনে। এর ফলে লোকটি পাগল হয়ে যায়। তারপর সে অন্যদেরকেও কামড় দিতে চায়। যার শরীরে কামড় দেবে, তার শরীরেও ঢুকে পড়ে এই ভয়ংকর ভাইরাস। শরীরের শিরা-উপশিরা ঘুরে ব্রেইনে পৌছে যায় সেটা। আক্রান্ত মানুষকে পাগল বানিয়ে ফেলে। শুধু ‘ট্রেইন টু বুসান’ নয়, এই ধরনের ঘটনা বিভিন্ন জোম্বি সিনেমাতেই দেখা যায়, নির্দিষ্ট কোনো অনুজীব সুস্থ মানুষদের দেহে প্রবেশ করে তাদেরকে মেরে ফেলছে বা অন্যভাবে তাদের ক্ষতি করছে।
বাস্তব পৃথিবীতে ও মনে হয় এই ধরনের একটা অনুজীবের সন্ধান পাওয়া গেল! একটা গল্প বলি, শুনুন।
৫৯ বছর বয়সী এডি গ্রে থাকেন আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনাতে। এই বয়সেও শরীর বেশ ফিট। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই লোকটি ভালবাসেন পানিতে ছোটাছুটি করতে। কায়াকিং, স্কিয়িং এবং ডাইভিং-এর নেশা রয়েছে তার। একটু অবসর পেলেই ছুটে যান পানিতে ঝাপাঝাপি করতে।
২০১৯ সালের ১২ জুলাই গিয়েছিলেন কাম্বারল্যান্ড কাউন্টির ফ্যান্টাসি লেক ওয়াটার পার্কে। সারাদিন পানিতে দাপাদাপি করে নর্থ ক্যারোলাইনার বাসায় ফিরলেন ভালভাবেই। কিন্তু পরদিন থেকেই হালকা মাথব্যথা আর জ্বর টের পাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে তেমন পাত্তা দেননি, কিন্তু সমস্যা বাড়তে থাকলে ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তাররাও জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ডেঙ্গুর মতো কিছু ভেবেছিলেন। সেভাবেই চিকিৎসা চলছিল তার, কিন্তু উন্নতি হচ্ছিল না।
একপর্যায়ে তার CSF (cerebrospinal fluid) টেস্ট করা হলো। এই টেস্টটি করার জন্য রোগীর স্পাইনাল কর্ডের ফাঁকে ফাঁকে জমা তরল পদার্থ সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিকে লাম্বার পাংচার বলে। রেজাল্ট আসলে দেখা গেল, এডি গ্রে খুবই বিরল একটি রোগে আক্রান্ত। দুর্লভ প্রজাতির একটি অ্যামিবা বাসা বেধেছে তার ব্রেইনে। আন্ডাবাচ্চা ফুটিয়ে বিশাল কলোনি বানিয়ে ফেলেছে। এই অ্যামিবাগুলো মস্তিষ্কের নিউরন কোষগুলো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে! মেডিকেলের পরিভাষায় এই রোগকে বলে Primary Amoebic meningoencephalitis (PAM)।
আমরা জানি, অ্যামিবা ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার মতোই ক্ষুদ্রাকৃতির এক জীব। তবে এরা ভাইরাসদের মতো পরজীবি না। বেঁচে থাকার জন্য অন্য প্রাণীর দেহে আক্রমণ করতে হয় না। নিজেরাই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তাহলে এই অ্যামিবা ব্রেইনে গেল কীভাবে?
জানা গেল, এই প্রজাতির অ্যামিবাগুলো (নাম Naegleria fowleri) মিষ্টি পানি-কাদার মধ্যে থাকে। পুকুর, লেক, নদী বা দীঘি এদের জন্য খুবই উপযুক্ত জায়গা। স্বাভাবিক অবস্থায় সেখানেই থাকে, কাদার ভেতরের বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু কোনো মানুষ পানিতে নেমে সাতার কাটলে খুবই বিরল কিছু ক্ষেত্রে তার নাকের মধ্য দিয়ে ঢুকে যেতে পারে এই অ্যামিবা।
তারপর নাক বেয়ে বেয়ে ব্রেইনে চলে যায়। সেখানেই বাসা বাধে। ব্রেইনের মধ্যে তো আর ব্যাকটেরিয়া নেই। তাই চোখের সামনে যা পায়, সেই নিউরন এবং স্নায়ুকোষগুলোই খেতে থাকে। আর তখনই ঘটে PAM।
আক্রান্ত রোগী জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথা, বমি ছাড়া আর কোনো উপসর্গ দেখায় না। এই রোগের আপাত কোনো চিকিৎসা নেই। Miltefosine নামক একটি ওষুধ বেশ ব্যবহৃত হয়, যদিও কার্যকারীতা প্রমাণিত নয়।
কোনো চিকিৎসাতেই কাজ হলো না এডি গ্রের। ১০ দিন পরে, ২২ জুলাই ২০১৯ তারিখে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
এর কিছুদিন পরে, সেপ্টেম্বর মাসে টেক্সাসে ১০ বছর বয়সী আরেক মেয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। তার বেলাতেও প্রথমে ‘ভাইরাসঘটিত জ্বর’ ভেবে ওষুধ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু জ্বর সারছিল না বলে তার স্পাইনাল ট্যাপ টেস্ট করা হলো। দেখা গেল, তার টিস্যুতেও মগজখেকো অ্যামিবা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১১ দিনের মাথায় সে-ও মারা যায়।
১৯৬০ এর দশকে প্রথম এই রোগে আক্রান্ত রোগী খুঁজে পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়। তবে পরবর্তীতে আমেরিকায় একই রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেল অনেক। রোগটি সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৬২ এর পর এতদিনে ১৪৩টির মতো কেস পাওয়া গেছে। তবে রোগটি খুব বেশি প্রাণঘাতী। এ পর্যন্ত মাত্র ৪ জন প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।
কিছুদিন আগে ফ্লোরিডায় এই রোগে আক্রান্ত নতুন এক রোগী পাওয়া গেছে। এরপর পত্র-পত্রিকায় আবার এই অ্যামিবা আলোচনায় উঠে এসেছে। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলেই এই রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী পাওয়া যাচ্ছে। শুধু ফ্লোরিডাতেই ১৯৬২ থেকে এ পর্যন্ত ৩৭ জন পাওয়া গিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী সব এলাকার অ-লবণাক্ত পানিতেই নাইগ্লেরিয়া ফাওলেরি বেঁচে থাকতে পারে। তবে আমেরিকা বাদে অন্য এলাকায় এই রোগের কথা কম শোনা যায়। হতে পারে অন্য জায়গার মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্তু শনাক্ত হচ্ছে না।
পাকিস্তানে কমপক্ষে ১২ জন এই রোগে মারা গিয়েছে। পাকিস্তান বা অন্যান্য মুসলিম বিশ্বের জন্য এই রোগ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কারণ ইসলাম ধর্মে নামাজসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধর্মচর্চার জন্য ওজু করার যে বিধান রয়েছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে পানি নাকে দিতে হয়। পানিতে যদি নাইগ্লেরিয়া ফাওলেরি থাকে, তাহলে সেটা নাকে ঢুকে পড়তে পারে। এজন্য আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিডিসি পরামর্শ দিয়েছে, ওজুর পানি নাকে দেওয়ার পূর্বে ফুটিয়ে নিতে বা ক্লোরিন দ্বারা জীবানুমুক্ত করে নিতে।
গভীর নলকূপের পানিতে এখন পর্যন্ত এই অ্যামিবা পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকশো ফুট গভীর কূপের পানিতেও পাওয়া গেছে এদের। ভারত এবং থাইল্যান্ডেও জানা গেছে এই অ্যামিবার সংক্রমণের ঘটনা। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই অ্যামিবায় আক্রান্ত কারো খবর জানা যায়নি।
ভাল খবর হচ্ছে, করোনার মতো এই অ্যামিবা সংক্রামক না। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় না। শুধুমাত্র যাকে আক্রমণ করেছে, তারই ক্ষতি করবে। আশেপাশের লোকেরা নিরাপদ থাকবে। ডাক্তাররা এই অ্যামিবা থেকে বাঁচার জন্য কিছু উপদেশ দিয়েছেন।
১) জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসেই আমেরিকায় এদের সংক্রমণ দেখা যায়। আমেরিকার ডাক্তাররা এই তিন মাস পুকুর বা নদীতে সাঁতার কাটতে নিষেধ করেন।
২) সাঁতার কাটলেও নাকে প্রোটেকশন নিতে হবে যেন কোনোভাবেই নাকের মধ্যে পানি না ঢোকে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের নোজ প্লাগ কিনতে পাওয়া যায়। সাগরের নোনাপানিতে সাঁতার কাটলে অবশ্য কোনো ভয় নেই।
৩) পুকুরের কাদা কিংবা পলির মধ্যে এই অ্যামিবাগুলো থাকে। সেই কাদার মধ্যে যাওয়া উচিত না। কিংবা পানিতে এমনভাবে লাফালাফি করতে হবে যেন কাদা ছিটকে না ওঠে। কাদার স্তর পরিবর্তন হলে অ্যামিবাগুলো কাদা থেকে উঠে পানির উপরের অংশে চলে আসে। তখন মানুষের নাকে চলে যায়।
৪) ওজু বা অন্য কোনো ধর্মীয় কাজে নাকে পানি দিতে হলে ফুটানো পানি ব্যবহার করা উচিত।
৫) নেটি পটের মতো চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে নাকে পানি দিতে হলে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।