আমাদের দেহের কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইডকে ফুসফুসে ফিরিয়ে নিয়ে আসার মতো মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে রক্তের প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন লোহিত রক্তকণিকা। তবে এরা কাজ করতে করতে একসময় বুড়ো হয়ে যায়, ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। দেখা গেছে যে, একটি লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিনের মতো। তাহলে এর পরে কি হয়?
লোহিত রক্তকণিকা তার পূর্ণ জীবনকাল কাটানোর পরে যকৃত ও প্লিহা’র মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঙ্গে যায়। তখন লোহিত রক্তকণিকা তার গাঠনিক উপাদানে বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। লোহিত রক্তকণিকা প্রথমে দুভাগে ভাগ হয়ে তৈরি হয় হিম আর গ্লোবিন। গ্লোবিন হল একধরনের প্রোটিন, যা ক্যাটাবলিজম প্রক্রিয়ায় এমিনো এসিডে পরিণত হয়।
সবরকম প্রোটিনের গাঠনিক উপাদান হল এমিনো এসিড। একের পর এক এমিনো এসিড পরস্পরের সাথে জুড়ে গিয়ে তৈরি হয় নানারকম প্রোটিন। গ্লোবিন থেকে উৎপন্ন এমিনো এসিডকে পুনরায় আমাদের দেহ রি-সাইক্লিং প্রক্রিয়ায় নতুন প্রোটিন তৈরিতে ব্যবহার করে।
বাকি থাকলো হিম। এটি আবার দু’ভাগে ভাগ হয়- একটি লৌহ আর অপরটি বিলিভারডিন। লোহা রক্তের প্লাজমায় ঘুরতে থাকে যতক্ষণ না ট্রান্সফেরিন নামের একটি প্রোটিন তাকে কবজা করে নিচ্ছে। তারপর এটিকে নিয়ে আবার পৌঁছে দেয় অস্থিমজ্জায়, সেখানে এরা আবার লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
অপরদিকে বিলিভারডিন দেহের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না, তাই তাকে দেহ থেকে বের করে দেওয়াই হয় পরবর্তী লক্ষ্য। কিন্তু বিলিভারডিন পানিতে অদ্রবণীয়। তাই তাকে দেহ থেকে বের করে দেওয়া বেশ অসুবিধার। বিলিভারডিন প্রথমে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিলিরুবিনে রূপান্তরিত হয়। এটিও পানিতে অদ্রবণীয়। এখন দেহ থেকে বাইরে বের করতে হলে একে যেকোনো উপায়ে পানিতে দ্রবণীয় করতে হবে। এজন্য একটি উপায় আছে- এই বিলিরুবিনকে যকৃতে গিয়ে গ্লাইকুরোনিক এসিডের সাথে সংযুক্ত হতে হবে! তাহলেই কেল্লাফতে!
কিন্তু সেজন্য তো একে যকৃতে পৌছাতে হবে! এই উদ্দেশ্যে বিলিরুবিন অ্যালবুমিন নামক একটি প্রোটিনের ঘাড়ে চেপে পৌঁছে যায় যকৃত বা লিভারে। ভালো কথা, মুরগীর ডিমের সাদা অংশে যে প্রোটিন থাকে, তা কিন্তু এই অ্যালবুমিনই। আবার আমাদের রক্তের প্লাজমা বা রক্তরসের প্রোটিনের অর্ধেকের বেশি প্রোটিন হলো এই অ্যালবুমিন।
যা-ই হোক, যকৃতকোষে বিলিরুবিন গ্লাইকুরোনিক এসিডের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে ডাইগ্লুকোরোনাইডে পরিণত হয়। তারপর পিত্তরসের উপাদান হিসেবে পিত্তথলিতে জমা হয়। শেষে উন্মুক্ত হয় অন্ত্রে। অন্ত্র থেকে মলের মাধ্যমে দেহ থেকে বাইরে নিষ্কাশিত হয় এই বিলিরুবিন।
সত্যি বলতে কি, আমাদের মলের হলদেটে রংয়ের জন্য এই বিলিরুবিনই দায়ী। অবশ্য তখন আর তার নাম বিলিরুবিন থাকে না, তার নাম হয়ে যায় স্টারকোবিলিন। অনুরূপভাবে অন্ত্র থেকে কিছু বিলিরুবিন শোষিত হয়ে কিডনির দিয়ে মূত্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে আসে। সেক্ষেত্রে তার নাম থাকে ইউরোবিলিন।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিলিরুবিন ঠিকঠাক মতো দেহ থেকে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে না। তখন বেধে যায় ঝামেলা। এগুলো তখন ত্বকের নিচে, কেরাটিন যুক্ত প্রত্যঙ্গ যেমন চোখের স্ক্লেরা, পায়ের পাতা, হাতের তালুতে জমা হয়। এসব স্থানের রঙ তখন হলুদাভ হয়ে যায়। দেহের এই অবস্থাকেই আমরা জন্ডিস বলে থাকি।
তবে জন্ডিস আসলে নিজে রোগ হিসেবে ততটা ভয়ঙ্কর নয়, ভয়ঙ্কর হলো তার পিছনে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো। জন্ডিস আসলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে। আমাদের সতর্ক করে দেয়, শরীরে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই গোলমাল যকৃতের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে। এছাড়া অন্যান্য সমস্যার ফলাফল হিসেবেও জন্ডিস হতে পারে।
আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জন্ডিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলো। পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস আছে- হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই। তবে উন্নত দেশগুলোতে মদ্যপান জন্ডিসের প্রধান কারণ। লম্বা সময় ধরে মদ্যপান করলে ধীরে ধীরে যকৃতের সিরোসিস হয়ে যায়, তখন যকৃত তার স্বাভাবিক গঠন হারিয়ে ফেলে। ফলে যকৃতের কোষগুলো আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিলিভারডিনকে ডাইগ্লুকোরোনাইডে রূপান্তরিত করতে পারে না।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায়। তখন রক্তে অতিরিক্ত বিলিরুবিন বেড়ে যায়। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর প্রভৃতি পরজীবী দ্বারা সংঘটিত রোগে এমনটি দেখা যায়। এছাড়া কিছু জেনেটিক রোগ যেগুলো লোহিত রক্তকণিকার সাথে সম্পর্কিত যেমন, শিকল সেল এনিমিয়া (sickle cell anemia), স্ফেরোসাইটোসিস (spherocytosis), থ্যালাসেমিয়া (thalassemia), পাইরুভেট কাইনেজ ডেফিসিয়েন্সি (pyruvate kinase deficiency) ও গ্লুকোজ ৬-ফসফাটেজ ডিহাইড্রোজিনেজ (Glucose 6-phosphatase dehydrogenase) নামক এনজাইমের অভাবে এমনটি হতে পারে। এছাড়া পিত্তথলিতে সঞ্চিত বিলিরুবিন যদি অন্ত্রে পৌঁছাতে না পারে সেক্ষেত্রেও জন্ডিস হতে পারে।
পিত্তথলি থেকে একটি নালী গিয়ে অগ্ন্যাশয়ের নালীর সাথে মিশে একত্রে অন্ত্রে উন্মুক্ত হয়। এখন যদি কোনো কারণে পিত্তনালীতে পাথর, অগ্ন্যাশয়ের অগ্রভাবে ক্যান্সার কিংবা সংক্রমণ হয়, তাহলে এই নালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে পিত্তরস আর দেহে থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। পেটে গোলকৃমির অত্যধিক সংক্রমণ হলে এমনটাও দেখা যায় যে, গোলকৃমি কোনোভাবে পিত্তনালীতে ঢুকে বসে রয়েছে! সেক্ষেত্রেও পিত্তরস অন্ত্রে উন্মুক্ত হতে পারে না, ফলে জন্ডিস সৃষ্টি হয়।
জন্ডিস হলে চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রস্রাব অনেকসময় গাঢ় রঙ ধারণ করে। এছাড়া ক্ষুধামান্দ্য, বমিবমি ভাব, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, মৃদু থেকে তীব্র পেটে ব্যথা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে আমাদের দেহে অতিরিক্ত বিলিরুবিন জমা হলে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ত্বকের নিচে জমা হলে এটি ভয়ানক চুলকানির সৃষ্টি করে। এছাড়া অনেক সময় তা মস্তিষ্কে পৌঁছে গ্রে-ম্যাটারে জমা হয় এবং মস্তিষ্ককে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা এই ধরনের ক্ষতির ঝুঁকিতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো যে, নবজাতক যখন জন্ম নেয় তখন একধরনের জন্ডিস হতে পারে। সাধারণত জন্মের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে এই জন্ডিস দেখা দেয় এবং পঞ্চম দিনে সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে চিন্তার কিছু নেই। সাধারণত চৌদ্দ দিনের মাথায় সেরে যায় এটি।
জন্ডিসে আক্রান্ত হলে রোগীর মনে চিকিৎসা নিয়ে যতটা না কৌতূহল থাকে, তার চেয়ে বেশি কৌতূহল থাকে খাবার নিয়ে। রোগী কী খাবে আর কী খাবে না, তাই নিয়েই রোগীকে উত্যক্ত করে তোলে অনেকসময়। রোগী নিজেও থাকে বিভ্রান্তিতে। আর যখন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে যায় তখন তার বিভ্রান্তি আরো বেড়ে যায়। কারণ প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সাংঘর্ষিক।
জন্ডিস হলে সাধারণত রোগীকে অধিক পরিমাণে পানি পান করায়। ঘন ঘন আখের রস, ডাবের পানি পান করাতে থাকে। এতে প্রস্রাবের রঙ কিছুটা হালকা হয়ে আসে বলে লোকে মনে করে রোগীর উপকার করছে! এটি একেবারেই ভুল একটি পদ্ধতি। অধিক পানি পান করার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, তাই সেটি ফ্যাকাসে দেখায়। কিন্তু আসলে বিলিরুবিনের পরিমাণ কমে না। অন্যদিকে কারণ অধিক পানি পান করালে কিডনিতে সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে। তাই স্বাভাবিক পানি পান করাই শ্রেয়।
ভাইরাল হেপাটাইটিস হলে বিশ্রামে থাকা রোগীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহের ভেতরে রোগী সম্পূর্ণ সেরে যায়। আমাদের দেশে জন্ডিসের চিকিৎসায় বিভিন্ন ফকির-কবিরাজের সাফল্যের গল্প শুনি, তার ভিত্তি এটাই। অবশ্য কখনো কখনো জটিলতা তৈরি হয়। অন্যান্য যে সকল কারণে জন্ডিস হয়, সেগুলোর চিকিৎসা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই করতে পারেন। তাই জন্ডিস হলে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোই শ্রেয়।
আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ভাইরাসের মাধ্যমে জন্ডিস ছড়ায়। হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ও হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস রক্ত ও অনিরাপদ যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়ায়। সুতরাং রক্ত পরিচালনের সময় স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা অত্যাবশ্যক।
অন্যদিকে হেপাটাইটিস এ এবং হেপাটাইটিস ই ছড়ায় খাদ্য এবং পানির মাধ্যমে। রাস্তার পাশের ফুচকা, আখের রস প্রভৃতিই এর প্রধান বাহক।
সুতরাং সামনের বার রাস্তার পাশে ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ফুচকাতে কামড় বসানোর সময় একবার ভাববেন, আপনি ফুচকার বদলে এক ভয়ানক ভাইরাসকে নিজের দেহে নিমন্ত্রণ করছেন না তো?
Feature Image: Dr Lal PathLabs