মন ভালো রাখার নিত্যদিনের ঔষধ

মানুষের জীবনযাত্রা আজকের যুগে যন্ত্রের মতো। নিত্যদিনের কাজের চাপ, ক্যারিয়ারের উন্নতির চিন্তা, কাজের জায়গায় বিভিন্ন মতের মানুষের অসঙ্গতি, আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সাংসারিক কাজে, পরিবারের মনোমালিন্য, চাপ- সবদিক সামলে নিজের ভালো থাকাটা আজকের দিনে গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন নিজের প্রতি খেয়াল রাখার সময় হয়ে না উঠলেও একসময় তার প্রভাব শরীর ও মনে বেশ প্রভাব ফেলে। হতাশা, কাজে অনিচ্ছা, শারীরিক অসুস্থতা সব যেন তারই প্রতিচ্ছবি।

মন আর শরীর একই সূত্রে বাঁধা। মনের হতাশা বিরুপ প্রভাব ফেলে মানুষের শরীরেও। আবার কাজও মানুষের জীবনে অপরিহার্য। কাজের অভাবেও একাকীত্ব মানুষকে গ্রাস করে ফেলে। তাই সুস্থ মনের অধিকারী হতে প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে একান্ত নিজের জন্য কিছু সময় রাখা উচিৎ। সেসময় পছন্দের কোনো কাজ বা অপূর্ণ কোন শখ পূরণ মানুষের সারাদিনের ক্লান্তি মুছে দিতে সক্ষম। তাই প্রতিদিনের কাজের ফাঁকে রুটিন করে ফেলা উচিৎ এমন কিছু কাজ যা আপনার মনকে চনমনে করে তুলতে পারে নিমেষেই। 

shobshomoy.com

দৈনন্দিন কাজের রুটিন

কাজের দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেও ছুটির দিনগুলোর সকালবেলা বিছানা ছেড়ে ওঠা হয় না অনেকেরই। কিন্তু এই অতিরিক্ত ঘুমই সারাদিনের সতেজতা কেড়ে নেয় অনেক সময়। আবার হঠাৎ করেই রাত জাগলে পরদিন ঘুমের ঘাটতি থাকায় শরীরে ক্লান্তি থেকে যায়। ফলে কাজে অনিচ্ছা চলে আসে আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় হতাশা। তাই প্রতিদিনের মনের প্রশান্তি আর শরীরের সুস্থতার অন্যতম কার্যকরী ঔষধ হলো নিয়মমাফিক ঘুম। এছাড়াও সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে সারদিনের খাওয়া, অন্যান্য কাজের রুটিন করে নেওয়া, কোনো কাজ বিনা কারণে ফেলে না রাখা মানুষের মনের প্রশান্তি বজায় রাখে। ফলে মনের সাথে সাথে শরীরও চনমনে থাকে সবসময়। 

Source: jd.com

যোগব্যায়াম 

যোগব্যায়াম কেবল শরীরের নয়, মনের সতেজতা ধরে রাখতেও কার্যকরী উপায়। মাত্র পাঁচ মিনিট ব্যায়াম করলেই মানব শরীর থেকে এন্ড্রোফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, যা প্রায় ১২ ঘন্টা মন সতেজ রাখতে সক্ষম। এর জন্য কষ্ট করে জিমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘরোয়াভাবেই অনেক ব্যায়াম করা যায় যা শরীরের জন্য উপযোগী। ব্যায়াম শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের পরিমাণ কমায়, শরীর সুঠাম রাখে আর খাবার হজমেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

দিনের শেষে হালকা যোগব্যায়াম মনের অবসাদ দূর করে মানুষের সারাদিনের কাজের স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। যার ফলে অন্যান্য কাজেও মনোযোগ ফিরে পাওয়া যায়। বয়স্ক মানুষের জন্য ব্যায়াম সঠিক পদ্ধতি নয়। সেক্ষেত্রে দিনে দুবার ১০ মিনিট হাঁটলেও চাপ কমে ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। 

Source: youtube.com

বাগান করা 

শহরের ইট-কাঠ ঘেরা দালানে সবুজের খুবই অভাব। খোলা আকাশের নিচে দুপাশে ঘন গাছপালা পেরিয়ে হেঁটে যাওয়া এখন যেন স্বপ্নের মতো। কিন্তু চাইলেই একটুখানি হাতের ছোঁয়ায় আমাদের বাড়ির বারান্দা কিংবা ছাদই হয়ে উঠতে পারে নন্দন কানন। এমনকি টি-টেবিলের উপর, জানালার গ্রিল, দরজার দুপাশে বিংবা বাথরুমের ভেন্টিলেটরেও গাছ লাগালে একদিকে যেমন ঘরের সৌন্দর্য বাড়ে তেমনি সেগুলোর রুপ দেখে মনও প্রফুল্ল থাকে সারাদিন।

বাগান পরিচর্যা কষ্টসাধ্য মনে হলেও আসলে দিনের কিছুটা সময় দিলেই অনেক সুন্দরভাবে বাগান তৈরি করা সম্ভব। পড়ন্ত বিকেলে গাছের আশেপাশে পায়চারী কিংবা পাশে বসে পছন্দের বই পড়ে সময় কাটানো, গাছে পানি দেওয়া বা আগাছা পরিষ্কারে সময় দিলেই দেখা যায় তার প্রভাব মনের উপরেও পড়ে। গাছে নতুন ফুলের কলি দেখেও হৃদয় খুশিতে ভরে যায়। সেই সাথে নিমেষেই গায়েব হয়ে যায় সারাদিনের ক্লান্তিভাব। 

Source: extrm.us

খাবার নির্ধারণ 

শরীর সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। কিন্তু খাবারের প্রভাব কেবল শরীরেই নয়, থাকে মনেও। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও গবেষণায় দেখা গেছে এমন কিছু খাবারও আছে যা মানুষের মন খারাপ করে দেয়। এর ভেতর আছে রিফাইন্ড বা পরিশোধিত চিনি, যা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। ফলে একধরনের ঘোরের সৃষ্টি হয় বলে মন বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়। কাজে মনোযোগ কমে যায়, এমনকি ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন রকম ফাস্ট ফুড, যেমন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, বার্গার সাধারণত যে তেলে ভাজা হয় সেটা ‘ট্রান্স ফ্যাট‘ নামক এক উপাদান বহন করে যা মন বিষণ্ণ করে তুলতে ভীষণভাবে দায়ী।

অনেক ধরনের সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার মানুষের স্নায়ুর কার্যক্রম ব্যাহত করে। আবার অধিক ক্যাফেইন সেবন করলেও তা মনের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঘুমের ব্যাঘাত হয়, যার ফলে সকল কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন রকম শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস রাখা উচিৎ। এছাড়া মন ভালো রাখার অন্যতম কার্যকরী ঔষধ হলো ডার্ক চকলেট। 

Source: Hollywood Bangla News

শখ পূরণ

প্রতিটি মানুষের মাঝেই নিজস্ব কিছু ইচ্ছা বা ভালোলাগার কাজ থাকে। কেউ রান্না করতে পছন্দ করে, কেউ হাতের সেলাইয়ে নিজেকে খুঁজে পায়, আবার অনেকে গল্প-উপন্যাসের বই পড়েই রাত কাটিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। কাজের চাপে ইচ্ছাগুলো হয়ত পূরণ করার সময় হয়ে ওঠে না। একটা সময় পর নিজেকে খুঁজে পায় না ব্যস্ততার ভিড়ে, পাল্টে যায় জীবনযাত্রা। তখন ভালোলাগাগুলো হারিয়ে যায়। আর সেটাই হয়ে ওঠে মানুষের হতাশার কারণ।

তাই প্রথম থেকেই খুব অল্প হলেও সময় দিতে হবে নিজেকে। বিকালের মিষ্টি রোদে বই নিয়ে কিছুক্ষণ পড়া, সুই-সুতার ফোঁড়ে নিজের ভিতরকে ফুটিয়ে তুলে বা পছন্দের কোনো খাবার রান্না করা নিজের মনকে স্বচ্ছ রাখার জন্য অনেক উপযোগী। এছাড়া কিছুটা সময় নিজের যত্নে ব্যবহার করা, নিজেকে পরিচ্ছন্নভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করা, চুল ও ত্বকের যত্ন নেওয়া, মেডিটেশন করা নিজেকে ভাল রাখার ঔষধ হিসেবে কাজ করে। 

ডায়েরি লিখুন

মানুষের জীবনের এমন অনেক না বলা কথা থাকে যা প্রতিনিয়ত তাকে আঘাত করে মানসিকভাবে। নিত্যদিনের এ যন্ত্রণাদায়ক কথাগুলো ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলুন। চোখের সামনে ঘটনাগুলো আসলে অনেক সময় তার সমাধানও পাওয়া যায় সহজেই। অনেক মন খারাপের সময়গুলোতে অতীতের পাতা উল্টালে ভালো মুহূর্তগুলোও মনে পড়ে যায়। অনেক সমস্যার সমাধানও খুঁজে পাওয়া যায় ফেলে আসা সমস্যাগুলোর মাঝেই। ফলে বর্তমানের দুশ্চিন্তা কমে মন হালকা হয়ে যায়। 

Source: bangka.tribunnews.com

প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো

পছন্দের মানুষের সাথে সময় কাটালে অজান্তেই মানুষের মন হালকা হয়ে যায়। মনের অস্থিরতা কমাতে ‘অক্সিটোসিন হরমোন’ বিশেষ প্রয়োজন, যা কেউ কাছের মানুষের সান্নিধ্যে লাভ করে। মা-বাবা অথবা সঙ্গী কিংবা কাছের বন্ধুর আলিঙ্গনে এই হরমোন অধিক নিঃসরণ হয়, ফলে মানুষের চাপ কমে যায়। এছাড়াও প্রিয়জনের সাথে গল্প করা, কোথাও বাইরে ঘুরতে যাওয়া, শপিং করার মতো কাজগুলো মুহূর্তেই মানুষের হৃদয় আনন্দে ভরে দেয়। 

Source: radiocamila.com

সমাজসেবামূলক কর্মকান্ড

অন্যের সাহায্যে নিজেকে নিয়োজিত করলে মানুষ যে আত্মতৃপ্তি পায় তা তার মানসিক শান্তি রক্ষায় যথেষ্ট। সপ্তাহে বা মাসে একটা দিন হাতে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রম বা অনাথাশ্রমে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালে, বৃদ্ধদের সেবায় নিয়োজিত হতে পারলে, তাদের জামাকাপড় বা প্রয়োজনীয় উপহার দিলে তাদের মুখে যে হাসি দেখা যায় সেই হাসির প্রভাবে মানুষের অজান্তেই মন শান্ত হয়ে যায়। তাই সময় করে এমন কিছু কাজে নিজেকে নিয়োজিত করুন যা অপরের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম। 

জীবনে চলতে গিয়ে অনেক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সবসময় মন ভালো থাকবে এমনটাও নয়। বিভিন্ন পরিস্থিতি মানুষের মনকে বিচলিত করে, বিষণ্ণ করে তোলে। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতেই মন স্থির রেখে সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে। আর মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল রপ্ত করলে হতাশা, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা গ্রাস করতে পারবে না আমাদের। সারাদিনের চাপ সেদিনই মুছে ফেলে নতুন করে আবার শুরু করতে হবে। তাই দৈনন্দিন কাজের তালিকায় ভালোলাগার কাজগুলোকেও জায়গা দিতে হবে। তাহলে কাজেও আনন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে আর জীবন থাকবে স্বচ্ছ, নির্মল ও শান্তিতে ভরপুর। 

ফিচার ইমেজ- Daily Bangladesh

Related Articles

Exit mobile version