পৃথিবীতে ভাইরাসের নির্দিষ্ট সংখ্যা কারো জানা নেই এবং এ সংখ্যা নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে। তবে ইকো হেলথ অ্যালায়েন্সে বলা হয়েছে, ১.৬৭ মিলিয়নেরও বেশি অজানা ভাইরাস রয়েছে পৃথিবীতে। বিজ্ঞানীদের ধারণামতে, এসব ভাইরাসের মধ্য থেকে ৬,৩১,০০০-৮,২৭,০০০টি ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম। তবে তারা ২৬৩টি ভাইরাস শনাক্ত করতে পেরেছেন যেগুলো মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। বৈশ্বিক মহামারি ঘটাতে পারে এরকম বাকি ৯৯.৯৬ শতাংশ ভাইরাস সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। অজানা এসব ভাইরাসঘটিত রোগকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডিজিস-এক্স। যেহেতু ভাইরাসটি অজানা, সেহেতু এর গতি-প্রকৃতি এবং শক্তিও অজানা।
অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের চেয়ে শক্তিশালী কোনো অজানা ভাইরাস কোনো একসময় মহামারি ঘটাবে এটা বলাই যায়। তবে অজানা ভাইরাস ছাড়াও কিছু চেনা ভাইরাস রয়েছে যেগুলো চরিত্র পাল্টে যেকোনো সময় মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) জনসাধারণের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ এরকম বেশ কয়েকটি সংক্রামক রোগের (ভাইরাসের) তালিকা তৈরি করে। এদের বেশিরভাগেরই এখনেও কোনো ভ্যাক্সিন নেই। গ্যাভি, দ্য ভ্যাক্সিন অ্যালায়েন্সে পরবর্তী-মহামারি ঘটাতে পারে এরকম কয়েকটি ভাইরাসের কথা বলা হয়েছে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সেসব ভাইরাস সম্পর্কে তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে এ লেখায়।
ইবোলা
ইবোলা ভাইরাসের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় আফ্রিকায় ১৯৭৬ সালে। মধ্য আফ্রিকার উত্তরাংশের দেশ কঙ্গোর উপত্যকায় প্রবাহিত ইবোলা নদী থেকে এই ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়। বন্যপ্রাণী, যেমন: বাদুড়, বানর, সজারু এবং অ-মানব প্রাইমেটদের দেহ থেকে এই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। তবে ধারণা করা হয়, টেরোপিডিডি পরিবারের বাদুড়ই এই ভাইরাসের প্রধান বাহক।
এই রোগে প্রথমদিকে সাধারণত জ্বর, মাথাব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া হয়। পরবর্তীতে পাকস্থলী ও অন্ত্রে রক্তপাত হয়। সংক্রমিত ব্যক্তির শরীর থেকে নিঃসৃত তরল, বিশেষত রক্ত, মল, ঘাম এবং বমি দ্বারা সরাসরি শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাসটি অন্য ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার জন্য ঘনিষ্ঠ মানব যোগাযোগ প্রয়োজন। পরিবারের সদস্য এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই এতে বেশি ঝুঁকিতে পড়েন। ভীষণরকম ছোঁয়াচে এই ইবোলা আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর হার ২৫-৯০ শতাংশের বেশিও হতে পারে।
১৯৭৬ সালের পর বেশ কয়েকবার এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। নবমবারের মতো ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় কঙ্গোতে। ২০১৪-১৬ সালের প্রাদুর্ভাবটি ছিলো বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জটিল। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ২৮,৬১৬ জনের দেহে ইবোলা শনাক্ত হয় এবং ১১,৩১০ জন মারা যায়। কঙ্গোতে চলমান ইবোলা ভাইরাসের কারণে ৩,৪৫৬ জনের দেহে ইবোলা পাওয়া গেছে এবং মারা গেছে ২,২৭৬ জন।
ছোঁয়াচে এই রোগের শতভাগ কার্যকর কোনো ভ্যাক্সিন বা ওষুধ এখনো তৈরি করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রিকোয়ালিফিকেশনের পরেই ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি), বুরুন্ডি, ঘানা, রুয়ান্ডা, উগান্ডা এবং জাম্বিয়া একটি ভ্যাক্সিন অনুমোদন দিয়েছে। এরভেবো নামক এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে মার্ক। তবে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনাও রয়েছে। অর্থাৎ কার্যকর টিকা আবিষ্কার হয়েছে বলা যাবে না। যেহেতু বেশ কয়েকবারই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব দেখেছে বিশ্ব, আবার কার্যকর টিকাও নেই, সেহেতু ভাইরাসটি যদি তার চরিত্র বদলে আরো সংক্রামক হয়ে ওঠে তাহলে করোনার মতো আরেকটা মহামারি অপেক্ষা করছে বিশ্বাবাসীর জন্য।
মারবুর্গ ভাইরাস ডিজিস
মারবুর্গ ভাইরাসটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক একটি ভাইরাস। এর কারণে হেমোরেজিক জ্বর হয়। এ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৮৮ শতাংশের উপরে। আক্রান্ত ব্যক্তি ৮-৯ দিনের মধ্যেই মারা যায়। এটি ইবোলা পরিবারের একটি ভাইরাস। ১৯৬৭ সালে ভাইরাসটি জার্মানির মারবুর্গ এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রথম শনাক্ত হয়। পরে তা বেলগ্রেড এবং সাইবেরিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকার উগান্ডা থেকে আমদানি করা সবুজ বানর নিয়ে গবেষণার ল্যাবটি এই প্রাদুর্ভাবের সাথে সম্পর্কিত বলে ভাবা হয়। ভাইরাসটি পরে অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও পাওয়া যায়।
২০০৮ সালে উগান্ডার একটি গুহায় ভ্রমণকারী দুজনের দেহে এই ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়। গুহাটিতে রাউসেটাস প্রজাতির বাদুড় বাস করতো। এজন্য ইবোলার মতোই মারবুর্গ ভাইরাসের উৎস হিসেবে বাদুড়কে ভাবা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে এটি অন্য মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত, শরীর থেকে নিঃসৃত তরল, টিস্যুর মাধ্যমে ভাইরাসটি অন্য ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে।
এ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণগুলো হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, অস্বস্তিবোধ ও পেশীতে ব্যথা। আক্রান্তের তৃতীয় দিন থেকে ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, খিচুনি এবং বমি হতে পারে। ডায়রিয়া চলতে পারে এক সপ্তাহ ধরে। অনেক রোগীর ৭ দিনের মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটে। আর রক্তক্ষরণেই রোগী ৮-৯ দিনের ভেতর মারা যায়।
২০১৭ সালে উগান্ডায় তিনজনের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত হয় এবং তিনজনই মারা যায়। ২০০৫ সালে অ্যাঙ্গোলায় ভাইরাসটি ২০০ জনকে আক্রান্ত করে, যার ৯০ শতাংশই মারা গেছে।
এখন পর্যন্ত ভাইরাসটির কোনো কার্যকর ভ্যাক্সিন পাওয়া যায়নি। তবে ব্লাড প্রোডাক্টস, ইমিউন থেরাপি এবং ড্রাগ থেরাপিসহ সম্ভাব্য চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা চলছে। টিকা তৈরির আগে ভাইরসটি যদি আরেকবার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার গতি-প্রকৃতি, শক্তি ভিন্ন হলে আরেক দফা মহামারির কবলে পড়তে পারে বিশ্ব।
লাসা ফিভার
লাসা জ্বর ইবোলা এবং মারবুর্গের মতো একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি আক্রান্ত ব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গ বিকল করে দেয় এবং রক্তনালী ফাটিয়ে দেয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৫ জনের ১ জন লিভার, প্লীহা বা কিডনিতে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। তবে ৮০ শতাংশ রোগীরই তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না।
ভাইরাসটি আফ্রিকার ম্যাস্টোমিস ইঁদুরের মূত্র বা মল দ্বারা দূষিত গৃহস্থালী জিনিসপত্র এবং খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। রোগীদের রক্ত বা টিস্যুর মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ এটিও ছোঁয়াচে রোগ। এ জ্বর থেকে সেরে উঠলেও রোগী দীর্ঘমেয়াদি শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, লাসা জ্বরে প্রতিবছর কমপক্ষে ১ লাখ থেকে ৩ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ৪০ হাজার রোগী মারা যায়। তবে সীমিত নজরদারির কারণে আকান্ত এবং মৃতের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজানা। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি সময়ের মধ্যেই নাইজেরিয়াতে ৪৭২ জনের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৬ জন মারা গেছে।
ইবোলা এবং মারবুর্গ ভাইরাস প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে এখন কিছুটা কমে আসলেও লাসা জ্বর পশ্চিম আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে দীর্ঘস্থায়ী প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে। এ জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১-১৫ শতাংশই মারা যায়। লাসা জ্বরের কোনো ভ্যাক্সিন নেই। অর্থাৎ এটিও শক্তি বাড়িয়ে মাহামারি ঘটানোর সক্ষমতা রাখে।
মার্স-কোভ
গত দুই দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ যে তিনটি করোনা ভাইরাসকে চিহ্নিত করা হয়েছিলো তার মধ্যে মার্স-কোভ একটি। এর পুরো নাম মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করোনোভাইরাস। ২০১২ সালে সৌদি আরবে এটি প্রথম শনাক্ত হয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৩৫ শতাংশ রোগীই মারা গেছে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একেবারে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না আসলে এটি অন্যজনের দেহে ছড়ায় না। বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায়, কুজওয়ালা উট এই ভাইরাসটির প্রধান বাহক। এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। তবে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়া হতে পারে।
২০১২ সালে সৌদি আরবে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ২৭টি দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেছে। তবে মোট রোগীর ৮০ শতাংশই সৌদি আরবের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এ পর্যন্ত মার্স-কোভ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সংখ্যা ২,৪৯৪ জন। মারা গেছেন ৮৫৮ জন।
এ ভাইরাসের কোনো ভ্যাক্সিন এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে মার্স-কোভের জন্য একটি টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছেছিলে। সেটি এখন কোভিড-১৯ এর টিকা হিসেবে কাজে লাগানো যায় কি না সেই পরীক্ষা চলছে।
সার্স
সার্স অর্থাৎ সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম ভাইরাসের উৎপত্তি চীনে। ২০০৩ সালে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয়। বিশ্বের ৩৭ টি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছিলো। এ পর্যন্ত ৭৭৫ জনের প্রান কেড়ে নিয়েছে ভাইরাসটি। আর আক্রান্ত করেছে ৮,২৭৩ জনকে।
করোনাভাইরাসের মতো এটিও হাঁচি-কাশির ফলে সৃষ্ট ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। এ ভাইরাসে আক্রান্তের উপসর্গ করোনাভাইরাসের মতোই। ২০০৩ সালের পর ভাইরাসটি আরো চারবার প্রাদুর্ভাব ঘটায়। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের কোনো ভ্যাক্সিন নেই। ফলে আরো বেশি শক্তি নিয়ে ভাইরাসটি করোনার মতো মহামারি সৃষ্টি করতেই পারে।
নিপাহ ভাইরাস
নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে ১৯৯৯ সালে থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। মালয়েশিয়ার শূকর ও শূকরচাষীদের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। শূকর ছাড়াও বাদুড়, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, কুকুর এবং বিড়ালের দেহেও এ ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে টেরোপোডিডি পরিবারের বাদুড়ই ভাইরাসটির প্রধান বাহক। নিপাহ ভাইরাস বহনকারী বাদুড় এবং শূকরের সংস্পর্শে আসা খাদ্য থেকেও এ ভাইরাস ছড়ায়। তবে আরো কয়েকটি দেশে ভিন্ন প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যেমে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে বাদুড়ের সংস্পর্শে আসা খেজুর এবং খেজুরের রস থেকে ভাইরাসটি মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুহার ৪০-৭৫ শতাংশ। জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীতে ব্যথা, বমি এবং গলা ব্যথা এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
১৯৯৯ সালের পর মালয়েশিয়াতে এ ভাইরাসের সংক্রমণ আর দেখা যায়নি। বাংলাদেশে এ ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। ২০১১ সালে বাংলাদেশে নিপা ভাইরাসের আক্রমণে শুধুমাত্র লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলাতেই ১৭ জনের বেশি মানুষ মারা যায়।
পূর্ব ভারতেও এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। ২০১৮ সালে ভারতের কেরালায় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয় ২৩ জন, যাদের মাঝে ১৭ জনই মারা যায়। এ ভাইরাস প্রতিকারে কোনো ভ্যাক্সিন এখনও আবিষ্কার হয়নি। ভাইরাসটি চরিত্র বদলে আরো সংক্রামক হয়ে উঠলে মহামারি ঘটতে পারে।
জিকা ভাইরাস
জিকা হচ্ছে ভাইরাসজনিত একটি সংক্রামক ব্যাধি। ১৯৪৭ সালে উগাণ্ডার জিকা নামক বনাঞ্চলের বানরের মধ্যে এ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। ১৯৫২ সালে উগাণ্ডা ও তানজানিয়াতে মানুষের মাঝে প্রথম এ রোগের সংক্রমণ ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে এ রোগটি আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এটি প্রধানত এডিস মশাবাহিত রোগ। আক্রান্ত পুরুষ রোগীর সাথে অনিরাপদ যৌনসম্পর্কে জড়ালে পুরুষ থেকে নারীদের মাঝে এ রোগ ছড়াতে পারে। গর্ভবতী মহিলা গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে জিকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে গর্ভের সন্তান এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়াও জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষার সময় অসাবধানতাবশত এ রোগ ছড়াতে পারে।
সাধারণত শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে, আক্রান্ত হওয়ার ৩-১২ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো দেখা যায় এবং সেগুলো ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সেক্ষেত্রে লক্ষণগুলো হচ্ছে জ্বর, ফুসকুড়ি, পেশীতে ব্যথা ইত্যাদি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় মায়ের জিকা ভাইরাস সংক্রমণ হলে শিশুদের জন্মগত রোগ মাইক্রোসেফালি অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও মাথার আকার তুলনামূলক ছোট হবার আশংকা থাকে।
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে ৫ লক্ষ মানুষের দেহে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় যাদের মধ্যে ১৮ জন মারা যায়। ৩,৭০০ শিশু এ ভাইরাসের কারণে জন্মত্রুটি (আকারে ছোট মস্তিষ্ক) নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিষেধক টিকা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
রিফট ভ্যালি ফিভার
রিফট ভ্যালি ফিভার হচ্ছে মশা বা রক্ত খেয়ে থাকে এমন পতঙ্গবাহিত রোগ। ১৯৩১ সালে কেনিয়ার রিফট ভ্যালিতে প্রথম এ ভাইরাসটি চিহ্নিত হয়। রোগটি প্রথমদিকে গরু এবং ভেড়ার মতো পশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে তা মানবসমাজেও ছড়িয়ে পড়ে। মশার কামড়ে এ রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বেশি। তবে এক মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
কোনো মানুষ যখন এ রোগে আক্রান্ত হয় তখন তার জ্বর ও পেশীতে ব্যথা হয়। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে অনেকে অন্ধও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া মস্তিষ্কে ফোলাভাব এবং অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাতও হতে পারে।
আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে কয়েক দশক ধরে এর প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে। পরে এটি মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১০ এবং ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভাইরাসটিতে ২৫০ জন আক্রান্ত হয় এবং ২৫ জন মারা যায়। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে এবং অনেক মানুষ মারা গেছে। এ রোগের জন্য এখনও কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার
এ ভাইরাসের প্রধান বাহক এঁটেল পোকা। এটি মূলত গৃহপালিত পশুকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত পশু অন্য কোনো পশু বা মানুষকে কামড়ালে সে-ও আক্রান্ত হয়। সদ্য জবাই হওয়া আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে আসলেও মানুষ এতে আক্রান্ত হয়।
সংক্রমিত মানুষের শারীরিক তরলের সংস্পর্শের মাধ্যমেও মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কিছু খবর পাওয়া গেছে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত ফ্লুর মতো লক্ষণ দেখা দেয়। পরবর্তীতে রোগীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে রক্তক্ষরণ হয়। ২০১৮ সালে আফগানিস্তানে ৪৮৩ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং ৫৯ জন মারা যায়। এ রোগে মৃত্যুহার ১০-৪০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো টিকা বা ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি।