বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। একাধারে যেমন চীনকে ছাপিয়ে ইতালি, স্পেনের মতো দেশগুলোতে লাশের মিছিল বেড়ে চলেছে, তেমনই করোনার করালগ্রাসে আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দি হচ্ছে বিশ্বের উন্নত থেকে শুরু করে স্বল্পোন্নত, অনুন্নত সব দেশের জনগণই। সব মিলিয়ে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, গোটা বিশ্বই যেন হঠাৎ করে থমছে গেছে, হয়ে পড়েছে স্থবির।
কিন্তু না, বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। এখনো অনেক দেশই, কিংবা বলা ভালো অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই, আমলে নিচ্ছেন না করোনার তাণ্ডবকে। এখনো ‘কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে’ মনোভাব পোষণ করে চলেছেন তারা। ক্রমাগত খাটো করে যাচ্ছেন করোনার ভয়াবহতাকে।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো বলছেন, ‘সামান্য একটা ফ্লু’ দিয়ে দেশের জনসাধারণকে বোকা বানাচ্ছে গণমাধ্যম। সকলের উচিৎ এখনো সপরিবারে বাইরে খেতে যাওয়া, বিশ্বাস মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরের। আর নিকারাগুয়ার নেতা ড্যানিয়েল ওরতেগা? তিনি তো রীতিমতো উধাও হয়ে গেছেন। কোথাও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না তার, যদিও দেশটিতে রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ চলছে আপন গতিতেই।
অধিকাংশ বিশ্বনেতাই যখন করোনাভাইরাসের হুমকি মেনে নিয়ে নিজ নিজ দেশের মানুষকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষায় যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন ঠিক এভাবেই ব্রাজিল, মেক্সিকো ও নিকারাগুয়ার নেতারা উড়িয়ে দিচ্ছেন করোনার আতঙ্ককে। ফলে উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে এসব দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ। একবার যদি এই দেশগুলোতে করোনাভাইরাস আরো বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন পড়েছে ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলোতে, তাহলে যে ঠিক কী হতে পারে তা অনুমান করে নেয়া যায় সহজেই।
ব্রাজিল
একদম শুরু থেকেই যেন করোনাভাইরাসের ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ নেই ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোর। তার মতে, এই নভেল করোনাভাইরাস আসলে ‘ওভাররেটেড’, তাই এটিকে ‘সিরিয়াসলি’ নেয়ার কিছু হয়নি।
তবে ১২ মার্চ যখন খবর এলো যে বলসোনারোর প্রেস সচিবও আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড-১৯ রোগে, তখন অনেকের মনেই জ্বলে উঠেছিল আশার আলো: এবার বুঝি প্রেসিডেন্ট গুরুত্ব সহকারে দেখবেন বিষয়টিকে।
কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি! গত রবিবার (২২ মার্চ) আবারো টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে এসে প্রেসিডেন্ট করোনাভাইরাসকে আখ্যায়িত করেন ‘একটি সামান্য ফ্লু’ হিসেবে। রেকর্ড টিভিতে লক্ষ লক্ষ দর্শকের সামনে তিনি বলেন:
“জনগণ খুব শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারবে যে করোনাভাইরাসের কথা বলে তাদেরকে বোকা বানাচ্ছে কিছু গভর্নর এবং গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ।”
এখানে ‘কিছু গভর্নর’ বলতে তিনি ইঙ্গিত করেন সাও পাওলো ও রিও ডি জানেইরোর গভর্নরদের দিকে, যারা নিজ নিজ রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
এই জরুরি অবস্থা জারির পেছনে ওই গভর্নরদের বেশ যুক্তিসঙ্গত কারণও কিন্তু রয়েছে। এখন পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিলেই সবচেয়ে বেশি কেস রেকর্ড হয়েছে। ২,২৭১ জন আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ইতোমধ্যেই মারা গেছেন ৪৭ জন, বিপরীতে সেরে ওঠার সংখ্যা মাত্র ২!
সৌভাগ্যের বিষয় হলো, কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ গৃহীত না হলেও, ব্রাজিলের স্থানীয় প্রশাসন ঠিকই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। ফুটবল স্টেডিয়াম ও কনভেনশন সেন্টারগুলোকে তারা রূপান্তরিত করছে সাময়িক হাসপাতাল হিসেবে। জনসমাগম নিষিদ্ধের পাশাপাশি বন্ধ করে দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শপিং মলগুলোকেও।
ব্রাজিলের সাধারণ মানুষও থেমে নেই। বলসোনারোর প্রতি নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশের এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তারা। প্রতিদিন রাত ৮টা ৩০ মিনিটে জানালার কাছে কিংবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাসনকোসনে বাড়ি মেরে তুমুল শব্দ করছে তারা।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট যে কানে তালা লাগিয়ে বসে আছেন, তাই বোধহয় এসব ধ্বনির কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না তিনি, বরং অতি সম্প্রতি দেশবাসীর প্রতি নতুন করে আহ্বান জানিয়েছেন কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার!
মেক্সিকো
ব্রাজিলিয়ান প্রেসিডেন্টের মতোই শুরু থেকে একই মনোভাব মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরেরও। গত ৪ মার্চ যখন তাকে জানানো হয় যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাময়িকভাবে পারস্পরিক শারীরিক সংযোগ পরিহার করতে হবে, সেটির তীব্র প্রতিবাদ জানান তিনি।
সংবাদকর্মীদেরকে তিনি বলেন, “তোমাদের পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে হবে। কিছুই হবে না এতে।” তার মতে, একটি জিনিসকেই কেবল ‘আলিঙ্গন’ করা যাবে না। সেটি হলো করোনাভাইরাস নিয়ে যাবতীয় ভয়ভীতি!
এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। দিন দশেক পর, যখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে গেছে, তখন তিনি সবাইকে নতুন করে চমকে দেন একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে।
সেই ভিডিওতে দেখা যায়, অসংখ্য সমর্থক ঘিরে রেখেছেন ওব্রাদরকে। তিনি তাদের সবার সাথে আলিঙ্গন তো করেনই, পাশাপাশি চুমু খেয়ে বসেন একটি শিশুকেও।
এর দুইদিন পর তিনি দুইটি অ্যামুলেট হাতে ধরে সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেন, এবং বলেন এই অ্যামুলেট দুইটিই তাকে রক্ষা করবে ভাইরাস থেকে।
তবে ওই অ্যামুলেটদ্বয় এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টকে রক্ষা করতে পারলেও, পারেনি মেক্সিকোর ৪০৫ জন মানুষকে রক্ষা করতে। তাদের মধ্যে ৫ জন ইতোমধ্যে মারাও গেছেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ওব্রাদর কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছেন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি। সবাইকে ঘরে থাকতে আহবান জানাচ্ছেন তিনি। জানিয়েছেন, তার ক্যাবিনেট কাজ করবে বিপদগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য, সহায়তা করবে ছোট ব্যবসাগুলোকেও। এছাড়া ১০০ বা তার বেশি মানুষের জনসমাগমকে নিষিদ্ধও করেছেন তিনি।
তবে ঠিক যখন মেক্সিকোর মানুষ মনে করেছিল এবার কেন্দ্রীয়ভাবে করোনার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, ঠিক তখনই নতুন একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্ট, যেখানে তার কথা শুনে হকচকিয়ে যান অনেকেই। তিনি বলেন,
“আমরা মোটেই ভালো কিছু করছি না, এবং কোনো কল্যাণও করছি না, যদি আমরা অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকি এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাই (অর্থনৈতিকভাবে)। তাই চলুন আমরা সাধারণ জীবনযাপন অব্যহত রাখি।”
এই ভিডিওতে ওব্রাদর সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেও।
প্রেসিডেন্টের হঠাৎ করে এমন মতবদলের মতো, ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে মেক্সিকোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও। এখন পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসের নিশ্চিত কেস ৪০৫ হলেও, সম্ভাব্য আক্রান্তের সংখ্যা আরো প্রায় আড়াই হাজার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশটিতে এখনো যেহেতু করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, তাই প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশিও হতে পারে।
কেন্দ্রীয়ভাবে তেমন কোনো গুরুতর পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায়, মেক্সিকোর স্থানীয় প্রশাসনগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁধেও চেপেছে গুরুদায়িত্ব। যেমন গত সোমবার (২৩ মার্চ) মেক্সিকো সিটি বন্ধ করে দিয়েছে সকল বার, নাইট ক্লাব এবং মুভি থিয়েটার। একসাথে ৫০-এর বেশি মানুষের জনসমাগমেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা। অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনেকেই ভিড় জমাচ্ছেন রাস্তাঘাট, সী-বিচ ও রেস্তোরাঁয়।
নিকারাগুয়া
পশ্চিমা গোলার্ধ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে, করোভাইরাসের ফলে প্রবল ঝুঁকির মুখে রয়েছে নিকারাগুয়া। এখন পর্যন্ত দেশটিতে চিহ্নিত করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২ হলেও, বাস্তবিক সংখ্যাটি আরো বেশি কি না, এবং বেশি হলে কী পরিণতি দাঁড়াবে, এ নিয়ে জনমনে তীব্র ভীতি সঞ্চার হয়েছে। তাছাড়া জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে সরকারিভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, এবং প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল ওরতেগার ‘উধাও’ হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করেও।
বিশ্ব গণমাধ্যমে করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে ব্যাপক প্রচারণার ফলে, এ ব্যাপারে অন্ধকারে নেই নিকারাগুয়ার সাধারণ মানুষও। নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা সচেতন থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ কোস্টারিকায় প্রথম কেস ধরা পড়ার পর থেকেই অনেকে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকতেও শুরু করে দিয়েছেন।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দেশটির সরকারের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই এ ব্যাপারে। তারা নিয়মিতই রাজনৈতিক সকল সভা-সমাবেশ আয়োজন করে চলেছে, যেগুলোতে ঘটছে বিপুল জনসমাগম।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ওরতেগা নিজে জনসম্মুখে আসছেন না, বরং ঠেলে দিচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট রোজারিও মুরিলোকে। কিন্তু মুরিলোও যে খুব একটা আশার আলো দেখাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। বরং তিনি জনগণকে উপদেশ দিচ্ছেন বিপদের মুখের ‘ধর্মের কাছে সাহায্য প্রার্থনার’। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা ডিজিটাল ১৯-এ তিনি বলেন:
“আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি শান্তভাবে…দায়িত্বশীলতার সাথে, এবং সব কিছুর উর্ধ্বে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রেখে, এ কথা জেনে যে বিশ্বাসই পারে আমাদেরকে রক্ষা করতে ও বাঁচাতে।”
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশটির যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। তারা প্রধানত দুইটি কাজ করেছে। প্রথমত, জনসাধারণের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি প্রচারণা চালাতে শুরু করেছে, যেখানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হচ্ছে মানুষকে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করতে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী পর্যটকদের উপর খানিকটা নজরদারি চালাচ্ছে তারা। বিশেষত যেসব অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বিদেশী পর্যটকের আনাগোনা থাকে, সেসব স্থানে কিছুটা তৎপরতা দেখাচ্ছে প্রশাসন।
তবে এই যে সরকার কর্তৃক বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো হচ্ছে, এ বিষয়টি নিয়েও জনমনে পুঞ্জীভূত হয়েছে ক্ষোভ। কেননা ওই স্বাস্থ্যকর্মীদের কারো মুখেই থাকছে না মাস্ক। তাই অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, নিজেরা বাড়ির বাইরে পা না রাখলেও, হয়তো স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকেই তাদের শরীরেও সংক্রমিত হবে করোনাভাইরাস। এই ভয় থেকেই অনেকে স্বাস্থ্যকর্মীর আগমন টের পেয়েও দরজা খুলছেন না।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকারাগুয়ার স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। তাই একবার যদি কোনোভাবে দেশটিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে গোটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে, পথ প্রশস্ত করে দেবে বড় ধরনের বিপর্যয়ের। আর যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে এই বৈশ্বিক মহামারী রোধে আগাম কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি, তাই পুরোপুরি দায়ী থাকবে তারাই।